কায়কোবাদ মিলন
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রায় .......... বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমাদের মহান স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ডসহ বহু দেশ এবং জাতিসঙ্ঘ পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং তাদের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেলে বহু চিঠিপত্র আদান প্রদান করা হয়েছিল। এই সব চিঠিপত্রের মধ্যে কোনোটি মোস্ট কনফিডেন্সিয়াল, কোন সিক্রেট অভিধায় ছিল চিহ্নিত। সেই সব চিঠিপত্র ও বৈঠকের বিবরণ এক মূল্যবান দলিল। কোনো কোনো দেশ সেইসব চিঠিপত্র পুস্তক আকারে প্রকাশ করেছে, কোনো কোনো দেশ এত দিন পর তা অবমুক্ত করেছেÑ যা আজ ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। অবশ্য কিছু চিত্র অপমানকর। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম। ইতিহাসের সেই মূল্যবান উপাদান আমাদের পাঠক ও গবেষকদের জন্য অনুবাদ করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক কায়কোবাদ মিলন।
ইন্দিরাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চিঠি
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘ডিয়ার ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টা’র হিসেবে সম্বোধন করা হয়। চিঠির বক্তব্য নি¤œরূপ :
’৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর লেখা আপনার চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে আপনি উপমহাদেশের যুদ্ধের জন্য কয়েকটি দেশকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। গত এক বছরে আপনার সাথে আমার যেসব মতামত বিনিময় হয়েছে তাতে আপনি বিস্মিত হবেন না যে, ওই অভিমত আমি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছি।
এ ব্যাপারে কনফিডেনশিয়াল চ্যানেলে আপনাকে দীর্ঘ চিঠি লিখব। কিন্তু আমি কিছুতেই আপনার বিবরণ মানতে রাজি নই যে, রাজনৈতিকভাবে সঙ্কট সমাধানে একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ‘সময়োপযোগী’ শব্দের তাৎপর্যও কিন্তু আপেক্ষিক। যুক্তরাষ্ট্র ৯ মাস ধরে, শরণার্থী সঙ্কটে এগিয়ে আসতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে সঙ্কট সমাধানেও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিতে সচেষ্ট ছিল।
আমরা উভয়ে যখন ওয়াশিংটনে সাক্ষাৎ করি, তখনো শরণার্থীদের জন্য ব্যয়িত বেশিরভাগ অর্থ যুক্তরাষ্ট্র দেবে বলে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আপনাকে পাকিস্তান সরকারের দেয়া একটি প্রস্তাবও অবহিত করা হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রস্তাব ছিল, তারা সামরিক বাহিনী প্রথম পর্যায়েই প্রত্যাহার করতে রাজি, যদি ভারত তাদের দেখাদেখি তা করে। আপনাকে এমন কতকগুলো পথ বাতলে দেয়া হয়েছিল, যে প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আমরা আপনার রাষ্ট্রদূতকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে মূল্যায়নপূর্বক রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, ভারত একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। আমরা ফেস ভ্যালু হিসেবে ওই বক্তব্যকে গ্রহণ করেছিলাম।
আমরা কখনোই দাবি করিনি যে, আমাদের প্রস্তাবসমূহ ভারতের অবস্থানকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করবে। এগুলো ছিল প্রস্তাব এবং ওই প্রস্তাবের আলোকেই আলোচনার সূত্রপাত হতে পারত। আমি ভেবেছিলাম এটা হয়তো সেই ক্ষণ যখন স্টেটসম্যানরা যুদ্ধ ব্যতিরেকেই ইতিহাসের গতি প্রকৃতি বদলে দিতে পারেন।
আমাদের সম্পর্কে কি কোনো টানাপড়েন ছিল? হ্যাঁ ছিল। কেননা আপনার সরকার আমাদের প্রস্তাবগুলো ছুড়ে ফেলে দেয় এবং কোনো সতর্কতা না জানিয়েই যুদ্ধ শুরুর পথ বেছে নিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য পুনঃপুন আহ্বান জানিয়ে আসছিল। জাতিসঙ্ঘের এই প্রস্তাব নিরঙ্কুশ ভোটে গৃহীত হয়েছিল। আমি যে কথা বললাম, জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের মধ্যেই তার আভাস বিদ্যমান।
সাম্প্রতিককালে জাতিসঙ্ঘ গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ মূলত ভারতের বিরুদ্ধে নয়। যদি রাজনৈতিকভাবে সঙ্কট সমাধানের যাবতীয় পন্থা রুদ্ধ হয়ে যায়, তখনি সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ আসে। এই কার্যক্রমে যারা ব্যত্যয় ঘটায় তাদের বিরুদ্ধেই জাতিসঙ্ঘ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি যে, এশিয়ায় ভারত একটি প্রধান শক্তি এবং প্রকৃতপক্ষেই গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে অভিন্ন মূল্যবোধের আমরা অংশীদার। আমাদের মহান এই দুই দেশের সম্পর্ক বিনষ্ট করার কোনো বাসনা আমাদের নেই। আমাদের অবশ্যই আশা করা উচিত, এমন এক দিন আসবে যখন এশিয়ার স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করব। আমরা দুঃখিত যে, দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রতিক কয়েক মাসের ঘটনাবলি স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে পরস্পরকে অনেক দূরবর্তী করে দিলো।
সুইস দূতাবাসের বার্তা
১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির সুইস দূতাবাস পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বার্তা ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে। ইসলামাবাদের সুইস দূতাবাসকে এ বার্তাটি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। এই বার্তায় বলা হয়, বিদেশী সমভিব্যাহারে পাকিস্তানের কিছু জাহাজ কলম্বো, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই জাহাজগুলোর গন্তব্য ছিল পাকিস্তান কিংবা ভারত। সুইস দূতাবাস ভারতের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে ওই সব জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন না করার অনুরোধ জানায়। উল্লেখ্য, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসান ঘটলে সুইস দূতাবাস ‘প্রোটেক্টিং অথরিটি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারা ওই বার্তায় আরো উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সরকারও অনুরূপ সুযোগ দিতে বদ্ধপরিকর।
একই দিন অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর দিল্লির সুইস দূতাবাস ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আরেকটি বার্তা দেয়। ইসলামাবাদে অবস্থিত সুইস দূতাবাসে এই বার্তার মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে রাজস্থানের তিনটি চৌকি দখল, কাশ্মিরে অসংখ্যবার গোলাবর্ষণ, হোসাইনিওয়ালায় ২৬ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে আটকের অভিযোগ আনে। পাক সরকার আরো উল্লেখ করে, তারা ভারতীয় সৈন্য ও তাদের ‘বস’দের রেডিও কথোপকথন উদঘাটন করেছে। ভারতীয় একটি ইউনিটের সৈন্যরা ওই কথোপকথনে পাক সৈন্যদের গুলি করে হত্যার অনুমতি চাইছিল তাদের বসদের কাছে। পাকিস্তান সরকার সুইস দূতাবাসকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে অবহিত করে যে, তাদের হাতেও ভারতীয় সৈন্য বন্দী রয়েছে। ওই চিঠিতে পাকিস্তান সরকার আরো উল্লেখ করে, তারা জানতে পেরেছেÑ পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনী বিশেষ কিছু গ্রুপের লোকদের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে। পাকিস্তান ভারতকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়।
’৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর ভারতের সচিব (পূর্ব) এস কে ব্যানার্জি তাদেরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি নোট দেন। এই চিঠির গায়ে ‘সিক্রেট’ শব্দটি লেখা ছিল। চিঠিতে এস কে ব্যানার্জি লেখেন, পাকিস্তান আমাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের পর ইসলামাবাদ ও করাচিতে অবস্থিত ভারতীয় মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে তারা কেমন ব্যবহার করেছে? চিঠিতে ব্যানার্জি লেখেন যে, আমি যে বিষয়টি বিশেষভাবে জানতে চাইছি, তা হলো পাকিস্তান প্রাপ্য মর্যাদা থেকে ভারতীয় কূটনীতিকদের বঞ্চিত করেছে কি না কিংবা তার অবমাননা করেছে কি না।
ব্যানার্জির জানতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে করাচিতে অবস্থিত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার এন কে বকশি ২২ ডিসেম্বর একটি চিঠি লেখেন। করাচিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের সাথে কী আচরণ করেছে, তিনি এর বিবরণ দেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ৩ ডিসেম্বর আমাদের ফার্স্ট সেক্রেটারি বিকেল সাড়ে ৫টায় আমার বাসায় ফোন করেন। তিনি আমাকে জানান, পাকিস্তানি বেতারের ঘোষণা মতে, ভারত পাকিস্তানের পশ্চিম ফ্রন্টে আক্রমণ করেছে। দ্রুত চ্যান্সেরিতে উপস্থিত হই এবং অন্যান্য কর্মকর্তাও হাজির হন। ঘটনার সত্যতা জানতে পেরে আমরা গুপ্ত প্রণালীতে লেখা একটি লিংক দিল্লির সাথে বিচ্ছিন্ন করি। অবশ্য বাকি দু’টি লিংক আমরা সচল রাখি। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল নির্ভরশীল এবং মহড়াও যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়েছিল। আমি অন্যান্য অফিসারকে তাদের বাসায় যেতে বলি। আমার সাথে জে এন ভাট ও ক্যাপ্টেন সাইয়াল থেকে যান। নেভাল অ্যাডভাইজার চ্যান্সেরিতে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যখন চ্যান্সেরি ঘেরাও করে রাখে, তখন কাসিফাইড কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং গুপ্ত প্রণালীতে লিখিত দুই লিংকের যোগাযোগব্যবস্থাও ধ্বংস করা হয়। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ রাত সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি পুলিশ তাদের অফিসিয়াল পোশাক পরেই চ্যান্সেরি কমপাউন্ডে ঢোকে। তারা হিন্দুস্তান কোর্ট এলাকায়ও প্রবেশ করে। এখানে ভারতীয় অফিসাররা বাস করতেন। পুলিশ বন্দুকের ভয় দেখিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। মি. ভাটকে তারা প্রবেশের সময় গেটে আটকায়। তিনি তাদের বলেন, কূটনৈতিক মিশনে এই জোরপূর্বক প্রবেশের পরিণতি খুব খারাপ হবে। এ সময় পাকিস্তানের ওই অভিযানের প্রধান জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বলেই তারা এই অভিযান চালাচ্ছেন। ইন্ডিয়া লজে ছিল সহকারী হাইকমিশনের বাসভবন। পুলিশ তার বাসভবনের চার দিক ঘিরে রাখে। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ স্থানীয় ফরেন অফিসে আমি একটি থার্ড পারসন নোট পাঠাই। পাকিস্তানের প্রটোকল অফিসার হামিদ ওই দিন অপরাহ্নে আমার সাথে দেখা করতে আসেন এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত কিছু পরামর্শ আমাকে দেন। চার দিকে ব্যাপক পাকিস্তানি নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে অবরোধের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে স্থানীয় বাজার থেকে প্রতি ভবনের একজনকে তাজা সবজি কিনে আনার অনুমতি দেয়া হয়। এই ব্যবস্থা অবশ্য সন্তোষজনকই ছিল; যদিও আমরা মাসখানেকের রেশন সবাই প্রায় তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু ওষুধের খুব অভাব ছিল।
অবরুদ্ধ অবস্থায় এক ভবনের লোকের সাথে অন্য ভবনের কিংবা বহিরাগতদের সাথে যোগাযোগেরও কোনো উপায় ছিল না।
কোনো পত্রপত্রিকা সংগ্রহেরও সুযোগ দেয়া হয়নি আমাদের। পাকিস্তান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ছিল সৌজন্য প্রদর্শনকারী, কিন্তু ভীষণ একগুঁয়ে ও জেদি। ৮ ডিসেম্বর সুইস কনসাল জেনারেল আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আমাদের দূতাবাস তার কাছে হস্তান্তরের কথা বলেন। তিনি ১২ ডিসেম্বর আবার আসেন এবং ১৩-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে আমাদের দূতাবাস তার অধীনে দেয়ার কথা বলেন। ওই সময়েই আমরা ভবনাদি তাকে বুঝিয়ে দিই।
’৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর শুরুতেই বলা হয়, উপমহাদেশের সামগ্রিক অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা বিশ্বশান্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রস্তাবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সংযত থাকার আহ্বান জানানো হয় এবং জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯-এর আলোকে জীবনহানি বন্ধ এবং আহত ও অসুস্থদের নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্গতদের সহযোগিতা প্রদান, আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি শরণার্থীদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ গ্রহণ এবং মর্যাদার সাথে তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে নিরাপত্তা প্রদানের আহ্বানও জানান হয়।
২৩ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস লন্ডনে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের আলোচ্য বিষয়াদি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবমুক্ত করেছে এবং এই প্রতিবেদন ‘গোপনীয়’ অভিধায় দীর্ঘ দিন অভিহিত ছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দুই মন্ত্রীর বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং প্রথমে আলোচনার সূত্রপাত করেন। তিনি বলেন, যারা পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধকালে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের ব্যাপকতা বেশি নয়; যদিও কিছু লোক ভয়ে ভয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছে। আমরা ভারতীয়রাও অনুমান করেছিলাম, প্রতিশোধপরায়ণতার মাত্রা আরো বেশি হবে। কেননা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ ছিল বিজয়ের উল্লাসে মত্ত। এ দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করেছে। এ কারণেই আমরা জেনারেল নিয়াজি ও সাবেক বাঙালি গভর্নর মালিককে ভারতে নিয়ে যাই। আমাদের ধারণা ছিল, যত শিগগির সম্ভব বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে প্রশাসনের দায়িত্ব বুঝে নেবে। আমরা কোনো প্রশাসক ভারত থেকে পাঠাতে চাইছিলাম না। তবে বিষয়টি খুব স্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের মাসখানেকের জন্য অথবা ছয় সপ্তাহের জন্য প্রশাসনিক সহযোগিতা দরকার ছিল। অবশ্য আমরা কয়েকজন প্রশাসককে সহযোগিতার জন্য পাঠিয়েছিলাম। বাংলাদেশের পুরো পুলিশ প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে স্বভাবতই তারা ছিল বিপর্যস্ত। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, বাংলাদেশে আত্মসমর্পণের পরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ছিল এবং ভুট্টো সেই হতাশাকে কাজে লাগাতে সমর্থ হন। যেমনÑ আত্মসমর্পণের পরও ভুট্টো ‘সংগ্রাম’ অব্যাহত রাখার কথা বলেন, একই সাথে বাস্তবতা মেনে নেয়ার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি অবশ্য জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ যাতে প্রস্তাব গ্রহণ করে, সে জন্য ওইভাবে কথা বলছিলেন। আবার ব্যক্তিগতভাবে ভুট্টো বলতেন, সামরিক বাহিনীই পাকিস্তানকে ধ্বংস করল। ভুট্টো আরো বলতেন, তিনি নতুনভাবে শুরু করতে চান এবং ভারতের সাথে বন্ধুত্বও চান। কিন্তু ভারত মনে করে, ভুট্টোর এই মনোভাব সন্দেহজনক। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোকে ক্ষমতা সংহত করতে হলে ভারতবিরোধী মনোভাব তাকে দেখাতেই হবে। যদিও যুদ্ধবিরতি বিদ্যমান এবং ভুট্টোর পক্ষে ভারতবিরোধিতা ছাড়া আর কোনো পথও নেই এবং তিনি সে রকম কোনো ঝুঁকি নেবেনও না। ভুট্টো উত্তর-পশ্চিমের সীমান্ত নেতা ওয়ালি খানকে মুক্তি দেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত ন্যাপের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। ওই অঞ্চলের লোকদের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে দিতেই ভুট্টো এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেন, প্রতীয়মান হচ্ছে মুজিব বেঁচে আছেন এবং ভুট্টো তাকে জেল থেকে বের করে গৃহবন্দী করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস বলেন, গত কয়েক মাসে ব্রিটিশ সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি অনুরূপ মনোভাব পোষণ করত তাহলে পাক-ভারত যুদ্ধ এড়ানো যেত। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বৈঠকে বলেন, ব্রিটিশদের নীতি হলো ‘ফেয়ারলি ফার্ম অ্যান্ড ফেয়ারলি ফেক্সিবল।’ ভূখণ্ডের ওপর কোনো রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব পুরোপুরি কার্যকর হওয়া এ ক্ষেত্রে জরুরি। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ভারতীয় সেনাবাহিনী অবস্থান করছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ পর্যায়ে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যথাযথভাবে যুদ্ধ করেনি। তারা পুলিশের মতো দায়িত্ব পালন করেছে। আর এই ভূমিকা তাদের প্রকৃত ভূমিকা নয়। তারা যেমন সুসজ্জিত ছিল না, তেমনি সর্বোত্তম স্বরূপেও ছিল না। আমরাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই না। তবে আমরা যত শিগগির সম্ভব বাংলাদেশ থেকে চলে আসব। এ সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সময়সীমা জানতে চাইলে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ব্রিটিশদের বিষয়টি অবহিত করা হবে এবং যাবতীয় অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া হবে। স্যার অ্যালেক জানান, প্রকৃত অবস্থা জানার পর তারা তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করতে পারবেন এবং তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব হবে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ভুট্টোর সাথে বিমানবন্দরে তার কথা হয়েছে। ভুট্টো বলেছেন, পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তাকে সুযোগ দিতে হবে। ভুট্টো জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের নেতাদের সাথে যদি তার সম্পর্ক হয়, ভারত তা কোন দৃষ্টিতে দেখবে? ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভুট্টো যদি বাংলাদেশী নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়তে চান, তাতে ভারতের কোনো আপত্তি থাকতে পারে না; কিন্তু ভুট্টো যদি ইয়াহিয়া খানের মতো ভুল করেন, তাহলে তিনি সফল হবেন না। ইয়াহিয়া খান জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দেশ শাসনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। একটি বিষয় স্পষ্ট, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ আজ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। এখন তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন, ভুট্টোর সাথে বাংলাদেশ কী আচরণ করবে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বার্মা কিংবা অন্য কোনো দেশের সাথে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তা তারা নিজেরাই সাব্যস্ত করবেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সময় জানতে চান, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলার মধ্যে কোনো ধরনের কনফেডারেশন গঠনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশী নেতারা স্বাধীনভাবেই থাকতে চাইবেন; কিন্তু কোনো দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে তো চাইতেই পারেন। বাংলাদেশীরা ভুট্টোকে পাকিস্তানের নেতা হিসেবে মেনে নিতে পারে না। পূর্ব বাংলার নুরুল আমীন ভুট্টোর ওপরের পদে অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন। নুরুল আমীন যখন প্রধানমন্ত্রী, ভুট্টো তখন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ফলে প্রতীকী অর্থেও যদি বলি, বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষীণ যোগ্যতা থেকেও ভুট্টো বঞ্চিত।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মুক্তিযুদ্ধকালে চীনের নীতি প্রসঙ্গে জানতে চান। স্যার অ্যালেকের প্রশ্ন ছিল, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে চীন কি বাড়াবাড়ি করেছিল, নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রশ্নে জানান, চীন পাকিস্তানকে প্রচুর অস্ত্র দিয়েছে। চীন এমনও ধারণা দিয়েছিল যে, ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে সৈন্য পাঠাতেও দ্বিধা করবে না। এ কথা চীন বহুবার পাকিস্তানকে বলেছে। কৌশলপূর্ণ কায়দায় এ রকম ধারণা দিতে চীন বেশ দক্ষ; কিন্তু তারা এমনভাবে কথাগুলো বলে, যদি ‘ফিজিক্যালি’ চীন পাকিস্তানের পক্ষও না নেয়, তাদের দোষ ধরার উপায় থাকে না। আর বিভিন্ন কার্যকারণে পাকিস্তান বিশ্বাসও করেছিল যে, চীন তাদের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে। স্যার অ্যালেক জানতে চান, চীন কি ক্ষতিকর সেই অবস্থান থেকে সরে আসবে; না পশ্চিম পাকিস্তানকে সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে আরো তৎপর হবে? ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনের পক্ষে পাকিস্তানকে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করে যাওয়াই সম্ভব? তাদের মতবাদ হলো, অব্যাহত স্ট্রাগল করে যাওয়া। যুদ্ধের শুরুতেই চীনারা হয়তো ভাবতে শুরু করেছিল, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবেই। তবে চীন ভেবেছিল, বাংলাদেশে চীনাপন্থীরা প্রশাসনে ভালো অবস্থানে নিয়োগ পাবেন অথবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ পাবেন। সে কারণেই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠতে উৎসাহিত হয়েছিল অথবা বাংলাদেশের চীনাপন্থীরা যাতে আরো ভূমিকা রাখতে পারে, সেই সুযোগ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছিল।
ওই সময় কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি নিয়েও দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, ভুট্টো ভারতের সাথে সমঝোতার পক্ষে ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অবস্থা তখন মহাবিপর্যয়কর। পশ্চিম পাকিস্তানেও কোণঠাসা হয়ে পড়ে তিনি বাস্তবতা অনুধাবনে সক্ষম হয়ে উঠছিলেন; কিন্তু কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে ভুট্টো আরো বেশি কঠোর মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলেন। ভারতবিদ্বেষে তিনি তখন মত্ত। আর ভুট্টোকে বাতাস দিয়ে যাচ্ছিল চীন।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই পর্যায়ে আমেরিকার মনোভাব জানতে চান। বারমুডা বৈঠকের পর আলোচনা সম্পর্কে স্যার অ্যালেকের কী মনোভাব হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, বারমুদা বৈঠককালে আসলে ভবিষ্যৎ ও প্রবণতা নিয়ে কারো কোনো স্স্পুষ্ট ধারণা ছিল না। ব্রিটেন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করলে আমেরিকা তা গ্রহণ করে। যেমন- পশ্চিম পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমেরিকার বিস্তারিত কোনো ধারণা না থাকলেও আমেরিকা পশ্চিম পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা কামনা করেছিল। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমেরিকা ভুট্টোর সাথেও আলোচনা করেনি।
ভারতকে সাহায্য প্রদান প্রসঙ্গে স্যার অ্যালেক বলেন, এ ক্ষেত্রে মার্কিন কংগ্রেসের মনোভাব ছিল অত্যন্ত কঠোর। তবে আশা করা যাচ্ছে, কিছু দিনের ব্যবধানে মার্কিন প্রশাসন হয়তো তা চালু করতে পারে। অবশ্য মানবিক কারণে এগিয়ে আসার ব্যাপারে মার্কিন মনোভাব ছিল অত্যন্ত ইতিবাচক। বিশেষ করে ত্রাণসহায়তার ক্ষেত্রে। স্যার অ্যালেক বলেন, স্বীকৃতি প্রদান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা ছিল একটা বড় ধরনের সমস্যা। ব্রিটিশদের জন্য তা ছিল সহজ। স্যার অ্যালেক বলেন, উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের স্থিরীকৃত ধারণা ছিল না এবং নিকট অতীতের ঘটনায় আমেরিকা সন্তুষ্টও ছিল না।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে আমরা মোটেই বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করিনি এবং কোনোরূপ মন্তব্য ও অভিমত দেয়ার ক্ষেত্রেও আমরা সংযম অবলম্বন করেছি। আর যুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকাকে অনেক বেশি নিশ্চুপ মনে হয়েছে, বিশেষ করে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে। এটা যদি পুনর্বিবেচনাজনিত হয়, তাহলে আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। আসলে তারা চাননি বিষয়গুলো আরো জটিল হয়ে পড়–ক। ভারতে আমেরিকাবিরোধী মনোভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের পর এই মনোভাব আরো চাঙ্গা হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, একই এলাকায় ব্রিটিশ রণতরী পাঠানোর প্রস্তাব নিয়ে মি. রমলির সাথে আমার কথা হয়েছে। ওই সময় ব্রিটেন যদি রণতরী পাঠাত, নিশ্চয়ই ভারতীয়রা তাতে ভুল বুঝত। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে অনেক অস্ত্রও দিত, তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হতো না। পাকিস্তানকে আমেরিকা যদি অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়, ভারতের তাতে কোনো আপত্তি নেই।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার ধারণা আমেরিকা পাকিস্তানকে মানবিক সাহায্য প্রদানের পাশাপাশি কিছু অস্ত্রও দেবে। তিনি বলেন, ভারতকে আমেরিকার সাহায্য প্রদান খুব সহজে শুরু হবে বলে মনে হয় না। ভারতকে আমেরিকার সহায়তা বিলম্বিত হলে তাদের হয়তো কষ্টের পরিমাণ বাড়বে, কিন্তু ওই সাহায্যের জন্য তারা হাহাকার করছেন না। কিন্তু আমেরিকা যদি পাকিস্তানকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র দিতে শুরু করে, বিশেষ করে ভুট্টো যেখানে বলছেন, তিনি ‘প্রতিশোধ নেবেনই নেবেন’, সে ক্ষেত্রে আমরাও মানবতার খাতে ব্যয়িত অর্থ দিয়ে অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবো। তবে কাজটা মোটেও ভালো নয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন, পশ্চিমাদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়ে চীনের দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়া পাকিস্তানের জন্য বোকামি হয়েছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানতে চান, চীন ও আমেরিকার উপমহাদেশীয় নীতি অভিন্ন কি না। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে না-সূচক জবাব দেন। ব্রিটিশ মন্ত্রী পূর্ব বাংলার পুনর্গঠন, শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রভৃতি প্রসঙ্গ তোলেন। ভুট্টো তাকে বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ভারত যেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশ সরকার হয়তো বিদেশী সাহায্য সংস্থা তার দেশের অভ্যন্তরে ত্রাণসহায়তা প্রদানের বিষয়টি তেমন ভালো চোখে দেখছে না; কিন্তু রেডক্রসকে বাংলাদেশের ভিন্ন চোখেই দেখা উচিত। ব্রিটিশ মন্ত্রী আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে প্রতিহিংসার মতো ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটছে বলেও ভুট্টো তাকে অবহিত করেছেন।
চীন-জাপানের ভূমিকা প্রসঙ্গে ইন্ধিরা গান্ধী
’৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনেক বিষয়ে আলোকপাত করেন। এক প্রশ্নে ইন্দিরা বলেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ছিল তার প্রত্যাশার অনুরূপ। জাপানের ভূমিকা কেমন ছিলÑ তা কি চীনের ভূমিকার অনুরূপ ছিল? জাপান ওই সময় ভারতে অনুদান বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি ভারতের জন্য অবমাননাকর কি না এ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, জাপানের বর্তমান চিন্তাভাবনা বাস্তবোচিত। এখন হয়তো তারা বুঝতে পেরেছে যে, তাদের আগের অবস্থান সঠিক ছিল না। এখন তারা সঠিক পথে এসেছে।
ইন্দিরা বলেন, কয়েকটি দেশ প্রকাশ্য ভারতের সমালোচনা করত যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকার করে রেখেছে। এখন নেপথ্যে তারা বলছে যে, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে আরো কিছু দিন রাখা দরকার। তাদের অনুরোধের মূলে ভাবনা হচ্ছে, তাদের সম্পদ ও লগ্নিকৃত অবকাঠামোগুলো যেন রক্ষা পায়।
এ দিকে ভারত বাংলাদেশ থেকে সৈন্য হ্রাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত এ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, কে প্রশংসা করল, কে সমালোচনা করল এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ভারতের স্বার্থের অনুকূলÑ এমন নীতির আলোকেই আমাদের কর্মপরিধি নির্ধারিত হয়। আমি মনে করি, ভারতের সেনাবাহিনীকে যত শিগগিরই সম্ভব দেশে ফিরিয়ে আনাই যথাযথ পদক্ষেপ। আশা করি শিগগিরই ভারতীয় সৈন্যদের ফিরিয়ে আনা হবে। তবে বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালিদের নিরাপত্তা নিয়ে শুরুতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছিল। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে।
কী ধরনের সাহায্য-অনুদান বাংলাদেশ গ্রহণ করবে? এটা কি সরকার থেকে সরকারে দেয়া হবে নাকি বেসরকারি পর্যায়ে? ভারতের বহু শিল্পপতি কিন্তু অনুদান দিতে আগ্রহী। মিসেস গান্ধী এ প্রশ্নে বলেন, বাংলাদেশ সরকারই সিদ্ধান্ত নিক তারা কী ধরনের সাহায্য চায়।
এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধকালে বহু পুরনো ও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের পাশে দাঁড়ায়নি। তাদের সাথে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে? এ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, কে কী আচরণ করল এ নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। যারা প্রশংসা করেছেন, তাদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এসব নিছক বাহ্যিক ব্যাপার। আমাদের সবাইকে ভারতের স্বার্থের বিষয়টি ভাবতে হবে। ভাবতে হবে বিশ্বশান্তির কথাও। তবে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, আমাদের কার্যক্রমে জনসমর্থন আছে কি না, নাকি আমরা একলা পথ চলছি। একথা বহুবার বলেছি, ভবিষ্যতেও বলে যাবো।
ইন্দিরা গান্ধীকে প্রশ্ন করা হলো, পাকিস্তানের সাথে আলোচনাকালে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি কাশ্মিরে পাকিস্তান অধিকৃত এলাকার সাথে সংযুক্ত কি না। মিসেস গান্ধী বলেন, ভারতের জনগণের আমার ওপর পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান এবং ভারতের জনগণ এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা দাবি করার কথা ভাবে না। বাংলাদেশের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতামূলক প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়া উচিত কি না এক প্রশ্নে ইন্দিরা ওই সাংবাদিককে বলেন, আজ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া বিবৃতিটি পড়েছেন কি? ওই বিবৃতিতে বাংলাদেশের মন্ত্রী বলেছেন, কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন তাদের নেই। তবে যদি তাদের প্রয়োজন পড়ে তখন আমরা তা বিবেচনা করব। ভুট্টো বলেছেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলন করার লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। এ পর্যায়ে শীর্ষ সম্মেলন করা উচিত কি না এবং যদি হয় তার এজেন্ডা কী হবে এ প্রশ্নে ইন্দিরা বলেন, এক পক্ষের সিদ্ধান্তে এই মুহূর্তে এ ধরনের বৈঠক হতে পারে না। আগে পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ব্যাপকভাবে ফিরে আসুক। তখন এসব বিষয় নিয়ে ভাবা যাবে।
আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, যারা আপনাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেছিল, ক্ষমা চাওয়ার শর্তে তাদের দলে ফিরিয়ে আনবেন কি না? ইন্দিরা গান্ধী এ প্রশ্নে বলেন, ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন অবান্তর; কেন না আমি তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করি না। আমি মনে করি, ওইসব অর্থহীন আবেগ মূল্যহীন। জীবনটা যে খুব ছোট, সেই আলোকেই জীবনকে দেখতে হবে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, যারা দলে ফিরে আসতে চাইছেন তারা দলকে শক্তিশালী করবেন কি না এবং আমরা যা করতে চাই, তা সম্পাদনে সহায়তা করবেন কি না।
আরেক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, এ বছর দুইটি ঘটনা ঘটেছে। একটি হলো নির্বাচনে জয়লাভ, আরেকটি যুদ্ধ জয়। হুইচ ইজ ইয়োর ফাইনেস্ট আওয়ারÑ এ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা খুব উপভোগ করি এবং দুইটি ক্ষেত্রই ছিল ঘোরতর চ্যালেঞ্জের। তবে এটাও মনে করি, চ্যালেঞ্জ ছাড়া জীবন পরিপূর্ণ হতে পারে না। একমাত্র আমি যখন মারা যাবো, তখনই তা হবে আমার জন্য ‘ফাইনেস্ট আওয়ার।’
১৯৭১ সালে মহান নেতা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের জন্য ছিল একটি সৌভাগ্যের বছর। আজ রাতে আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাব। কিভাবে স্বাগত জানালে ১৯৭২ সাল ভারতের জন্য আরো সৌভাগ্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হতে পারে? সাংবাদিকের ওই প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, প্রথমত, আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। আসলে ভারতবাসীকে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে এবং আমরা সবাই যে রকম ভারত দেখতে চাই, সে ভারত তৈরি করতে হবে।
আমদানি হ্রাস প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক জানতে চান, হলিউডি ছবিও কমিয়ে দেয়া হবে কি না। কেন না মিসেস গান্ধীর হলিউডি ছবি বেশ পছন্দ। ইন্দিরা বলেন, আমার প্রিয় বিষয় নিয়ে আপনার জ্ঞান দেখে আমি স্তম্ভিত, বিস্মিত।
এক সাংবাদিক বলেন, আপনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চেয়েও জনপ্রিয়। রাজনীতিক বংশীলাল গতকাল এক জনসভায় বলেছেন, নির্বাচন হলে আপনি নিক্সনকে হারিয়ে দেবেন। এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলা হলে ইন্দিরা বলেন, রাজনীতিবিদেরা বেশি কথা বলেন বলেই আমার ধারণা।
ইন্দিরা গান্ধীকে আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশকে বহু দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। এ কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হবে কি না। এসব সাহায্য সহযোগিতার চ্যানেল হবে কিভাবে? যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, স্বাধীনতা লাভের পরও বহু বছর আমেরিকার কপালে স্বীকৃতি জোটেনি। আমার মনে হয় সাত বছর। আমেরিকা ১৬ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পর্ক কিন্তু সব ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সফর করছেন কবে এ প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এ নিয়ে পত্রিকায় অনেক স্থানজুড়ে সংবাদ ছাপা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমার কথা না ছেপে সবার উপকারে আসবে, এমন সংবাদই পত্রপত্রিকায় বেশি ছাপা হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাকিস্তান যে ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে এ জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি উঠেছে। এ ব্যাপারে মিসেস গান্ধীর অভিমত কী। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তান সন্দেহাতীতভাবেই কাজটি করেছে এবং অবশ্যই ভারতকে ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত।
আরেক সাংবাদিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধীকে ওই সাংবাদিক বলেন, আপনি দেশ-বিদেশে এ যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ দিকে পশ্চিমা পত্রপত্রিকা ও পশ্চিমা রাজনীতিকেরা এ যুদ্ধের মধ্যে নৈতিক উপাদান উদঘাটনে ব্যাপৃত ছিলেন। পশ্চিমাদের মনোভাবে কি কিছু ত্রুটি ছিল? পশ্চিমাদের মনোভাবের পরিবর্তন হওয়া উচিত কি না এবং উপমহাদেশের ক্ষেত্রে যা করেছে তা পশ্চিমাদের ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত কি না? এমন প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমরা সহঅবস্থানে বিশ্বাস করি। তবে আমাদের বলা উচিত নয়, অন্য দেশের কী ভাবা উচিত বা তাদের করণীয় কী। যদি না তা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক হয়। আমি মনে করি না যে, মুক্তিযুদ্ধকালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধই একমাত্র নৈতিক যুদ্ধ। পৃথিবীতে বহু যুদ্ধ হয়েছে এবং হবে যার মূলে নৈতিকতা ছিল এবং থাকবে। তবে মনে করি, যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও আদর্শের প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সব বাহিনী এবং তাদের সহযোগী প্যারা-মিলিটারি সংস্থা বিএসএফ ও অন্যদের ভূমিকা ছিল প্রশংসায়। তারা অবশ্য অনন্য একটি কাজ করেছে। যুদ্ধের কলাকৌশল ও স্ট্র্যাটেজি যাদের নখদর্পণে এমন সব অভারতীয়রাও বলেছেন যে, অল্প ক্ষতি করে তারা বিশাল এক জয় ভারতকে এনে দিয়েছে। ঢাকায় অবস্থানরত এক বিদেশী পাইলট যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার মন্তব্য এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। ওই পাইলট আরো বহু যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। তার ভাষ্য হলোÑ আমাদের (ভারতীয়) পাইলটেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে টার্গেটে বোমা বর্ষণে সক্ষমতা দেখিয়েছেন। টার্গেটে বোমা ফেলতে গিয়ে পরিপার্শ্বে তেমন ক্ষতিও হয়নি। ওই বিদেশী পাইলট আরো বলেছেন এমনটি তার জীবনে অভূতপূর্ব; জীবনবাজি রেখে পাইলটদের এমন দক্ষতা প্রদর্শন তিনি এই প্রথম দেখলেন। এ ক্ষেত্রে মনে করি, নৈতিকতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে আমি বলব ভারতীয় সব বাহিনী, জওয়ান ও নেতৃত্বের প্রস্তুতির মহিমা কীর্তন না করে উপায় নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে আসার বিষয়টি মিসেস গান্ধী কিভাবে মূল্যায়ন করেন? বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের চরম মুহূর্তে? ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমার প্রশ্ন হলো কেন সপ্তম নৌবহর এমন একটি ক্রান্তিকালে বঙ্গোপসাগরে পাঠান হলো। আমি মনে করি না, এর পেছনে কোনো সৎ উদ্দেশ্য ছিল। বিবিসির যুদ্ধসংক্রান্ত কভারেজ প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বিবিসি শুনিনি এবং এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। ইন্দিরা গান্ধীকে আরেক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, আগেই বলেছেন চীন সম্পর্কে আপনার ধারণার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর অর্থ কী, চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের প্রত্যাশা আপনি করছেন এবং শিগগিরই সেখানে রাষ্ট্রদূত পাঠানো হচ্ছে? ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এখন নানা দিকে লম্ফঝম্ফ করা যাবে না। আমি জানি না কবে চীনে আমাদের রাষ্ট্রদূত যাবেন তবে, যেহেতু সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের প্রক্রিয়া চলমান, ফলে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশে কবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন এমন প্রশ্নে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে।
ইন্দিরা গান্ধী স্বীকার করেন, বাংলাদেশের কিছু অস্ত্র চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে চলে গেছে। ওই সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, পত্রিকার খবর যদি সত্য হয় তাহলে ব্যাপকভাবে অস্ত্র পশ্চিমবঙ্গে চোরাচালান হয়ে গেছে। কারণ বর্তমানে আমাদের (ভারতের) বহু সীমান্ত চৌকিতে কোনো প্রহরা নেই। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, ওই সব অস্ত্র যেসব দল সহিংস রাজনীতি করছে তাদের হাতে গিয়ে পড়বে। আন্তঃদলীয় সঙ্ঘাতের ফলে ব্যাপকতর হবে। ইন্দিরা গান্ধী অস্ত্র চোরাচালানের বিষয়টি স্বীকার করলেও এটি বড় কোনো সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করবে না বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন এবং তারা অস্ত্রবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী যে বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভারত গঠন করবে কি না এ প্রশ্নে ইন্দিরা বলেন, বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। এখন আর ইস্ট বেঙ্গল বলে কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নাম কি থেকে যাবে? ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এখন আর পশ্চিম পাকিস্তান বলে কিছু নেইÑ ওটা এখন পাকিস্তান। আর নতুন একটা দেশের অভ্যুদয় ঘটেছেÑ সেটা ‘বাংলাদেশ’।
সুইস দূতাবাসের কঠোর চিঠি
সুইস রাষ্ট্রদূত বলেন, যুদ্ধবন্দীদের প্রসঙ্গ উঠলেই সুইজারল্যান্ডের ভূমিকার কথা স্মরণ করতে হবে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সৈন্যরা অষ্ট্রিয়ায় জার্মানিদের হাতে বন্দী ছিল। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রটেকটিং পাওয়ার জার্মান সরকারকে যুদ্ধবন্দীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য অনুমতি চাইতে পারত। শরণ সিং বলেন, যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে রয়েছে দু’টি ক্যাটাগরিÑ একদল সিভিলিয়ান বা বেসামরিক, আরেক দল সশস্ত্র বাহিনী। এই বন্দীরা আত্মসমর্পণ করেছে একটি যৌথ কমান্ডের কাছে। আর আত্মসমর্পণের স্থান ভারত নয়। এ ক্ষেত্রে আইনগত বিষয়টি আমরা সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করে দেখব। মনে রাখতে হবে, জেনেভা কনভেনশনের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেননা ইসলামাবাদ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ভারতের সুইস দূতাবাস ভারত সরকারকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় একটা চিঠি দেয় ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি। এই এইড মেমোরিতে বাংলাদেশ সম্পর্কেও ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য উত্থাপন করে সুইস দূতাবাস। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার পরিস্থিতিতে জেনেভা কনভেনশনের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সুইস দূতাবাস একটি চিঠি দেয় ভারত সরকারকে। তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনের ১২৬ ধারা উল্লেখ করে সুইস দূতাবাস বলে যে, প্রটেকটিং পাওয়ারের প্রতিনিধি অথবা ডেলিগেটদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কোথায় যুদ্ধবন্দীদের রাখা হয়েছে অথবা তাদের সমাহিত করা হয়েছে, তা জানা। কোনোমতেই এই প্রতিনিধিদের এসব স্থান পরিদর্শনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনীয় অবকাঠামো পরিদর্শনে সাময়িকভাবে তাদের বিরত রাখা যাবে, তবে স্থায়ীভাবে নয়। ভারত তার জাতীয় নীতির আলোকে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সার্বভৌম সিদ্ধান্তের অনুবর্তী হয়ে এই সিদ্ধান্ত কি না, সুইজারল্যান্ড তার বিচার করছে না। একই সাথে আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ করেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের মাত্র কয়েক দিন আগে সূচনা হয়েছে এবং পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের ভূখণ্ডের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার থেকে সরে আসেনি। পাশাপাশি, এখনো বাংলাদেশে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী অবস্থান করছে। সে ক্ষেত্রে বিবেচনা করা কঠিন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কবে নাগাদ দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে; বিশেষ করে প্রধান প্রধান এলাকাগুলোতে। আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি খুবই জরুরি। চূড়ান্তভাবে আন্তর্জাতিক সমাজ এমনটাই মূল্যায়ন করে। অনেক দেশই মনে করে, বাংলাদেশ সার্বভৌম নয়। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক যে অভিধায়ই চিহ্নিত করা হোক না কেন বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী দখলদার বাহিনী হিসেবেই টেকনিক্যালি বিবেচিত হচ্ছে।
ভারত যতই যুক্তি দেখাক, ’৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগেই।
’৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি নয়াদিল্লির সুইস রাষ্ট্রদূতকে ভারত একটি কড়া চিঠি দেয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ভারতে পাকিস্তানের স্বার্থ এবং পাকিস্তানে ভারতের স্বার্থ দেখভালের জন্য সুইজারল্যান্ড ’৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রটেকটিং পাওয়ার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছে। ভিয়েনা কনভেনশনের কূটনৈতিক সম্পর্কের আলোকে এই নিয়োগ। ’৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর নিয়োগ পাওয়ার মূলে ছিল এ দিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল। কেননা ভারত এ দিনই স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সুইস সরকার রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ করা হয়। এইড মেমোরির ৫ নম্বর ধারার ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হয়েছিল, ওই ধারায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এইড মেমোরির ৬ ও ৮ নম্বর অধ্যায়ের ব্যাপক সমালোচনা করে বলা হয়, ভারত বাংলাদেশকে কবজা ও দখল করেছে এবং ভারত কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলেই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব বিদ্যমান। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুইস দূতের ওই এইড মেমোরি ভারত ও বাংলাদেশের জন্য চূড়ান্ত অপমানজনক। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ভারত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের সহায়তা প্রদান। পাকিস্তান বাহিনী যৌথ কমান্ডের অধীনে আত্মসমর্পণ করেছে। একই সাথে, আত্মসমর্পণের প্রথা অনুযায়ী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ তার নিজ ভূখণ্ডই অধিকার করেছে। ভারত বাংলাদেশ দখল করেনি। সুইস এইড মেমোরির জবাবে ভারত তার চিঠিতে উল্লেখ করে, সবাই অবগত যে, কোনো উসকানি ছাড়াই ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে এবং ভারত যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা আত্মরক্ষার্থে। ভারতীয় নোটে আরো বলা হয়, ’৭১ সালের উপমহাদেশের ঘটনায় মোট পক্ষ তিনটি। একদিকে ভারত ও বাংলাদেশ; আরেক দিকে পাকিস্তান। বাংলাদেশ সরকার ১৩ ডিসেম্বর ঘোষণা দিয়েছে যে, জেনেভা কনভেনশনের প্রতি তারা শ্রদ্ধা দেখাবে। ভারত ও পাকিস্তান জেনেভা কনভেনশন যথারীতি মেনে চলছে।
’৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার একটি এইড মেমোরি দিয়েছিল। এর কপি দেয়া হয় বিভিন্ন দেশের সরকারকে। ’৭১ সালের ঝঞ্ঝা-বিুব্ধ সময়ে যেসব পাকিস্তানি নাগরিক ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদের নিয়ে এই বার্তা। এতে বলা হয়, পূর্বপাকিস্তানের এই বিপর্যস্ত সময়ে বহু পাকিস্তানি নাগরিক ভারতে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, চা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যাংক কর্মকর্তা প্রমুখ। বার্তার সাথে ওই সব পাকিস্তানির একটি তালিকা দিয়ে বলা হয়, এটি অপূর্ণাঙ্গ তালিকা। প্রকৃত তালিকা ও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। বার্তায় বলা হয়, ইসলামাবাদে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তালিকার এসব পাকিস্তানি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হয়ে ভারতীয় জেলে রয়েছেন। মানবিক কারণে পাকিস্তান ভারতকে তাদের মুক্তিদানের আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, এসব পাকিস্তানি অপরাধী নন এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারতীয় আইনও লঙ্ঘন করেননি। ভারত এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কোনো অনুরোধেই সাড়া দিচ্ছে না। এমনকি তারা কে কোথায় আছেন সে ব্যাপারেও কোনো তথ্য দিচ্ছে না। এ দিকে পাকিস্তানে এসব ব্যক্তির সন্তান-স্বজনেরা খুবই উদ্বেগের মধ্যে কালাতিপাত করছেন।
ডিপি ধর-কোসিগিন বৈঠক
১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পলিসি প্লানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর প্যারিসে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চুম্মানের সাথে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে ফ্রান্সে ভারতের রাষ্ট্রদূত ডিএন চ্যাটার্জি উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের আলোচ্যসূচির ভিত্তিতে তিনি একটি রিপোর্টও তৈরি করেন এবং রিপোর্টটি ‘টপ সিক্রেট’ অভিধায় চিহ্নিত ছিল।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের বেসামরিক কর্মকর্তা ও পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দীরা ভারতের হেফাজতে কেমন আছে তা জানতে চান। পাকিস্তান তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ডিপি ধর বলেন, যুদ্ধবন্দী নিয়মিত সৈন্যরা খুবই ভালো আছে। এমনকি জেনেভা কনভেনশনে বন্দীদের প্রতি যে ধরনের আচরণ করতে বলা আছে তার চেয়েও ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে। বেসামরিক কর্মকর্তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকায় তাদের বাংলাদেশের হাতে প্রত্যার্পণ করা হয়েছে। ডিপি ধর বলেন, পাঁচ ডিভিশন পাকিস্তানি সৈন্য বন্দী রয়েছে। এ নিয়মিত সৈন্যদের মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত পাঠালে তারা আবার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। পাকিস্তানের সাথে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই সব বন্দীকে ফেরত দেয়া যাবে না। পাকিস্তানি সৈন্যরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বাংলাদেশে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশও একটি পক্ষ। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে শুধু ভারত পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
ভারত পাকিস্তানের মধ্যে কি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব? ডিপি ধর বলেন, দৃষ্টিকটূ সামরিক অভিযান ভারতের কাম্য নয়। ভারত পাকিস্তানের কোনো ভূখণ্ডের প্রতি লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই। ভারতবাসী উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রীতি চায়। ডিপি ধর বলেন, ভারত বিভক্তির পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, বর্তমান পর্যায়ে তা চিহ্নিত করে শান্তি আলোচনার আলোকে এর সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, ভারত একটার পর একটা যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না এবং এই উপমহাদেশে অন্তত এক দশকের জন্য একটা শান্তি চুক্তি হওয়া জরুরি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার প্রসঙ্গটি তুলতেই ডিপি ধর তা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নাকচ করে দেন। ডিপি ধর বলেন, তার কাছে যে বার্তা রয়েছে তাতে অনুমিত হচ্ছে, ভুট্টো দিল্লি যেতে চান। তবে ওই বার্তার প্রথমাংশ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় বিদ্যমান। চুম্মান এই খবরে বিস্মিত হয়ে বলেন, এতে মনে হয় ভুট্টো একটা অর্থপূর্ণ আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে চান। ধর বলেন, ভারতের বিধান সভাগুলোর আসন্ন নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এখন যারপর নাই ব্যস্ত। পাকিস্তানে ভুট্টোর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে নাকি ধ্বংসপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে ভুট্টোকে পরিচালনা করছে, আমি নিশ্চিত নই। ডিপি ধর বলেন, ভুট্টো কেন সামরিক শাসন প্রত্যাহার করছেন না? তিনি নিজে কোনো সামরিক কর্মকর্তা নন। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হলেন ভুট্টো। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে থাকা তার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চুম্মান উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান। ডিপি ধর বলেন, গণতন্ত্র ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ছাড়া পাকিস্তানের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, পাঠান, বেলুচ ও পাঞ্জাবের বিশাল অংশে অসন্তোষ বিদ্যমান। সামরিক শাসনের ফলশ্রুতি হলো দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তান। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র আছে বলেই ভারত এখনো অখণ্ড।
ডিপি ধর এক সময়ে পাকিস্তানের কাছে বিপুল অস্ত্র বিক্রয়কারী দেশ ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান সুযোগের সদ্ব্যবহার করে চীন ও পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের সাথে বিরোধে বা যুদ্ধে জড়াবে কি না। চুম্মান বলেন, তিনি মনে করেন না চীন ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু করবে। চীন সরবে কথা বলে বটে কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া সব সময়ই দূরদর্শী। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মাখামাখির কারণেই চীন ভারতের ওপর চটা। ডিপি ধর বলেন, ফ্রান্স সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাথে কী করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে? চুম্মান বলেন, আসলে রাশিয়ার সাথে কোনো চুক্তিতে তারা আবদ্ধ হয়নি। ডিপি ধর বলেন, রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই চীন ভারতের প্রতি বিরক্ত। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরামর্শ দেন, ভারত যদি তার জোট নিরপেক্ষ নীতি সমুন্নত করে তাহলে চীন নিশ্চয়ই অনুধাবনে সক্ষম হবে যে, ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার চুক্তি তাদের বিরুদ্ধে নয়।
১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক পলিসি প্লানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের মধ্যে একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মস্কো প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময় ভারতকে ব্যাপক সমর্থন দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সঙ্গত কারণেই এই বৈঠকটি ছিল উষ্ণ আতিথেয়তায়পূর্ণ। মস্কোতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের বিবরণী দীর্ঘ দিন টপসিক্রেট অভিধায় চিহ্নিত ছিল।
উষ্ণ করমর্দন শেষে চেয়ারম্যান কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, এত দিনে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গেছে। ডিপি ধর বলেন, আমাদের দুঃসময়ে আপনারা যে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তার কোনো তুলনা হয় না। ডিপি ধর ইন্দিরা গান্ধী প্রদত্ত একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু বিমান না আসায় চিঠিটি এখনো পৌঁছেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে কোসিগিনকে মিসেস গান্ধীর লেখা একটি চিঠির কপি তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন বলে জানান এবং বলেন, ওই চিঠির মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী আপনার কাছে কিছু পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা চেয়েছেন।
কোসিগিন বলেন, শুরুতেই আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। এর অর্থ, আপনিও আমাকে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন। আপনি জানেন, শিগগিরই শেখ মুজিবুর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে আসছেন। আপনার প্রধানমন্ত্রী তার চিঠিতে লিখেছেন, শেখ মুজিবের সাথে যেন আমি কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু মিসেস গান্ধী তার চিঠিতে উল্লেখ করেননি, কোন বিশেষ বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করব। শেখ মুজিব ’৭২ সালের ১ মার্চ মস্কো আসছেন। এ ক্ষেত্রে আপনাদের স্বার্থের অনুকূলে যায় এমন বিষয়গুলো আমার জানা থাকলে মুজিবের সাথের বৈঠকটি আরো ফলপ্রসূ হতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং শেখ মুজিবের সাথে বৈঠকের আগেই আমার তা জানা জরুরি। কোসিগিন ডিপি ধরের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করে বলেন, আপনার যদি মনে হয় শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো অপূর্ণতা রয়েছে, তাও আপনি আমাকে অবহিত করতে পারেন। কেননা বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনি পূর্বাপর ভালো জানেন। বলতে গেলে, আপনি বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ।
কোসিগিন বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর চিঠির একেকটি পর্যায় ব্যাখ্যা করছি। ইন্দিরা সম্পর্কের উন্নতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমি বলব, বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত যেন সমন্বয় করে। এতে আমাদের কার্যক্রমের একটা ধারাবাহিকতা থাকবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত মি: পোপোভ মাত্র ঢাকা থেকে দেশে ফিরেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কথা বলে এসেছেন। রাষ্ট্রদূত সে বিষয়ে আমাদের অবহিত করবেন এবং অবশ্যই আমরা তা বিবেচনা করব।
মিসেস গান্ধী ভুট্টো এবং পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। তিনি এ কথাও লিখেছেন যে, রাষ্ট্রদূত পোপোভ তার প্রত্যাশার বিষয়টি আমাকে অবহিত করবেন। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে আপনাকে এ ব্যাপারে এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলার নেই। ভুট্টো বলেছেন, ভারতের সাথে তিনি আলোচনায় আগ্রহী। মিসেস গান্ধী জানতে চেয়েছেন, ভুট্টোর এই বিবৃতি আমরা বিশ্বাস করি কি না। ভুট্টোর ওই বক্তব্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উত্তর দেয়া কিংবা আমরা তা বিশ্বাস করি কি না, বলা খুব মুশকিল! কিন্তু আমরা যদি ভুট্টোর ওই ভাষ্য পর্যালোচনা করি তা হলে পাকিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো। কোসিগিন বলেন, ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার লিখেছেন, পাকিস্তানে ভুট্টোর সমস্যাটা তিনি বোঝেন। আসলে প্রথমেই পর্যালোচনা করা উচিত এবং তার মধ্য থেকে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে। প্রথমেই উত্তর খুঁজতে হবে, আমরা কি ভুট্টোকে রাখতে চাই নাকি তাকে পাকিস্তানে দেখতে চাই না? প্রশ্ন হলো, ভুট্টোর উত্তরসূরি কে হবেন, তার উত্তরসূরি কী তার চেয়ে ভালো হবেন না আরো খারাপ কেউ হবেন? কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর আপনিই ভালো দিতে পারবেন, কেননা পাকিস্তান পরিস্থিতি আপনিই সম্যক অবহিত ও ঘটনা প্রবাহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও আপনি লক্ষ করে চলেছেন।
কোসিগিন বলেন, আপনি জানেন যে, অতীতে ভুট্টো নিজেকে একজন কঠিন ও জটিল লোক হিসেবেই প্রতিপন্ন করেছেন। তাসখন্দ চুক্তির পর তার মন্তব্য ভারতকে যারপর নাই বিরক্ত করেছে। ভুট্টোর ভাষাও পরিশীলিত ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার আসনে বসার পর তার ভাষা বদলে গেছে। ভুট্টো চীনসহ কয়েকটি দেশে গেছেন। আবার ওই সব স্থানে তার বিবৃতির ধরন ছিল ভিন্নরকম। তার বিবৃতির ভাষা যাই হোক না কেন, তিনি বুঝে গেছেন যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অঙ্গীভূত করা আর সম্ভব নয়।
ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি একটা স্থিতিশীল পাকিস্তান চান। এই পাকিস্তান হবে ভারতের জন্য বন্ধুসুলভ। কিন্তু পাকিস্তানে ফের যদি সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়, তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। যাহোক, বাস্তবতা হলো পাকিস্তান আজ আগের চেয়ে কম আয়তনের একটি রাষ্ট্র। কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, প্রগতিশীল শক্তির উত্থানের কোনো খবর হয়তো আপনার জানা আছে। কিন্তু পাকিস্তানে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। কোসিগিন বলেন, ভুট্টোর প্রধান কাজ হলে যুদ্ধবন্দী ও অন্তরীণ ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনা। কেননা এই ইস্যুতে পাকিস্তানি জনগণ উত্তপ্ত হয়ে আছে। তা ছাড়া ভুট্টোর বিকল্প কোনো নেতার সম্ভাবনা এখনো যেহেতু অনুপস্থিত, সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার সাথেই কথা বলবে। ভারতেরও উচিত ভুট্টোর আন্তরিকতা দেখার জন্য তার সাথে সরাসরি কথা বলা। কোসিগিন বলেন, ভুট্টোর সাথে আলোচনা দু’ভাবে হতে পারে। অবশ্য ভারতের পরামর্শ হলো আলোচনা সরকারপ্রধান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, চিফ অব স্টাফ, পররাষ্ট্র অথবা প্রতিরক্ষা সচিব পর্যায়ে হতে পারে। আমরা মনে করি, সরকারপ্রধান অথবা তাদের কনফিডেনসিয়াল ব্যক্তিগত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আলোচনা হতে পারে। তবে ভারতের ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তা হলো পাকিস্তানের সাথে প্রথমেই সাক্ষাৎ করা। এতে একে অপরকে বুঝতে পারবে এবং কে কোথায় অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর তা অনুধাবনে সক্ষম হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে সরকারপ্রধানদের মধ্যে আলোচনার পথ অনেক সুগম হবে। আমরা ভারতকে এটা পরামর্শ হিসেবে বলছি না, এটা আমাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গি। তবে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক নেতাদের মধ্যে কিছুতেই আলোচনা হওয়া উচিত নয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে শুধু তর্ক-বিতর্ক বাড়বে এবং কতক্ষণ এই বিতর্ক চলবে, তা আন্দাজ করা কঠিন। আর সচিবপর্যায়ে বৈঠক তো হওয়াই উচিত হয়। সচিবপর্যায়ের বৈঠক শীর্ষপর্যায়ের বৈঠক আয়োজনে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।
কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রী চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ভুট্টোর কথার মধ্যে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। একেক সময় তিনি একেক কথা বলেন। কিন্তু আলোচনা ছাড়া সমস্যা সমাধানের পথ নেই। আমি মনে করি, ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টোর মধ্যে বৈঠকের সূত্রপাত হওয়া উচিত। এই বৈঠক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্ব পাবে। একই সাথে এই আলোচনায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান, জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি, যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে দেয়া, এমনকি কাশ্মির নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, ভুট্টোর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক মনোভাবে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু মার্চের শেষ ছাড়া আমরা কোনোভাবেই ভুট্টোকে সময় দিতে পারব না।
কোসিগিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা আমার কাছে এখনো অস্পষ্ট। ওই দুই দেশ ভুট্টোর মনোভাব পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখতে পারে। ভুট্টোর পক্ষে আমেরিকা ও চীনের কথা না শোনা কঠিন।
মুজিব মুক্তিতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকা
কোসিগিন এ সময় ভুট্টোর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। ভুট্টো নিজেকে স্থিতিশীল ও ঝুঁকিমুক্ত মনে করছেন কি না, এ ছিল প্রশ্ন।
ডিপি ধর বলেন, চীন ও আমেরিকা যত দিন সামরিক জান্তাকে উসকানি দিয়ে যাবে, তত দিন ভুট্টোর মানসিক অবস্থায় স্থিতিশীলতা আসবে না। কোসিগিন জানতে চান, চীন ও আমেরিকা ভুট্টোকে নিয়ে সন্তুষ্ট কি না। ধর বলেন, ভুট্টো হলেন যখন যেমন তখন তেমন। তার পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। সহযোগীর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়ার অদ্ভুত ও সহজাত ক্ষমতা ভুট্টোর রয়েছে। উন্নত ব্যক্তিত্বের কোনো ছোঁয়া তার চরিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্যারিসে বৈঠকের সময় বলেছি, পশ্চিমাশক্তি পাকিস্তানের সামরিক এলিটদের দুই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র বিনা পয়সায় দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা এক মস্তভুল।
এসব অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে ওরা ক্ষমতায় থাকার জন্য পাকিস্তানের শাসন কাঠামোকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজাতে চাইবে। এরা ভারতের বিরুদ্ধাচরণ যেমন করবে, তেমনি অহর্নিশ ভারতের প্রতি বিষোদগার করতে থাকবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করবে। এদের সবারই উদ্দেশ্য হলো, ভারতের উন্নয়নকে রুখে দেয়া। তবে আশার কথা হলো, পাকিস্তানে এমন একটি শক্তির উত্থান ঘটছে যারা সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মরিয়া। এ প্রসঙ্গে পাখতুনিস্তান, বেলুচিস্তান এমনকি পশ্চিম পাঞ্জাবের কথা উল্লেখ করব। ওই এলাকার বাসিন্দারা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। আমরা এ শক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানও একদিন ভাঙবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো রাশিয়ার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছেন যে, রাশিয়াও পশ্চিম পাকিস্তানকে ভাঙতে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। ডিপি ধর কোসিগিনকে আরো বলেন, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্রতী, সেখানে চীন ও আমেরিকার নীতি এর ঠিক বিপরীত। আমেরিকা পাকিস্তানে আবার অস্ত্র সরবরাহ করতে যাচ্ছে। এতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছি, চীন পাকিস্তানে বিপুল অস্ত্র সরবরাহ করতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের দুই বা তিন ডিভিশন সৈন্যকে রণসাজে সজ্জিত করার মতো অস্ত্র দিচ্ছে চীন। আর এভাবে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাকিস্তান যে নতুন অভিযানে নেমে পড়বে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আমরাও আমাদের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল মানেক’শকে এ কারণেই মস্কো পাঠাচ্ছি। তিনি আপনার দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করবেন এবং পাকিস্তান যাতে নতুন করে বিরোধের সূত্রপাত করতে না পারে, সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে মিলে কৌশল অবলম্বন করবেন। তবে পাকিস্তান যদি সত্যি সত্যি নতুন করে যুদ্ধের পাঁয়তারা শুরু করে, সমুচিত জবাব দিতে ভারতও প্রস্তুত।
ডিপি ধর বলেন, ভারতের মূল্যায়ন হলো, পাকিস্তান এপ্রিলের শেষ দিকে অথবা মে মাসের প্রথমার্ধে ভারতের সাথে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীনের প্রত্যক্ষ সমর্থন আর আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান যুদ্ধে প্রলুদ্ধ হতে পারে। ওই সময়ে উত্তরাঞ্চল দিয়ে যাতায়াতের পথ প্রশস্ত হবে বিধায় পাকিস্তান ওই সময়টাই বেছে নেবে। ডিপি ধর কোসিগিনকে বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভারতের বহু অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন। আর এই অস্ত্র এপ্রিল ও মে মাসের শুরুতেই আমাদের হস্তগত হওয়া দরকার। ভারতের পক্ষে একটিই আশার কথা হলো, পাকিস্তানের একটি অংশের নাগরিকেরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর এবং ভারতের সাথে সাম্প্রতিককালে যে সমঝোতা হয়েছে তার পক্ষে তারা উচ্চকিত হবেন। তিনি কোসিগিনকে নিজে থেকেই আশ্বস্ত করেন, পাকিস্তানের সাথে তাদের যখন শীর্ষপর্যায়ের বৈঠক হবে; সে যখনই হোকÑ তখন অবধারিতভাবে কোসিগিনের সমর্থন নেয়া হবে।
কোসিগিন বলেন, খোলাখুলিভাবে আপনার কাছে জানতে চাইÑ আপনারা কাশ্মির প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী নিয়েছেন? ভারত কাশ্মিরকে জোরপূর্বক দখলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কী নেয়নি। ডিপি ধর প্রশ্ন করেন, কাশ্মিরের কোন অংশ? কোসিগিন বলেন, পাকিস্তানি অংশ; সেখানে ১৫ লাখ লোকের বাস। আরেকটি কথা জানতে চাই, সময় এখন কার অনুকূলে, পাকিস্তান না ভারতের? আপনি কী মনে করেন, আলোচনা বন্ধ হয়ে গেলে তা পাকিস্তানের পক্ষে যাবে, না ভারতের? যদি এই প্রশ্নের উত্তর না দিতে চান আমি আপনাকে জোর করব না।
ডিপি ধর কোসিগিনকে বেশ আস্থার সাথে বলেন, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আস্থার কোনো সঙ্কট নেই। গত তিন বছরের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আপনি নিজেই উপলব্ধি করবেন, একটি মাত্র ঘটনাও নেই যে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কোনো ইস্যুতে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কিংবা প্রতিশ্রুতির অন্যথা হয়েছে। আপনি আমার প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে চলেছেন, তাতে আমি বিস্ময়াভিভূত।
কোসিগিন ডিপি ধরকে বলেন, আমার এই প্রশ্নে আপনি হয়তো অবাক হতে পারেন। কিন্তু আপনি নিজেই বলেছেন, কাশ্মির এমন একটি ইস্যু সেখানে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। এখন হয় এতে ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে অথবা তা কেটে বাদ দিতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝে ভবিষ্যতের ঘটনাবলি নিহিত থাকবে।
ডিপি ধর বলেন, শক্তি প্রয়োগ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় কাশ্মিরের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা ভারতের নেই। এ প্রসঙ্গে জেনারেল আইয়ুব খানকে তাসখন্দ বৈঠকে যে আভাস দিয়েছিলেন আপনাকে তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। আইয়ুব খানকে আপনি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছিলেন, যুদ্ধবিরতি লাইনকে আন্তর্জাতিক বাউন্ডারি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় কি না। আমি মনে করি, দেয়ানেয়ার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাশ্মির পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কোসিগিন বলেন, এখন সমস্যা হলো স্থিতিশীলতার। বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে ৪০টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। যে শক্তি পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে চায়, তাদের সে কাজের কোনো ভিত্তি নেই। যদি তারা ঐক্যবদ্ধও হয় একমাত্র চীন ও আমেরিকা ছাড়া আর কারো সমর্থন পাবে না। কিন্তু কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে ভারত যদি বাড়াবাড়ি করে, তবে শক্তিগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ডিপি ধর কোসিগিনকে বলেন, কাশ্মিরের বর্তমান সীমানা নিয়ে তারা কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না; এটা নিশ্চিত।
কোসিগিন বলেন, যে পন্থা অবলম্বনের কথা ভাবছেন, এটিই সঠিক। অবশ্যই কাশ্মিরে পরিবর্তন আনা সম্ভব, কিন্তু তা যেন যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, আলোচনার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। আমি মনে করি, ভুট্টোও সম্ভাব্য পরিবর্তনের ভয়ে ভীত। ভুট্টো এ ক্ষেত্রে অবশ্যই লাইনমতো থাকবেন, কিন্তু পাকিস্তানে এমন একটি মহল বিদ্যমান, যারা কাশ্মির ইস্যুতে বিরোধ ও কলহ প্রত্যাশা করে।
কোসিগিন বলেন, ভুট্টো সম্পর্কে আপনি যে ধারণা দিলেন, আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত। তবে দয়া করে ভুল বুঝবেন না যে, ভুট্টোর প্রতি আমরা দুর্বল কিংবা আগ্রহী। পাকিস্তান যদি আপনাদের বন্ধুতে পরিণত হয় তাহলেই পাকিস্তান আমাদের বন্ধুত্বের মর্যাদা পাবে, অন্যথায় নয়। ব্যক্তি হিসেবে ভুট্টোর ব্যাপারে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিত্বের প্রতি আমরা আগ্রহী, যিনি শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখবেন। কেননা আমরা উপলব্ধি করি, পাকিস্তানে আবার যদি সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে, পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। কোসিগিন বলেন, পাকিস্তানের মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়; তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে বিুব্ধ লোকের সংখ্যাও কম নয়।
কোসিগিন বলেন, আপনি বলেছেন, দুই বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে দেয়া হয়েছে। আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে এক শ’ বিলিয়ন, কোনো কোনো হিসাবে দুই শ’ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য ও বাস্তবতা হলো, আমেরিকাকে ভিয়েতনাম তাড়িয়ে দিয়েছিল। এ কথাও সত্য, যত দিন সম্ভব ভিয়েতনামে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কোসিগিন বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হওয়াই অপরিহার্য। আর এই আলোচনা হতে হবে তৃতীয় কোনো দেশের সাহায্য ছাড়াই। তবে আলোচনার ক্ষেত্রে যথাযথ সময় একটা বিরাট ফ্যাক্টর। আমি মনে করি, স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা ক্রমেই উজ্জ্বল হবে।
কোসিগিন বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের পর স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ সরকারের শক্তি বাড়াতে আমরা যথাসম্ভব সব কিছু করব। নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ ও ভারতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গভীরতর হবে।
কোসিগিন বলেন, আরেকটি বিষয়ে আমার খুব আগ্রহ। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের কথাই বলব। নিশ্চয়ই বাংলাদেশে ব্রিটেনের প্রভাব বিদ্যমান। অন্যথায়, এটা কিভাবে সম্ভব যে, তারা এত শিগগিরই কমনওয়েলথে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দিতে পারে? ডিপি ধর বলেন, বাংলাদেশে ব্রিটিশ প্রভাব বিদ্যমান, কিন্তু আমি মনে করি না এ কারণেই কমনওয়েলথে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ইংল্যান্ডে বহু বাংলাদেশীর বসবাস এবং পাট ব্যবসায় যুক্তরাজ্যের স্বার্থ নিহিত। ঢাকা সফরকালে তারা যখন কমনওয়েলথে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চাইল, আমি তাদের পরামর্শ দিলাম, আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।
ডিপি ধর বলেন, বাংলাদেশে সিআইএ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে প্রকাশ্যে মদদ দিচ্ছে এবং মাওবাদীরা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং উপমহাদেশে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমনকি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতারণাপূর্ণ কার্যকলাপে আর মিথ্যা আশ্বাসে পাকিস্তানিরা বিরক্ত এবং সেখানেও তাদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বিদ্যমান।
ফিরুবিনের সাথে ডিপি ধরের তাৎপর্যপূর্ণ বৈঠক
কোসিগিন জানতে চান, শেখ মুজিবের মস্কো সফরকালে আমাদের এজেন্ডা এবং আপনাদের প্রত্যাশার মধ্যে সামান্যতম প্রভেদ রয়েছে কি না।
ধর বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ে ফিরুবিনকে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছি। এমনকি বাংলাদেশের নেতাদের সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছি। ফিরুবিন যদি আপনাকে বিস্তারিত বিবরণ জানান, সেটাই উত্তম। অতীতে ফিরুবিনের সাথে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমার মতানৈক্য হয়েছে। অবশ্য দেখা গেছে, ভারতীয় মূল্যায়নই যথার্থ ছিল। আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি, ফিরুবিন আমার একজন ভালো বন্ধু। যা হোক, বাংলাদেশ এখন একটি শিশুরাষ্ট্র। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের নীতিপ্রণয়নকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা সম্ভব।
ডিপি ধর বলেন, সম্প্রতি কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবের মাঝে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ইন্দিরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। মিসেস গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করেন, তার মুক্তি লাভের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এবং ভারত যৌথভাবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে। ইন্দিরা গান্ধী আরো অবহিত করেন, ভারতের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহ ছিল বন্ধুসুলভ একটি বাংলাদেশের, যারা প্রকৃত অর্থেই হবে স্বাধীন জাতি এবং যারা উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবেÑ যা সারা বিশ্বে শান্তির পথ প্রশস্ত করবে। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবকে অনুধাবন করাতে চেয়েছিলেন যে, সব অনুদানই ভালো নয় এবং মন্দ অনুদানের যাঁতাকলে পড়ে পাকিস্তান কী রকম খাবি খাচ্ছিল। মিসেস গান্ধী তাকে এ কথাও বলেছিলেন, সব বামপন্থীই খারাপ নয়। বাংলাদেশের বিপদ হলো চরম ডান ও বামপন্থীর মধ্যে দেশটা অবরুদ্ধ। তিনি বলেন, ভারতের অভিজ্ঞতাও অনুরূপ।
ডিপি ধর কোসিগিনকে অতঃপর বলেন, মোদ্দা কথা হলো, ভারতের এখন অস্ত্রশস্ত্র চাই। আমরা অতীতেও আপনাদের কাছে প্রমাণ রেখেছি, প্রাপ্তির ব্যাপারে আমরা কখনোই বাড়াবাড়ি করি না। আমরা মিনিমামটা দাবি করি। আমরা বেশ কিছু সরঞ্জাম খুইয়েছি, যার শূন্যস্থান অবিলম্বে আমাদের পূরণ করতে হবে। আর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এসব অস্ত্রশস্ত্র আমরা এপ্রিলের শেষার্ধে অথবা মে মাসের প্রথমার্ধের মধ্যেই চাই।
এ সময় কোসিগিন বলেন, আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, অবশ্যই আমরা তা করব। এ সময় ডিপি ধর বলেন, অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রেও যে ঢিমেতেতালা গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ বিষয়টি তিনি উল্লেখ না করে পারছেন না। তিনি বলেন, দ্বিতীয় যে দাবিটি তিনি তুলবেন তা তার নিজের জন্য বিব্রতকর। নানা কারণে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন মন্দায় আক্রান্ত। শরণার্থীদের দেখভাল করতে গিয়ে প্রতিদিন ১০ লাখ পাউন্ড ব্যয় করতে হয়েছে। এ দিকে যুক্তরাষ্ট্র অনুদান বন্ধ করে দেয়ায় নৈতিক অবস্থা আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ‘কিন্তু তা চালু করার জন্য আমেরিকাকে আমরা পা ধরতে যাচ্ছি না। আমেরিকা পিএল-৪৮০ এর অধীনে সব আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে ১৪ দিনের যুদ্ধে আমাদের ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে আমাদের বাজেট প্রণয়নও দুরূহ হয়ে পড়েছে এবং আগামী মার্চেই আমাদের বাজেট উপস্থাপন করতে হবে। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে টাকাকড়ির এই সুযোগ নিচ্ছি না। প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। আমরা ভারতবাসী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং আমরা এমন কোনো অনুরোধ করব না যা আমাদের মর্যাদার সাথে যায় না। কোসিগিন বলেন, আমরা বিষয়টি বিবেচনা করব। ডিপি ধর অতঃপর অতীত ঋণ পরিশোধের জন্য কিছু বাড়তি সময় চান। বৈঠকের শেষপর্যায়ে কোসিগিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কেমন আছেন, তার বর্তমান হালহকিকত জানতে চান। ডিপি ধর বলেন, তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না, ইন্দিরা গান্ধী এত চাপ কী করে সামাল দেবেন। বর্তমানে ইন্দিরা প্রতিদিন বিশাল বিশাল নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিচ্ছেন। তার ওপর যে চাপ বিদ্যমান, তা অবর্ণনীয়। মিসেস গান্ধী দিনের পর দিন কোনো প্রকার বিশ্রাম ছাড়াই এই চাপ সহ্য করছেন।
কোসিগিন বিষয়টি ভেরি ব্যাড বলে উল্লেখ করেন, তার এত পরিশ্রম করা মোটেই সমীচীন নয়। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে তার ওপর যে ধকল গেছে তা তুলনারহিত। শি ইজ এ পারসন অব গ্রেট স্ট্রেংথ। তিনি শুধু তার দেশের সম্পদ নন, সব প্রগতিশীল মানুষের সম্পদ।
ফিরুবিনের সাথে ডিপি ধরের বৈঠক
১৯৭২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে সে দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এনপি ফিরুবিনের সাথে একান্ত বৈঠক করেন ভারতের পলিসি প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডিপি ধর। সে বৈঠকের বিবরণী ‘টপ সিক্রেট’ অভিধায় চিহ্নিত ছিল। বৈঠকের শুরুতেই ডিপি ধর বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে তিনি সোভিয়েত নেতাদের সাথে কথা বলতে চান। ফিরুবিন বলেন, শীর্ষ নেতাদের শিডিউল খুব টাইট। তবে একটি গ্রুপ মস্কোতে ফিরে আসার পর তারা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন।
ফিরুবিন বলেন, পয়লা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান মস্কো আসছেন। সফর ফলপ্রসূ হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে ফিরুবিন বলেন, তার সফরের প্রস্তুতি নিয়ে তারা খুব ব্যস্ত। ফিরুবিন বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও সোভিয়েত নীতি একই। ডিপি ধর তার সর্বশেষ বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার বিষয় ফিরুবিনকে অবহিত করেন। ভারতের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিল। এই সম্পর্ক উভয় দেশকে নিকটে নিয়ে আসবে কি না এমন জিজ্ঞেস ছিল। ডিপি ধর এই সময় কলকাতার সোভিয়েত কনসাল জেনারেলকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, চেয়ারম্যান কোসিগিন যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের আমন্ত্রণ জানান, তা যথোপযুক্ত হবে। ফিরুবিন জানান, কলকাতার কনসাল জেনারেল চেয়ারম্যান কোসিগিনকে বিষয়টি অবহিত করেছেন এবং এই পরামর্শ ছিল সত্যিই দারুণ। ডিপি ধর বলেন, ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম বিদেশ সফর হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। ফিরুবিন বলেন, আমি কৃতজ্ঞ থাকব যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে আরো কী কী বিষয়ে আলোকপাত করা যায় সে সম্পর্কে ধারণা দেন।
ডিপি ধর জানান, তিনি ১০ মাস ধরে বাংলাদেশের নানা ঘটনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, আর একই সাথে আমেরিকা ও চীনের হস্তক্ষেপ ভণ্ডুল করা সম্ভব হয়েছে। আর একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, ভেঙে যাওয়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে প্রতীকী ঐক্য বা সম্মিলনও আজ আর সম্ভব নয়।
ডিপি ধর বলেন, আমাদের উভয় দেশকেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। উপমহাদেশে একটা অপশক্তি আজও বিদ্যমান। ডিপি ধর বলেন, তার এবারকার মস্কো সফরের মূল লক্ষ্য হলো, পাকিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যৌথভাবে কিভাবে এগোতে পারে। আমাদের যৌথ উদ্যোগের মূলে থাকবে যুদ্ধবাজ ও ষড়যন্ত্রকারীদের কিভাবে প্রতিহত করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি একসাথে কাজ করে, স্থায়ী শান্তি সুদূরপরাহত নয়। উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে তার প্রভাব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
ডিপি ধর শেখ মুজিবের মস্কো সফরে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ একটি নবীন রাষ্ট্র। এই সময়কালে সোভিয়েত পরামর্শ ও প্রভাবে বাংলাদেশ অবশ্যই উপকৃত হবে।
ফিরুবিন ডিপি ধরকে বলেন, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। একই সাথে, শেখ মুজিবুর রহমানের মস্কো সফর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সে ক্ষেত্রে ডিপি ধরের পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মুজিবের সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে পারবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং এদের মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থাও জানতে আগ্রহী। পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা কতখানি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং বিরোধীদের শক্তি কতখানি তাও জানা দরকার। পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো কি শুধু কাউন্টার দিয়ে যাচ্ছে, না বর্তমান সরকারকে পদচ্যুত করতে সক্ষম তাও জানা দরকার। ফিরুবিন বলেন, উৎকট স্বদেশিকতা ও চীনের প্রতি দুর্বল চরমপন্থীদের শক্তিটাও অনুমান করা জরুরি।
ডিপি ধর বলেন, প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মনমানসিকতা ও চরিত্র ইত্যাদি বিষয়ে কোসিগিনকে তিনি আগেই অবহিত করেছেন। ফিরুবিনকেও অতীতে তিনি আভাস দিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের বিষয়ে অতীতে নানা সময়ে রুশ নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন; যদিও সেই মূল্যায়নে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা ছিল। ডিপি ধর বলেন, তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে, উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করেছিল, সেই আন্দোলনের আধুনিক সংস্করণ হলো শেখ মুজিব পরিচালিত আন্দোলন। এ কথাও অনস্বীকার্য, সন্দেহাতীতভাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং সে কারণেই সে দেশের মানুষ তার প্রতি পরম ভক্তিশীল। ইদিগামের আলোকে বলছি, এত বেশি অনুসারী যার, তিনি নক্রমা কিংবা সুকর্ণে পরিণত হতে পারেন। অথবা নিজেকে উন্নীত করতে পারেন একজন নেহরু বা লেনিনের মর্যাদায়। ভারতের অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে ইতিবাচক দিক হলো, সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশকে প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো মনোপলি নেই, নেই সঙ্ঘবদ্ধ পুঁজিবাদও। এত দিন পশ্চিম পাকিস্তানিরা এককভাবে অথবা বিদেশীদের হাতে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ব্যাংকের মালিকও বাংলাদেশী নয়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যখন সমাজতন্ত্রের কথা বলে; তা কিন্তু স্লোগানসর্বস্ব নয়। এটাই তাদের বাস্তব অবস্থান। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাও প্রবিষ্ট হলে প্রতিরোধকারীরা তা যেমন প্রতিহত করবে না, তেমনি আদর্শিক বিতণ্ডারও সৃষ্টি করবে না। এ নিয়ে বিরোধীরা ব্যতিব্যস্তও হবে না। একই সাথে রাষ্ট্রীয়করণ নীতি বহাল রাখার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না। পাবলিক সেক্টরের উন্নয়নে নজর দিতে হবে প্রধানত। তবে ভূমি সংস্কারে বাধা আসবে। আওয়ামী লীগের বহু নেতা এবং বহু ন্যাপ নেতাও সাম্যবাদী ধ্যানধারণার বশবর্তী নন এবং জমিও রক্ষার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বিদ্যমান। অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ভূমিহীন কৃষক ও স্বল্প জমির মালিকেরা বরাবর ব্যাপক সমর্থন দিয়ে আসছেন। তারা ব্যাপক ভূমি সংস্কারের প্রত্যাশায় আছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ঘোষণার প্রশংসা করে ডিপি ধর বলেন, দেশে ফিরে তিনি বলেছেন, সরকার হবে ক্যাবিনেট সিস্টেমের, রাষ্ট্রপতি শাসিত নয়। অতীতে এ দেশে রাষ্ট্রপতি সরকার পদ্ধতি ছিল, যা ছিল নগ্ন একনায়কতন্ত্র। শেখ মুজিব যৌথ রেসপনসিবিলিটির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করেছেন। একই সাথে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সংবিধান রচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে স্পষ্ট, তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষপাতী নন।
ডিপি ধর বলেন, বাংলাদেশে এমন কিছু শক্তি ক্রিয়াশীল, যারা এই দেশের ধ্বংস চায় এবং পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়। একটি মহল সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে চায় এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সুসম্পর্ক বিনষ্ট করতে আগ্রহী। এই শত্রুপক্ষ মনে করে, ভারত ও সোভিয়েত স্বার্থ এক সুরে বাঁধা। অতএব এই সম্পর্ক বিনষ্ট করতে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। সিআইএ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে কান্তিকরভাবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। সিআইএ উৎকট স্বদেশিক মতবাদে বিশ্বাসীদের মুসলিম ঘরানার সাথে যুক্ত করে নানা প্রচারণা চালাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কতগুলো প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম দেশ। এমনকি মানবিক সাহায্যের আড়ালে এ মহলটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মানেক শ’কে মিসাইল দিতে চেয়েছিল মস্কো
ডিপি ধর ফিরুবিনকে বলেন, উল্লিখিত ঘটনাবলির আলোকেই সোভিয়েত ইউনিয়নকে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করতে হবে। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রতিক বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন ডিপি ধর। এ বৈঠকে মিসেস গান্ধী শেখ মুজিবের সাথে কতগুলো বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, প্রকৃতপক্ষেই বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলে যারা ধর্ম ও অনুদানের নাশে বাংলাদেশকে পক্ষভুক্ত করে উপমহাদেশজুড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়, তাদের হাতের খেলনায় পরিণত হওয়া যাবে না।
ডিপি ধর ফিরুবিনকে আরো বলেন, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা এবং জামায়াতে ইসলামী, নকশালরাসহ সব প্রগতিশীল দলের মধ্যে সমন্বয় ও সমঝোতা বিদ্যমান। তবে বহু অস্ত্র উদ্ধার বাকি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্য খুব চাপের মধ্যে রয়েছে এবং বাংলাদেশের তরুণসমাজের মধ্যে অধৈর্য লক্ষণীয়। তবে বর্তমানে সব কিছুই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ডিপি ধর বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি আপনি অবগত আছেন। এ সিদ্ধান্ত বেশ কিছু দিন আগেই আমরা নিয়েছি; যদিও ভারতবিরোধী শক্তি মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। আমরা পূর্বঘোষিত তারিখের ১৫ দিন আগেই অর্থাৎ ১৫ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। ডিপি ধর আলোচনার সমাপ্তি টানেন এভাবে : সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অপরাপর সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর উচিত হবে না বাংলাদেশের উন্নয়নে সময়ক্ষেপণ করা। আর সবারই উদ্দেশ্য যেন থাকে ব্যবসার দিকে মনোযোগী না হয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন থাকা।
বাংলাদেশে কী পরিমাণ অবাঙালি রয়েছে ফিরুবিনের এ প্রশ্নে ডিপি ধর বলেন, এই অবাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকদের হয়ে বাংলাদেশে যে কী পরিমাণ অত্যাচার করেছে তা বর্ণনারও অতীত। হিটলারের নৃশংসতাও হার মানিয়েছে। মানুষ যে কত হীনচরিত্রের হতে পারে, এদের না দেখলে তা বিশ্বাস করা যাবে না। এদের বিদেশী শক্তির সহায়ক না বলে ক্রিমিনাল বলাই সঙ্গত। মিস্টার ধর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বলেন, এরা হানাদার বাহিনীর তলোয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি সুশীলসমাজসহ অন্যরাও তাদেরকে বাংলাদেশের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসার ব্যাপারে নিশ্চুপ। বাংলাদেশে এদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এ প্রসঙ্গে ডিপি ধর শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। মুজিব তাদের জীবন ও হামলা থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের তিনি বাংলাদেশীদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেয়ার অঙ্গীকার করেননি। ডিপি ধর বলেন, আটকে পড়া বাংলাদেশীদের বিনিময়ে এদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে হবে।
ফিরুবিন জানতে চান এই বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় কত লোক রয়েছে। ডিপি ধর বলেন, বাংলাদেশে ১৫ লাখ অবাঙালি রয়েছে। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি কর্মচারীসহ প্রায় ছয় লাখ বাঙালি রয়েছে।
মস্কোতে জেনারেল মানেক শ’
১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে ভারতের পলিসি প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধরের সাথে সোভিয়েত জেনারেল স্টাফের সদস্যদের বৈঠক হয়। বৈঠকে ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল মানেক শ’ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে মিত্রদেশ ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শীর্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের মধ্যকার এই বৈঠকটি নানা কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকের বিবরণী ডিপি ধর নিজেই প্রণয়ন করেন এবং ‘টপ সিক্রেট’ অভিধায় এই বিবরণী দীর্ঘ দিন সংরক্ষিত ছিল।
