উদিসা ইসলাম
স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল। এ ব্যাপারে ৬ এপ্রিল পত্রিকাগুলোতে বেশকিছু আগাম সংবাদ প্রকাশ করা হয়। আলোচনায় ছিল- দলটির সভাপতি পদে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই থাকছেন, নাকি অন্য কেউ। যদিও দলের পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর কথাই জানানো হয়। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশে এই মুহূর্তে নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকেই দরকার। এছাড়া এই দিনে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বিষয়ে উদ্যোগ নিতে রেডক্রসকে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। এর আগে আন্তর্জাতিকভাবে বেশকিছু দ্বিপাক্ষিক আলাচনায় তিনি দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা এবং নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এসব প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও সময় লাগার কারণে এবার রেডক্রস প্রধানকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বেশকিছু দলীয় সিদ্ধান্ত
শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলার ১৬ জন গণপরিষদ সদস্যকে বহিষ্কারের আদেশ দেন বঙ্গবন্ধু। দলের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন এবং দ্রুতই তা কার্যকর হবে বলেও জানানো হয়। বাসস সংবাদটি প্রকাশ করে। একইসঙ্গে ১৩ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। গণভবনে শৃঙ্খলা কমিটির সামনে হাজির হয়ে ৭ এপ্রিল দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে সুযোগ দেওয়া হয় তাদের।
দলের কাউন্সিল, বঙ্গবন্ধুকেই সভাপতি রাখার দাবি
প্রথমবারের মতো স্বাধীন দেশে 'মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল' আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ৭ এপ্রিল। পত্রিকার পাতায় কাউন্সিলের প্রস্তুতি ও সম্ভাব্য কর্মসূচির বেশকিছু সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। পত্রিকার সংবাদ বলছে, কাউন্সিলের আগে বঙ্গবন্ধুকেই আবারও সভাপতি রাখার বিষয়ে জোর তৎপরতা শুরু হয়। মূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা ছিল, দেশের এই ক্রান্তিকালে দলকে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধুকেই সভাপতি রাখতে হবে। এর আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম বৈঠকে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দলীয় সাংগঠনিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেদিন সংগঠনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের পর তাজউদ্দিন আহমেদ জানান যে, দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে কেউ একইসঙ্গে মন্ত্রী ও দলীয় কর্মকর্তা থাকতে পারেন না। তারা একসঙ্গে উভয় পদে অধিষ্ঠিত থাকার চেষ্টা করবেন না।
বাঙালিদের ফিরিয়ে আনতে রেডক্রসকে আহ্বান
পাকিস্তানে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে পড়া ও নির্যাতনের শিকার বাঙালিদের বিষয়ে খোঁজ নিতে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রেডক্রসের প্রধান মি এল মার্টিকে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, সেখানকার বাঙালিদের পরিস্থিতি দেখার জন্য অনতিবিলম্বে রেডক্রসের প্রতিনিধি দলকে পাঠানো হোক। আলোচনা শেষে মার্টি সাংবাদিকদের বলেন- বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটকে পড়া তার নাগরিকদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন, তিনি দ্রুত জেনেভায় খবর দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। মার্টি আশা প্রকাশ করেন, শিগগিরই সেখানকার বাঙালিদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং আইসিআরসি পাকিস্তানের ক্যাম্পগুলোতে ভিজিটে যাবে।
এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানে বাঙালি নির্যাতন চলছে, এই মর্মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ বাণী নিয়ে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পল মার্ক হেনরি জাতিসংঘের সদর দফতরে যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি আকস্মিকভাবে জাতিসংঘের সদর দফতরে যান। এটি ছিল নিউইয়র্কে তার অনির্ধারিত সফর। অনুমান করা হচ্ছে, জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে বঙ্গবন্ধুর বাণী নিয়ে যান তিনি। বাসস তাদের নিজস্ব খবরে প্রকাশ করে, বঙ্গবন্ধু কী বিষয়ে বার্তা দিয়েছিলেন তা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছিলো, তা বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে বঙ্গবন্ধুর চিঠিতে অনুরোধ ছিল বলে অনুমান করা হয়।
পরবর্তীতে ৪ মার্চ রাশিয়া সফরকালে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে সোভিয়েত সরকারকে প্রভাব খাটানো বিষয়ে তৎপর হতে আহ্বান জানানো হয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদ্রে গ্রোমিকো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে আলোচনাকালে রাশিয়া তৎপর হবে বলে আশ্বাস দেন। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়ন করেন, তখন পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফেরত আনার প্রস্তুতি নিয়েও তারা কথা বলেছিলেন।
সুৃত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : এপ্রিল ০৬, ২০২০