উদিসা ইসলাম
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সফর শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আবারও বাংলাদেশ সফরে আসার আহ্বান জানান। জবাবে ইন্দিরা বলেন— ‘অবশ্যই আসবো’। ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতি যে আতিথেয়তা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে, এতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন বলে জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
দেশে রওনা দেওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন। বিনা আত্মত্যাগে মহৎ কিছু অর্জন হয় না উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র অভ্যুত্থান দিবসে এক বাণীতে বলেন, ‘পাকিস্তান সামরিক চক্র জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে প্রতিরোধের সময় নিহত হন তিন জন। এই ত্যাগ বৃথা যায়নি।’
১৯৭২ সালের ২০ মার্চের পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯ মার্চ সকাল ১০টার সময় ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান ‘রাজহংস’ ইন্দিরা গান্ধী ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা থেকে দিল্লির পথে যাত্রা শুরু করে। বাসসের খবরে বলা হয় যে, বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া উপহার দেন। এসময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আবারও বাংলাদেশে সফরে আসবেন।’ শ্রীমতি গান্ধী উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আসবো।’
বিদায় জানানোর সময় বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরে আসায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী সহাস্যে বলেন, ‘ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের মানুষ তার প্রতি যে আতিথেয়তা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে, এতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সব কথা সবসময় মনে থাকবে।’
বিনা আত্মত্যাগে মহৎ কিছু অর্জন হয় না
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র অভ্যুত্থান দিবসে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। তাদের চরম আত্মত্যাগের ফলে আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লেখা থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, ‘এদিন পাকিস্তান সামরিক চক্র জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। ফলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এতে করে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বুলেটে তিনটি মূল্যবান জীবনের অবসান ঘটে। বিনা আত্মত্যাগে মহৎ কিছু অর্জন হয় না। ফলে নিয়ামত, মানু ও খলিফার আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।’
ইত্তেফাকের প্রতিবেদন বলছে, ১৯৭১ সালের এই দিনে জয়দেবপুরে জনতা-সেনাবাহিনী সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর উসকানিমূলক হামলায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। এই দিন মুজিব-ইয়াহিয়া তৃতীয় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৯০ মিনিটের বৈঠকে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ব্যাপারে ভারত আগ্রহী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ব্যাপারে ভারত আগ্রহী।’ বাংলাদেশের দুই দিনের সফর শেষে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে তিনি একথা বলেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একটি শান্তি ও সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।
বঙ্গভবনে যুক্ত ঘোষণায় দুই প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরআক্রান্ত হলে যৌথ কর্মপদ্ধতি
ভারতের সাধারণতন্ত্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী সহযোগিতা ও শান্তির এক ঐতিহাসিক ‘২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গভবনে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি গত বছর ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির অনুরূপ। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী দুই দেশ ঘোষণা করে— যেকোনও পক্ষই তাদের যেকোনও এক পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করবে না, কিংবা অংশ নেবে না। আরও বলা হয়েছে যে— বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত কোনও তৃতীয় দেশকে সাক্ষ্যদানকারী দেশ কোনোরকম সাহায্য দানে বিরত থাকবে। দুটি দেশই তাদের যেকোনও একপক্ষে সামরিক ক্ষতি হয়, কিংবা নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়, তেমন কাজে তাদের এলাকাকে ব্যবহৃত হতে দেবে না এবং উভয় পক্ষই একে অপরকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকবে।
চুক্তিতে ছিল দুই দেশের পরস্পরের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক সংহতির মর্যাদা দান এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার ঘোষণা। দুই দেশ তাদের অভিন্ন লক্ষ্য অনুসরণের সব ধরনের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য চূড়ান্তভাবে অবসানে সহযোগিতা করবে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রশ্নে বৈঠক ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়মিত আলোচনা চলবে।
সংবাদ সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধী
জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ বাণী মিথ্যে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশে খাদ্য সংকট ও সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে জাতিসংঘ যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছে আমি তা বিশ্বাস করি না।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে ভারতের নামেও এমন ভবিষ্যৎ বাণী জোরেশোরে করা হয়েছিল। কিন্তু তা সবই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারত যে শুধু খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে তা-ই নয়, ভারত ওই বছর প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য রফতানি করেছে।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘এ ধরনের বহু ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়ে থাকে। কিন্তু তা একটাও ফলতে দেখা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘ওদের এসব ভবিষ্যৎ বাণীতে আমার বিশ্বাস নেই। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে দুই লাখ টন খাদ্যশস্য সাহায্য দিয়েছে বলে আমি শুধু শুনলাম। কিন্তু একটা খাদ্যশস্য পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়নি।’
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২০