ডিপি ধর লিখেছেন, ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফের সাথে সোভিয়েত জেনারেল স্টাফের এই বৈঠক প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রেচকো মধ্যাহ্নভোজের আগে তাদের সাথে গোপনীয় কিছু আলোচনা সারতে চান। ডিপি ধর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের দুর্দিনে সহায়তার জন্য মার্শাল গ্রেচকোকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমাদের গত ছয়-সাত বছরের বন্ধুত্বের অন্যতম প্রধান সাফল্য হলো ভারত ও সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংখ্যা বৃদ্ধি।
ভারতীয় চিফ অব আর্মি স্টাফ মানেক শ’র দৃষ্টি আকর্ষণ করে মার্শাল গ্রেচকো বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও মদদে পাকিস্তান ক্রমাগত ভারতের বিরুদ্ধাচরণ করে যাচ্ছে। তিনি আশঙ্কা করছেন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব শিগগিরই আবারো প্রকট হতে পারে। এই সময় মার্শাল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলেন, তার বাসভবনের প্রধান কক্ষে মিসেস গান্ধীর একটি ছবি টানিয়েছেন এবং ভক্তিভরে প্রতিদিন তাকে স্মরণ করেন। মার্শাল বলেন, এমন একজন দক্ষ নেত্রী পাওয়া ভারতের জন্য আশীর্বাদ।
তিনি বলেন, একজন সৈনিক হিসেবে তিনি মোলায়েম সুরে কথা বলতে চান না। পাকিস্তান ভারতের জন্য একটা হুমকি। এ পর্যায়ে সোভিয়েত নেতা চীনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, চীনের নৈতিক মান খুব নিচে। সমাজতন্ত্রের মূলনীতি ও আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা চীনের মধ্যে অনুপস্থিত এবং সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও চীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নানা ষড়যন্ত্রের সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। চীন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের বিরুদ্ধেই কাজ করছে না, প্রগতিশীল মানবিকতার বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। চীনই প্রকৃত বিপদ এবং ভারতের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, চীনের ব্যাপারে সদাসর্বদা সতর্ক থাকা।
এই পর্যায়ে মার্শাল ভারতীয় চিফ অব আর্মি স্টাফের দিকে ঘুরে বলেন, চলুন, রাজনৈতিক আলোচনা বাদ দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আমরা দুই সৈনিক কথা বলি। তিনি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সম্পর্ক আরো নিবিড় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দুই দেশের মধ্যে সামরিক জোট গড়ার কথা বলেন। একপর্যায়ে মার্শাল বলেন, চীনের জারিজুরি ও কৌশল নস্যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাহায্যপ্রত্যাশী। তিনি ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বলেন, পাকিস্তান একটা অলীক মূর্তি বৈ কিছু নয়। রুশ মন্ত্রী মার্শাল বলেন, চীন জানে, আগামী ১০-১৫ বছরে সে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ক্ষতিসাধনের শক্তি অর্জন করবে না। কেননা চীনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য চীনকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, যদি চীন কর্তৃক তারা আক্রান্ত হন কিংবা চীন আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, তাহলে তারা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আমাদের প্রতিটি অস্ত্র গর্জে উঠবে এবং চীনকে সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বছরের পর বছর পার করতে হবে। মার্শাল আরো বলেন, চীনের প্রতি এই সতর্কবাণী তিনি তার দেশের দুই হাজার শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার বৈঠকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন।
ডিপি ধর মার্শালকে বলেন, চীনের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে আমরা নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকলেও কোনো উন্নতি হয়নি। ভারতের অমঙ্গল কামনা চীনের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিপি ধর বলেন, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কোনো হুমকিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফরের প্রাক্কালে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। আমেরিকার বদনীতির বিষয়টি কারো অজানা নয়। চীন ও আমেরিকার এই সহাবস্থান ভারত উপমহাদেশে বিশেষ করে এশিয়ায় শান্তি বিঘিœত করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের দুই দেশকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
পার্লামেন্টে ভুট্টোর সে ভাষণ
এই সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেক’শ রুশ মন্ত্রীর মার্শালের কাছে একটি পরামর্শ চান। তিনি বলেন, একজন অতিশয় দক্ষ সৈনিক হিসেবে আমাকে কিছু পরামর্শ দিন। মার্শাল বলেন, পরামর্শ হলোÑ সব সময় নজরদারি তীক্ষè করুন, সব সময় প্রহরা সমুন্নত রাখুন। কখনোই প্রহরা হ্রাস করবেন না এবং ঝিমুনিতে আক্রান্ত বা অসতর্ক হওয়া চলবে না। এই সময় মানেক’শ বলেন, ভারতের যে অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তা তো আপনি জানেন। আমরা অস্ত্র চাই এবং এর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারও করব। এসব আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সংগ্রহ করব। মার্শাল বলেন, চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমি আপনাদের ৫০টি আন্তঃমহাদেশ ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল দেবো। এর মাধ্যমে আপনারা ঝুঁকি সামাল দিতে পারবেন। নিরাপত্তার জন্য আর কী কী আপনারা চান? ডিপি ধর এ সময় বলেন, আমার ভাবতে খুব খারাপ লাগছে, কয়েকটি ট্যাংক পাওয়ার জন্য আমাদের দরকষাকষি করতে হয়। তাও আবার বলা হয়, এখান থেকে কয়েকটা এবং ওখান থেকে কয়েকটা নিয়ে নিন। গ্রেট রেড আর্মি কী ভারতীয় জনগণের জন্য ১৫০টি ট্যাংক, ৫০টি অ্যান্টিওয়ার ক্রাফট দিতে পারে না? মার্শাল বলেন, মিসেস গান্ধীকে বলুন ব্রেজনেভকে বিষয়টি বলতে। তখন ব্রেজনেভ আমাকে ফোন করবেন। তাহলে আমি আপনাকে দেড় শ’ নয়, দেড় হাজার ট্যাংক দেবো। কিন্তু বিষয়টির নিষ্পত্তি ওই উচ্চপর্যায় থেকে হতে হবে।
অতঃপর রুশ নেতা ও সমরবিদ একটি সত্যি ঘটনার বিবরণ দেন। মার্শাল বলেন, বিষয়টি খুবই গোপন। আমেরিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, যার নাম ‘এন্টারপ্রাইজ’। এটি যখন মালাক্কা প্রণালীতে প্রবেশ করে তখন সোভিয়েত পারমাণবিক সাবমেরিন সেটি অনুসরণ করে এবং এন্টারপ্রাইজ অর্থাৎ সপ্তম নৌবহরের চার শ’ মিটার নিচে অবস্থান নেয়। এ দিকে আমেরিকা বিশ্ববাসীকে বলে বেড়ায় যে, তাদের বিমানবাহী রণতরী সোভিয়েত সাবমেরিন থেকে নিজেদের রক্ষায় সক্ষম।
মার্শাল বলেন, যুদ্ধাস্ত্র ও সাজসরঞ্জামই যথেষ্ট প্রয়োজনীয় বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের সময় এসেছে যখন চীনকে ঠেকাতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাপক সমঝোতা জরুরি। কেননা চীনের হামলা যদি প্রয়োজন হয়, যৌথভাবে ঠেকিয়ে দিতে হবে।
ডিপি ধর লিখেছেন, আলোচনা শেষে যখন তারা মধ্যাহ্নভোজে যান, মার্শাল বলতে গেলে তার হাতের ভেতর হাত গলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। এ সময়ও মার্শাল ইন্দিরা গান্ধীর প্রভূত প্রশংসা করেন এবং সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, এই বাহিনী সব সময়ই মিসেস গান্ধীর আকাক্সক্ষামাফিক ভূমিকা রাখবে।
বন্ধুত্ব চাই, নট ইন্ডিয়ান লিডারশিপ : ভুট্টো
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধশেষে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম শীর্ষ বৈঠক শেষ হয়েছিল ভারতের সিমলায় ১৯৭২ সালের ১ জুলাই। প্রায় পাঁচ দিনের এই শীর্ষ বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে পাকিস্তান কিছুই পায়নি ভারতের পক্ষ থেকে। পাকিস্তানের প্রধান দাবি ছিল ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার। কিন্তু তা প্রত্যাখাত হয় বিভিন্ন কারণে। দেশে ফিরে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামাবাদে জাতীয় পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। স্বভাবতই তিনি ভারতের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং স্বদেশেও তার ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছিল।
ভুট্টো পার্লামেন্টে তার ভাষণে বলেনÑ সিমলা চুক্তি নিয়ে তিন ধরনের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। এক দল চুক্তির প্রশংসা করেছেন, দ্বিতীয় দল পুরো চুক্তিকে নিন্দা করেছেন। আরেক দল বলছেন, এটা ভারতের সাথে নতুন একটা অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তান জনগণ চুক্তির যেমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে, তেমনি সমালোচনাও করেছে। তবে সবাইকে বুঝতে হবে, পাকিস্তানের পক্ষে আরো ভালো কিছু করা সম্ভব ছিল না। কেননা, সবকিছুই ছিল ভারতের পক্ষে। আর আলোচনা বৈঠকে তারা যে অনুদার তা বলার অপেক্ষা রখে না। ভারতের হাতে কী কী ছিল? তাদের দখলে ছিল পাকিস্তানের ভূমি। তারা পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তাদের হাতে রয়েছে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার বন্দী সৈন্য। তারা যুদ্ধবন্দীদের বিচারের আওতায় আনারও হুমকি দিচ্ছিল। ফলে ভারতীয় পক্ষ অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আর পাকিস্তানের হাতে কী ছিল? পাকিস্তানে দাঙ্গা অব্যাহত রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ বিদ্যমান। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হাজারো সমস্যা। আমাদের হাতে একটাই ভালো জিনিস ছিলÑ তাহলো পাকিস্তানের জনগণ; দ্য পুয়োর ম্যান অব পাকিস্তান, দ্য নেমলেস ম্যান অব পাকিস্তান, দ্য ফেসলেস ম্যান অব পাকিস্তান। এসব মানুষের দোয়া নিয়েই আমরা পথ চলেছি। আমাদের লক্ষ্যও ছিল স্থির ও আন্তরিক।
ভুট্টো বলেন, সরদার ডেরা গাজী খানের মতো আমি অত উচ্চবংশীয় না হলেও আমার মধ্যেও কিছুটা আত্মাশ্লাঘা কাজ করতে পারে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মানসিকতা নিয়ে ভারতের সাথে সিমলায় তেমন একটা স্বস্তি বোধ না করলেও আমরা ব্যাপক আলোচনায় অংশ নিয়েছি। আমরা একটা চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করেছি। সে চুক্তিতে পাকিস্তান জেতেনি; কিন্তু পরাজিতও হয়নি। মূল কথা হলো, পাকিস্তানবাসী ওই চুক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেছে, জনগণ তা গ্রহণ করেছে এবং আমি মনে করি জনগণ এটা বোঝে। প্রিয় মহোদয়, আমার বন্ধু ডেরা গাজী বলেছেন, নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি এবং পদ-পদবি ও ধন-সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওই সময় তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করেছি। মি. ফারুক এখানে বসে আছেন। সম্প্রতি তিনি হানিমুন থেকে ফিরে এসেছেন। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে তাকে বলতে বলুন, তাসখন্দে আমার ভূমিকা কী ছিল। আমি তাসখন্দে গেছি বিলম্বে। আইয়ুব খানকে তাসখন্দে বলেছিলাম, পাকিস্তানের জনগণ তাসখন্দ চুক্তি মেনে নেবে না। পাকিস্তানে ফিরে আমরা দেখলাম, জনগণ এই চুক্তি নিয়ে বিক্ষুব্ধ। এমনটি তাসখন্দে থাকতেই আন্দাজ করেছিলাম। জনগণ তাসখন্দ চুক্তি মেনে নেয়নি। আজ আমার বন্ধুরা সিমলা চুক্তির বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু আমরা জনগণকে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি, জনগণের সাথে প্রতারণা করা যায় না। জনগণ সিমলা চুক্তি মেনে নিলেও তাসখন্দ চুক্তি মেনে নেয়নি। ভালো ভালো কারণে জনগণ সিমলা চুক্তি মেনে নিয়েছে এবং ভালো কারণেই জনগণ তাসখন্দ চুক্তি মেনে নেয়নি।
ভুট্টো বলেন, জনগণই চূড়ান্তভাবে সার্বভৌম, তারাই বিচারক। জনগণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিদ্যমান। ফলে যত কথাই বলা হোক, জনগণ সিমলা চুক্তি মেনে নিয়েছে। এবার যারা সমালোচনা করছেন, তাদের প্রসঙ্গে আসি। সমালোচনাকেও মূল্য দিতে হবে। সমালোচনায় যেসব শত্রুরা ব্যস্ত, আমি ঠিক ‘শত্রু’ শব্দটি বলতে চাই না কেননা প্রতিপক্ষ তা যথার্থই মনে করেন; কিন্তু সমালোচনার পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে। এই মহলটির উদ্দেশ্য হলো, সমালোচনার মুখে পড়লে আমার সামনে এগোনোর রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যাবে।
এসব বন্ধুকে বলব, ২০ ডিসেম্বর ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর অনুভব করেছি যে, আমাদের জাতি পুরোপুরি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এসব উৎকট স্বাদেশিকতার মানসিকতাসম্পন্ন লোকগুলো বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমাকে মেসেজ দিতেন।
এই দাবির পাশাপাশি তারা ভারতের শর্তাবলি মেনে নেয়ার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন। তারা আমাকে এটা বলেও সতর্ক করেছিলেন যে, ভারতের শর্ত না মানলে পাকিস্তানও খতম হয়ে যাবে এবং ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের মা, বোন ও শিশুদের ধর্ষণ করতে থাকবে। তাদের বলেছিলাম পরাজিত হওয়ার মানসিকতা মন থেকে মুছে ফেলুন। ধৈর্য ধরুন। আবার পূর্ণ শক্তিতে ফিরে যাওয়ার মন-মানসিকতায় ফিরে আসুন।
ওই বিপথগামী লোকদের সিমলা চুক্তি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে বলব। আমাকে বলুন, পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রশ্নে সিমলা চুক্তিতে কোন অনুচ্ছেদে আপস করা হয়েছে। আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেই নয়, সংবাদ সম্মেলনেও বলছি যে, ভারতের মাটিতে অতিথি হয়ে এসে সেখানে বসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবো না। তাহলে সিমলায় নিয়ে বাংলাদেশের সাথে কম্প্রোমাইজ করলাম কিভাবে? বলা হচ্ছে কাশ্মির প্রশ্নে সিমলায় পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তিতে কাশ্মির প্রসঙ্গ ছিল। তাসখন্দ চুক্তির এত পরে কাশ্মির নিয়ে আলোচনায় খুবই আগ্রহ ছিল ভারতের। কিন্তু ভারত সফল হয়নি। এখন বলুন, কাশ্মিরের ব্যাপারে আমরা কিভাবে সারেন্ডার করেছি। সমালোচনা হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘ থেকে আমরা কাশ্মির সম্পর্কিত দাবি তুলে নিয়েছি। আমি পীরজাদাকে আবার বিদেশে পাঠাতে প্রস্তুত। তিনি গিয়ে দেখে আসুন, কাশ্মির ইস্যু আগের মতোই কার্যকর আছে কি না। আপনারা পরীক্ষা করে বলুন, পাকিস্তানের ওপর কোন ক্ষেত্রে ভারতকে কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে? আমরা ভারতকে বলেছি, আমরা তাদের বন্ধুত্ব চাই, নট ইন্ডিয়ান লিডারশিপ। এ কথা বহুবার পুনরাবৃত্তি করেছি। আমি মিসেস গান্ধীকে বলেছি, আপনি কী করে ভাববেন, আপনার নেতৃত্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর আরোপ করার সুযোগ দেয়া হবে? ভুল হোক আর সত্য হোক, এই উপমহাদেশে মুসলমানরা সাত শ’ বছর শাসন করেছে। এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণ আমরা মেনে নেব?
