‘আমার আবার জন্মোৎসব কিরে?’

উদিসা ইসলাম

শত ব্যস্ততা আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই কেটেছিল স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন। কিন্তু তার প্রিয় কর্মীরা এই দিনে তাকে অভিনন্দন জানাবে না, তা কী করে হয়? সকালেই নেতাকর্মীরা পৌঁছে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসার সেই আঙিনায়। বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এসে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে বললেন—‘আমার আবার  জন্মোৎসব  কিরে? আয় আয় আমার কাছে আয়।’ এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রিয় নেতার হাতে তারা তুলে দিলো পুষ্পস্তবক, গলায় পরিয়ে দিলো ফুলের মালা।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল লুঙ্গি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। সমবেত অনুরাগীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ছাত্র নেতারা, রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ, বিশিষ্ট নাগরিকরা ও ঢাকা নগরীর বিভিন্ন আওয়ামী লীগ শাখার কর্মী,  আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কর্মীরা জাতির জনককে রুপার তৈরি একটি নৌকা উপহার দেন। জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত একটি পুস্তিকা বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেওয়া হয়। এসময় পরিবারের প্রতিটি সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দিনের এই সময়টুকুই তিনি কেবল পারিবারিক আবহে কাটাতে পেরেছিলেন।

১৯৭২ সালের ১৮ মার্চের পত্রিকায় এই বিবরণ পাওয়া যায়।

কেবল এই দিনেই তিনি ‘আমার আবার জন্মদিন কিরে’ বলেছিলেন তা-ই নয়। বঙ্গবন্ধুর রোজনামচা থেকে জানা যায়, তিনি ৪৭তম জন্মদিবসেও এই একইরকম উচ্চারণ করেছিলেন—নিজের মনে, কারাগারে বসে। ৪৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে (১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ) ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, জন্মবার্ষিকী তিনি কোনোদিনই নিজে পালন করেননি। বেশি হলে তাঁর স্ত্রী ওই দিনটাতে তাঁকে ছোট্ট একটি উপহার দিতেন। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করতেন জন্মদিনের সময় বাড়িতে থাকতে।

ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করছে—খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর ধারণা, তিনি জেলে বন্দি বলেই দল থেকে জন্মদিন পালন করা হয়েছে। দল জন্মদিন পালন করেছে দেখে তিনি যে হেসেছিলেন তাও ডায়েরিতে আছে।

তিনি লিখেছেন—‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব ও রাসেল
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব ও রাসেল
বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্মদিনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে দুটো জিনিস চেয়েছিলেন—বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর এবং সফরের আগেই ভারতের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়া। ইন্দিরা গান্ধী দুটো কথাই রেখেছিলেন।

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের মিত্র রাষ্ট্র ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের মহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। সভা শেষে রাজভবনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন এবং আপনার সফরের আগেই আমি চাই—আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন।’ সেই মতে ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্যদিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল।

সেই উৎসবের মধ্যে দেশবাসী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী পালন করে। সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুকে গভীর আন্তরিকতায় ফল ও মিষ্টি উপহার দেন। সেসব ভারত থেকেই নিয়ে আসেন তিনি। এটা ছিল ভারতের ৫০ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা।

সেই দিন দেশের সবচেয়ে বড় জনসভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানে ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতায় বলেন, ‘আজকের দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং সুদিন বটে। কারণ, আজ  শেখ মুজিবুরের জন্মদিন। তিনি হলেন এদেশের মুক্তিদাতা। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। কামনা করি তিনি দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করুন।’

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ১৭, ২০২০

SUMMARY

2404-১.jpg

জন্মদিনে বেগম মুজিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর