আজকের দিনটি আমি একান্তে অনুভব করতে চাই: বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ— সেই ভয়াল রাতের কথা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রথম ছোবলের দিন। আপামর বাঙালির ওপর গণহত্যা চালানো হয়। আর বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী প্রধান নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে করা হয় বন্দি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বছর ঘুরে আসে ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

এই দিনটিতে বঙ্গবন্ধু দৈনিক বাংলার সাংবাদিকদের বলেন, ‘লাখো বাঙালির রক্তভেজা আজকের দিনটাতে কোনও কথা বলার মতো মনের অবস্থা আমার নেই।’

সাক্ষাৎকার দিতে চাননি তিনি

পত্রিকা থেকে সাক্ষাৎকার নিতে গেলে আলাদাভাবে কোনও কথা বলেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, ‘আমার সোনার বাংলার বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই অশুভ লগ্নটাকে আমি একান্তভাবে অনুভব করতে চাই।’

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

ঠিক ওই সময় শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢোকেন। পরনে তার সাদা কাপড়। ব্যথা ভরা চোখের দিকে তাকালেন বঙ্গবন্ধু। তারপর যেন আপন  মনে বললেন, ‘ওকে আমি সেদিন সকালেই বলেছিলাম— এখান থেকে পালিয়ে যেতে। জানি না কেন গেলো না।’ তার কথা শেষ না হতেই সামনে থাকা একজন রিপোর্টার প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনিও তো পালাতে পারতেন।’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘না, পারতাম না। সাড়ে সাত কোটি সন্তানসহ কে আমাকে আশ্রয় দিতো। তাই ঠিক করেছিলাম, বাংলার মানুষের বদলে ওরা যদি আমার প্রাণটা চায়, আমি তা-ই এগিয়ে দেবো।’ কথা বলতে বলতে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল বলে ওই  সাংবাদিক উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে মারে নাই। আজ দুঃখ হয়, আমার দেশের শহীদ ভাইদের বিশ্বস্ত বঙ্গবন্ধু ছিলাম আমি। তবে কেন আমার লাশ মিশে গেলো না লাখো শহীদের লাশের সঙ্গে। মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তাতে আমার আত্মা সান্ত্বনা পেতো। এখন লাখ লাখ শহীদের মায়ের সামনে আমার বেঁচে থাকাটাই অপরাধ বলে মনে হয়।’

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

বঙ্গবন্ধু কথা দেন যাবেন

শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেমের স্ত্রী তার স্বামীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন— তার সন্তানদের কথা। তার কথা। তিনি ২৬ মার্চ অত্যন্ত ব্যস্ত মুহূর্তের মাঝে কাটাবেন উল্লেখ করে বলেন, তবুও তিনি এক মুহূর্ত সময় করতে পারলেও ওখানে যাবেন। প্রতিবেদকের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সাড়ে তিনটায় ঘণ্টাখানেকের জন্য ফেরেন এবং রাত সাড়ে ১১টার নিচে বাসায় ফেরা সম্ভব হয় না। তবুও শান্তি পেতাম দেশের লোকগুলোর জন্য যদি দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে পারতাম।’
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

ইয়াহিয়ার বিষয়ে বেগম মুজিব

১৯৭১ সালের এই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘প্রথমেই আমার মন কেঁদে ওঠে, সেই ভয়াল ২৫ মার্চের কালো রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এদেশের পরিজন হারানো লাখ লাখ পরিবারের কথা ভেবে। অশান্ত হয়ে ওঠে মন। তাই পৃথক করে হিংস্র ওই রাতটির কোনও কথা বলতে বা ভাবতে আমার মন সায় দেয় না’, বলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

তিনি বলেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনের সেই অনন্য দিনগুলো ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বাংলার মানুষ এক হয়ে গিয়েছিল। ঠিক তেমনই মুহূর্তে আলোচনার প্রস্তাব অনুযায়ী ইয়াহিয়া বাংলায় এলো। প্রথম থেকেই পাকিস্তানি এই নৃশংস পশুটাকে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম না। আলোচনা বৈঠকের প্রথম থেকেই এক অশুভ কালোছায়াকে আমি যেন দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিনের জাগ্রত বাংলার অঙ্গনে শেখ সাহেবকেও আমি বলেছিলাম— যারা তাকে আগরতলা মামলায় জড়িয়েছে, তারা ভালোভাবেই জানে যে, শেখ সাহেব বাংলাদেশ আর বাঙালিদের জন্য চিন্তাভাবনা করেন। পাকিস্তান প্রশ্নে তার আগ্রহ নেই। পাকিস্তানের ক্ষমতা তারা শেখ সাহেবকে দেবে না। কাজেই আলোচনা আরম্ভ করে তারা অন্যকোনও নতুন কৌশল বের করার সুযোগ খুঁজেছে মাত্র। আমার কথা শেখ সাহেব শুনলেন, কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। তিনি দলীয় নেতাদের বৈঠক ছাড়া বাইরে তেমন কিছু বলতেন না তখন।’

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০২০ 

SUMMARY

2395-১.jpg

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা