সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শ্রমিকদের সাহায্য চাইলেন বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম
অর্থনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তির কোনও অর্থ দাঁড়ায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় শ্রমিক প্রতিনিধিদের একটি কনফারেন্সে এই কথা বলেন। ১৯৭২ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক পত্রিকায় এই খবর ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, সরকার জনকল্যাণে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠায় চূড়ান্তভাবে দায়বদ্ধ। ইতোমধ্যে বেশকিছু বিষয় জাতীয়করণসহ অর্থনৈতিক নীতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উল্লেখ করে দেশ পুনর্গঠনে সবার অবদানের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। এই দিনের পত্রিকায় ময়মনসিংহের ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ৪ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর ময়মনসিংহ সফরে যাওয়ার নির্ধারিত দিন। পত্রিকাগুলোতে দুর্যোগকবলিত এলাকার ছবি ও দুর্ভোগের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়।

কিছু মানুষের হাতে বন্দি

শিল্প, ব্যাংক এবং বিমা কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে সরকার ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি শ্রমিকের ও জন কল্যাণে। আমরা চাই জাতীয় স্বার্থে অর্থনীতি কিছু মানুষের হাতে বন্দি না থাকুক। এই লক্ষ্যে আমরা দেশের নতুন অর্থনীতি তৈরিতে কাজ শুরু করেছি।’ এই পথের অনেক বাধা আছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ হবে কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের দেশ। ধনীদের এই বিষয়টিতে অভ্যস্ত হতে হবে।‘ ব্যাংক-বিমা চটকল চিনিকল জাতীয়করণের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি শিল্পপতিরা খুশি হননি। কিন্তু এখন থেকে শিল্পপতিদের জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এখন সম্পত্তির মালিক।’

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

পর্যায়ক্রমে আরও শিল্প জাতীয়করণ হবে

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের কনফারেন্সে গিয়ে তাদের নানা বিষয়ে কথা শোনেন। তিনি এর আগে ২৬ মার্চ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ব্যাংক-বিমা, পাটশিল্প, বস্ত্র, চিনিশিল্প, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতের বিরাট অংশ, ১৫ লাখ টাকার বেশি সম্পত্তির অনুপস্থিত মালিকদের পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ বিমান ও জাহাজ করপোরেশনের জাতীয়করণের কথা ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা শিল্প জাতীয়করণ করেছি। সেগুলো বাঙালি নাকি অবাঙালিদের হাতের রয়েছে সেটি বিবেচনায় না নিয়েই করা হয়েছে।’ আরও শিল্পকে জাতীয়করণ করা হবে বলেও বঙ্গবন্ধু ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, শিল্প ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়েছে এটি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এগুলো জাতীয়করণ করা খুব সহজ কিন্তু এগুলো ধরে রাখা খুব কঠিন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলো এবং শ্রমিকদের সক্রিয় সহযোগিতা আশা করেন, যাতে করে সরকার দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে পারে।

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

ঘূর্ণিঝড় কবলিত মানুষের হাহাকার

১ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার মানুষ দিশেহারা। খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। ডেইলি অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ অসহায়ত্বে দিন কাটাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে এবং সেখানে মানুষ পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করার কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রতিবেদক সরেজমিনে অভিজ্ঞতা থেকে করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ওই এলাকায় গেলে মনে হবে কেউ বুলডোজার দিয়ে জায়গাটা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে লেখা হয়, ঘূর্ণিঝড় এত বেশি তীব্র ছিল যে পুকুর থেকে মাছ উঠে এসেছিল। স্থানীয়দের দাবি, এখন এলাকাবাসী মোটামুটি খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে এবং বিভিন্ন জিনিসপত্র এক জায়গায় করে তারা কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির চেষ্টা করছে।

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা
১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা

ষড়যন্ত্র এখনও চলছে

স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু হওয়া চক্রান্ত এখনও শেষ হয়নি বলে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানান, চক্রান্তকারীরা বসে নেই। রক্তের মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা আমরা প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করবো উল্লেখ করে আবারও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক থাকতে হবে।’ জাতীয়করণ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে কেউ কোনও নেতিবাচক অবস্থান নিতে চেষ্টা করলে তা বরদাস্ত করা হবে না বলেও বঙ্গবন্ধু জানান। মনে রাখতে হবে যে, এখন এর মালিক বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদেরকেই এই টিকিয়ে রাখার কথা ভাবতে হবে।

স্বাধীনতার বিনিময়ে কোনও সহযোগিতা নয়

বঙ্গবন্ধু বিদেশি সহায়তা নিয়ে বারবারই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলছিলেন। কোনও অবস্থাতেই তিনি কারও কাছে মাথা নত করতে পারবেন না বলে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের বলেন, কোনও শর্তে বৈদেশিক সাহায্য নয়। টাকার জন্য দেশ বন্দক রাখা যাবে না। এ স্বাধীনতা অর্জনে রক্তে রঞ্জিত হতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জনসাধারণকে দেশ গড়ার কাজে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০২০ 

SUMMARY

2386-১.jpg

১৯৭২ সালের আজকের পত্রিকা