জেলা সফরের সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর, দেশে ভাইরাসের প্রকোপ

উদিসা ইসলাম

১৯৭২ সালের ২২ মার্চের পত্রিকা

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ চট্টগ্রাম ও ৩০ মার্চ খুলনা সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রাম ও খুলনার জনসভায় তিনি বক্তৃতা করবেন বলেও প্রস্তুতি চলছিল।

দেশে ভাইরাসের প্রকোপ

১৯৭২ সালের এই সময়ে হঠাৎ সারাদেশে ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ বাড়তে থাকে। দৈনিক বাংলার খবরে বলা হচ্ছে, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে প্রচণ্ড জ্বর-কাশি ও শরীর ব্যথার উপসর্গ নিয়ে বহু রোগী চিকিৎসার জন্য উপস্থিত হচ্ছিলেন। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই প্রতিদিন রোগী ভর্তি হয়েছে গড়ে পাঁচ জন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন অধ্যাপকের বরাতে খবরে লেখা হয়, সম্ভবত ভাইরাসের আক্রমণে আমাদের দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যেহেতু ভাইরাস চিহ্নিতকরণ অথবা সুনির্দিষ্ট কারণ নির্ধারণের ব্যবস্থা সেসময় আমাদের দেশে ছিল না, সেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গ নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই রোগের চিকিৎসা হচ্ছিলো।

শিশুরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে

এইদিনে মতিঝিল সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের একদল ছাত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ পান। তারা তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে নিজেদের ঋদ্ধ করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিলে তারা ৩৫০ টাকা দান করে। একুশে ফেব্রুয়ারির পুস্তিকা বিক্রি করে তারা এই অর্থ সংগ্রহ করেছে বলে জানায়।

১৯৭২ সালের ২২ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ২২ মার্চের পত্রিকাস্বাধীনতা দিবস অনাড়ম্বরভাবে পালনের আহ্বান

ছাত্রনেতারা আর কয়েকদিন পরেই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের আগে আগে বিবৃতি দেন। তারা বলেন, স্বাধীনতা দিবস অনাড়ম্বরভাবে পালন করা হোক। অত্যন্ত অনাড়ম্বর পরিবেশে আসন্ন স্বাধীনতা দিবস পালনের জন্য জনসাধারণ, বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি ছাত্র, রাজনৈতিক, সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অর্থ ব্যয় না করে সব টাকা শহীদের পরিবার ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করার জন্য আবেদন জানায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্যরা। এক প্রেস রিলিজের বলা হয়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে সত্য। কিন্তু সবদিক থেকে মুক্ত নয়। সমগ্র জাতি আজ খাদ্যসঙ্কট ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থায় অনাড়ম্বরভাবে স্বাধীনতা দিবস পালন প্রত্যেকটি নাগরিকের কর্তব্য।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনি এবং সরকারি বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় নারায়ণগঞ্জে দূরপাল্লা সাইকেল রেস, যেটি ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে শুরু হয়েছিল; সকাল সাড়ে সাতটায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কুচকাওয়াজ; সকাল আটটায় সদরঘাট পর্যন্ত দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া আহত মুক্তিযোদ্ধারা অনাথ শিশুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেন। মুক্তিফৌজ, কচিকাঁচা, সবুজসেনা ও অন্যান্য সংগঠনের কুচকাওয়াজ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭২ সালের ২২ মার্চের পত্রিকা
১৯৭২ সালের ২২ মার্চের পত্রিকা

ভারত বাংলাদেশের বিনিময় প্রথা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অদূর ভবিষ্যতে বিনিময় প্রথার বিদ্যুৎ আমদানি ও রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশ হয়। এনিয়ে দুই দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের আলাপ-আলোচনা শুরু হবে বলে উল্লেখ করে দৈনিক বাংলা তাদের প্রধান প্রতিবেদনে জানায়, বিস্তারিত আলোচনার পর একটি বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানি রফতানি শুরু হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের পর দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক কল্যাণে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতীয় এলাকাগুলোর সংযোগ সাধনের সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য উভয় দেশের বিশেষজ্ঞদের বিস্তারিত প্রস্তাব প্রণয়ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা সেসময় আলোচনা করে জানান যে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সংযোগ সাধন করে বিদ্যুৎ আমদানি রফতানি করলে দুদেশই লাভবান হবে। ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলো বহুকাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি রফতানি করে আসছিল।

আটক বাংলাদেশের দুর্ভোগ চরমে

পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের অবস্থা চরমে উঠেছে। অধিকাংশ বাঙালি সরকারি কর্মচারীর পদাবনতি ঘটেছে কিংবা তাদের ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের এক হাজার টাকা কিংবা মূল বেতনের এক-তৃতীয়াংশ, যেটা কম, তাই নিতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের বাড়ির টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। প্রাইভেট ফান্ড থেকেও তাদের কোনও টাকা তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। করাচি, রাওয়ালপিণ্ডি, ইসলামাবাদ ও পাকিস্তানের অন্যান্য স্থান থেকে পাওয়া খবরে জানা যায় যে- সেখানে বাঙালিরা তাদের নিজেদের ও পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। এমনকি তারা একা কেনাকাটা করতে বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতেও যেতে সাহস পাচ্ছেন না। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালির সদস্যদের নিরস্ত্র করে সামরিক শিবিরে রাখা হয়েছে। এছাড়া ফেরত পাঠানোর নামে বহু বাঙালিকে শিবিরের আটক রাখা হয়েছে। করাচি থেকে সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রায় সর্বত্রই এ ধরনের শিবির ছিল।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ২১, ২০২০ 

SUMMARY

2398-১.jpg