জাতীয় সংসদে আপনারা কেউ কেউ মুসলমানদের জেহাদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। একটি চুক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের জেহাদ ধ্বংস হয়ে গেছে, এমন বক্তব্য অমূলক। আসলে চুক্তির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্পিরিট আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভুট্টোর ভাষণে ‘হাজার বছরের যুদ্ধ’
এই চুক্তি যদি জনগণের বিপক্ষে যেত, জনগণ বিদ্রোহ করত। যদি ইসলামের ইতিহাস বলা শুরু করি, তাহলে তারা হয়তো বলে উঠবে, একজন কাফের কি এ বিষয়ে কথা বলবে। সমালোচকেরা বলেন যে, কৌশলগত লিপা ভ্যালি আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ১৯৬৫ সালে কারগিল পাকিস্তানের হাত ছাড়া হয়ে যায়। অ্যাগেইন কারগিল ওয়াজ লস্ট টু পাকিস্তান। কিন্তু আপনারা কী জানেন, এর বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি? আমরা বিনিময়ে পেয়েছি সম্পূর্ণ চাম্ব সেক্টর। এ দিকে জামায়াতে ইসলামী থেকে আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন, এমন এক সদস্য সম্পর্কে বলব, পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জমি আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। কম দামি না বেশি দামি জমি হাতছাড়া হয়ে গেল, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। জামায়াতের ওই সদস্যের কাছে হয়তো থারপারকার-এর তেমন গুরুত্ব নেই। কেননা থারপারকার থেকে তার বাড়ির দূরত্ব অনেক।
কিন্তু আমার কাছে থারপারকার শুধু নয়; খাইবার থেকে করাচি, এমনকি পাকিস্তানের যেকোনো ভূখণ্ড মূল্যবান। এ রকম জমি ফিরে পাওয়া একটা বিশাল অর্জন। কেননা আমরা আমাদের ভূমি ফেরত পেয়েছি।
এক সদস্য ভারতীয় আগ্রাসনকে রেসপেক্টেবল বলেছেন। এ কী ধরনের কথা। এ কথার কোনো মাথামুণ্ডু বুঝছি না বলে এই বিষয়ে কোনো উত্তরও দেবো না।
একজন বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষয়ে পাকিস্তান সমঝোতা করেছে। স্যার, এটা বিতর্কাতীত পয়েন্ট। দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে শত্রুপক্ষ কখনোই কম্প্রোমাইজ করতে পারে না। সিন্ধুতে এখন কী হচ্ছে? আমরা যদি পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে চাই তাহলে উই মাস্ট অ্যাকসেপ্ট পাকিস্তান। পাকিস্তানকে শ্রদ্ধা করতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অবশ্যই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যের কিছুই বলার নেই। সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা কী? ফ্রান্সের উৎপাতের কারণে ইংল্যান্ড কি কম্প্রোমাইজ করবে? জার্মানি ফ্রান্সের জন্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কারণে? প্রেসিডেন্ট নিক্সন যদি মাও সেতুংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তাহলে কি তাদের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে? নিক্সন যদি কোসিগিনের সাথে বৈঠক করেন, তাহলে কি সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে? চীনের কনসেপ্ট-নীতিমালা কি শেষ হয়ে যাবে! আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। অবশ্যই আমাদের কিছু একটা কনসেপ্ট থাকতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তানের যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে আমরা বহু নজির সৃষ্টি করেছি। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই নির্মম আচরণ করেছি। নজির স্থাপন একটি রাজনৈতিক বিবেচনা; একটা মানবিক সম্পর্কের ব্যাপার এটা; পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিষয় নয়। এটা ভালোবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক। দেশ ভাঙতে পারে একটিই কারণে তাহলো যদি আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নেই। দেশ ভাঙে অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ও শাসনে। দেশ ভাঙে যদি আমরা আমাদের ভূখণ্ডকে ধ্বংস করি এবং নিজের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিই। পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আরো বলেন, অনেকেই সিমলা চুক্তির সমালোচনা করে বলেন, তারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন। যদি তারা প্রতিশোধ নিতেই চান, তা কি এই সময়ে সম্ভব? এই সময় কি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা সম্ভব? আর কখনোই প্ররোচনাকারীদের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। বহু দেশের এভাবে সর্বনাশ হওয়ার কথা বলতে পারি; যা আমি প্রকাশ করব না। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে প্ররোচনাকারীদের ভূমিকা নিয়ে বলতে পারি। প্রেসিডেন্ট নাসেরকে যুদ্ধে নামার জন্য কি অভিযুক্ত করা হয়নি? এই মহলটি পাকিস্তানকে অবিলম্বে ভারতের সাথে আরেকটি যুদ্ধে লিপ্ত দেখতে চাইছে। তারা চায়, পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। তারা এমনটি কেন চায়? তাদের অতীত বিবেচনা করুন, তাহলেই এর উত্তর খুঁজে পাবেন।
ভুট্টো আরো বলেন, সিমলা চুক্তির মাধ্যমে ভারতের সাথে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে যারা মন্তব্য করছেনÑ এ কথা সত্যের অপলাপ নয়। এটা শুধু প্রথম পদক্ষেপ নয়, ফার্স্ট শট। জনগণের ওপরেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে, তারা ভারতের সাথে শান্তি না যুদ্ধ চান। অনেক বলেছেন, পাকিস্তানকে গড়তে আগে ভারতের সাথে শান্তি চাই, পরে প্রতিশোধ। ভারতও পাকিস্তানের মনোভাব নানাভাবে যাচাইয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের জানার খুব আগ্রহ, মুসলমানরা কী চায়। আবারো বলছি, এই মুহূর্তে যারা যুদ্ধের পক্ষে বলছেন, আমি তাদের দলে নই। কেননা আমি জানি, এই মুহূর্তে ভারতের সাথে যুদ্ধ মানে, পাকিস্তানের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।
ভুট্টো বলেন, দ্য মিথ অব ইন্ডিপেনডেন্স নামে বইটি আমি ১৯৬১ সালে লিখেছিলাম। সেখানে কূটনীতির ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। এই হাউজে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব উপস্থিত আছেন। আরো অনেকেই জানেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাজি করাতে আমাকে কি পরিমাণ গলদঘর্ম হতে হয়েছিল। মহোদয়বৃন্দ, অনেকেই আজ বলছেন, তাসখন্দ চুক্তির চেয়ে সিমলা চুক্তি খুব খারাপ। আমি বলব, তাসখন্দ চুক্তির সময় পূর্ব পাকিস্তান আমাদের অংশ ছিল। আরেকটি তথ্য হলো, আমাদের এক পদস্থ কর্মকর্তা তাসখন্দ চুক্তির সময় আইয়ুব খানকে বলেছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীই (ভুট্টো) সঠিক। অন্যরা আইয়ুব খানের পাখার নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই অফিসার আমার পক্ষে বলতে গিয়ে আইয়ুব খানের চুশূল হয়েছিলেন। এ দিকে সিমলা চুক্তির সময় অফিসারদেরই এগিয়ে যেতে বলেছিলাম। আমি আইয়ুব খানের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার পর ওই ভদ্রলোককে তিনি তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মোদ্দা কথা, তাসখন্দ চুক্তিটি পাকিস্তানের পক্ষে অনেক বেশি আনা সম্ভব ছিল। কিন্তু ফিল্ড মার্শাল হওয়া সত্ত্বেও আইয়ুব খান চুক্তির সময় কাঁপছিলেন। তাকে প্রতিপক্ষের চোখ রাঙানিও হজম করতে হয়েছিল। দ্য ফিল্ড মার্শাল ওয়াজ শেকিং। ভুট্টো বলেন, তাসখন্দ চুক্তি করেছিলেন আইয়ুব খান আর সিমলা চুক্তি করি আমি। এই দুই চুক্তির মধ্যে তফাৎ হলো, সিমলা চুক্তির সময় আমরা পাকিস্তানের অর্ধেক হারিয়েছি এবং আমাদের ৯৩ হাজার সৈন্য ভারতে বন্দী। এ দিকে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধবন্দীদের বিচারের কথা এবং পাকিস্তানকে ধ্বংসের কথাও বলা হচ্ছিল। ভারতের লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দ চুক্তির সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন এবং তিনি একটা পথও খুঁজছিলেন।
ভুট্টো তার ভাষণে বলেন, তাসখন্দ চুক্তির সময় ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাবন আমাকে বলেছিলেন, তাসখন্দেই কাশ্মিরের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। আমি তাকে বলেছিলাম, আমাকে যদি এখান থেকে ওখানে সিগারেটের ছাইদানি সরিয়ে নিতে বলা হয়, আমি কিন্তু তা করব না। কাশ্মির সমস্যার সমাধান আমাদের শর্তেই হতে হবে। অতঃপর চ্যাবন শাস্ত্রীর কাছে যান, শাস্ত্রী যান কোসিগিনের কাছে এবং কোসিগিন যান আইয়ুব খানের কাছে। তারা সম্মিলিতভাবে আইয়ুব খানকে বলেন যে, আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো একজন কঠিন লোক। যদি তাকে আলোচনার বৈঠকে রাখা হয়, তাহলে কোনো অগ্রগতিই আশা করা যায় না। ভুট্টো বলেন, অতঃপর আইয়ুব খান আমাদের কাছে এলেন। তিনি ভারতীয় পক্ষকে দেখিয়ে বলছেন, তারা তাকে ‘স্টেটসম্যান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর ভারতীয় পক্ষে আছেন রাজনীতিক। আইয়ুব খান বলেন, ভারতীয়রা বলছে তিনি একাই (আইয়ুব খান) সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। আইয়ুব খান বলেন, শাস্ত্রী তাকে বলেছেন, তিনি (শাস্ত্রী) একজন ুদ্র লোক। তিনি লোকসভার সদস্যদের হাতে পুতুল। কিন্তু আপনি একজন গ্রেটম্যান, মহান শাসক ও মহান রাষ্ট্রনায়ক। আপনি আপনার জনগণ ও জাতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন। ভুট্টো বলেন, কাশ্মির ইস্যুতে মতান্তরের কারণে তিনি আইয়ুব খানের বিরাগভাজন হন। তাকে আইয়ুব খানের রক্তচু সহ্য করতে হয় এবং পরে দেশে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ভুট্টো বলেন, ওই ঘটনার সাক্ষী গোলাম ফারুক। তাসখন্দে আমি যা করেছি, দেশের স্বার্থেই করেছি। ভুট্টো বলেন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে আমরা কেন জিততে পারিনি, সেটা একটি ভিন্ন কাহিনী। আর নজির সৃষ্টির কথা যদি কেউ বলেন, তাহলে বলব তাসখন্দেই এর সূচনা হয়েছিল। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছিল। তাসখন্দে আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম। যদি সিমলায় কাশ্মিরের ব্যাপারে সারেন্ডার করতাম তাহলে সিমলা চুক্তি অন্য রকম হতো। মিসেস গান্ধী বারবার আমাকে প্যাকেজ ডিলের কথা বলেছেন। তার ভাষায় ‘বাস্কেটডিল’ হোক। ডিপি ধর বলেছিলেন, এটা অবশ্যই হবে গোলাপগুচ্ছ। আমি বলেছিলাম, না, একবারে একটা করে গোলাপ চাই। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির ব্যাপার আমি যতবারই কথা বলেছি; ভারত বলেছে কাশ্মির প্রশ্নের ফয়সালা করুন। আমি বলেছি, যতদিন খুশি আপনারা যুদ্ধবন্দীদের আটকে রাখুন।
ভুট্টো বলেন, আমাদের বাস্তবোচিত ভাবনার পথ ধরে এগোতে হবে। জেনেভা কনভেনশনের পেছনে অনুমোদনটা কী? বৃহৎ শক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে জন্মের পর জাতিসঙ্ঘের কয়টা প্রস্তাব কার্যকর হয়েছে? দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরাইলের ব্যাপারে গৃহীত প্রস্তাব কি বাস্তবায়িত হয়েছে? পাক-ভারত সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো কি বাস্তবায়িত হয়েছে? আসলে রাষ্ট্রই চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করে থাকে। ভারত জেনেভা কনভেনশন অগ্রাহ্য করেছে। ভারত জাতিসঙ্ঘের চার্টার অমান্য করেছে। কী ব্যবস্থা নিয়েছে জাতিসঙ্ঘ? জাতিসঙ্ঘ ভারতকে হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মিরকে দিয়ে দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ গোয়া ও পণ্ডিচেরি ভারতকে দিয়ে দিয়েছে। যতই ভারত জাতিসঙ্ঘের সনদ অমান্য করছে, ততই তার ভূখণ্ড বাড়ছে। শুরুতে জাতিসঙ্ঘের ক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের ভরসা ছিল।
ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদানের চাবিটি ইন্ধিরা গান্ধীর হাতে। যদিও জেনেভা কনভেনশনের কথা আমরা বলি, কিন্তু ওরা বন্দী ভারতের হাতে। দে আর নট ইন মাই কাস্টোডি। দে আর ইন হার কাস্টেডি। শি হ্যাজ টু ডিসাইড। আপনি জেনেভা কনভেনশন ইন্দিরা গান্ধীর মুখের ওপর ছুড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি হয়তো তা গ্রহণ করবেন না। হোয়াট ক্যান আই ডু। এ ব্যাপারে বলে কোনো লাভ নেই।
ভুট্টো জাতীয় সংসদে আরো বলেন, যুদ্ধবন্দীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখা যায় না। ভূখণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য দখলে রাখা যায়। ইসরাইল আরব যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দিয়েছে। কিন্তু তাদের এক ইঞ্চি জমিও ফেরত দেয়নি। ভূমি অনেক বেশি পবিত্র। অনেক বেশি স্থায়ী। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখন চলছে যুদ্ধবিরতি। এখন চলছে প্রত্যাহার। তারপরও কেন তারা যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দিচ্ছে না? আমরা অবশ্যই যুদ্ধবন্দীদের ফেরত আনব। আজ না হোক, আগামীকাল তারা অবশ্যই ফেরত আসবে ইনশাআল্লাহ।
জাতিসঙ্ঘ ভারত ও পাকিস্তানের ব্যাপারে ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। নেহরুর সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির একটি চুক্তি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে যে, আজাদ কাশ্মির থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে। পক্ষান্তরে ভারতকে নির্দেশ দেয়, তাদের অধিকৃত কাশ্মির থেকে ‘কিছু’ সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। এখন বুঝে দেখুন, কিছু সৈন্য বলতে কত সৈন্য, তা কিন্তু নির্দিষ্ট নয়। তারাও ব্রিটিশ সরকার কিংবা অন্য কারো সাহায্যে তালগাছটা তাদের করে নিলো। জাতিসঙ্ঘের এই যে একপেশে আচরণ, এর কি বিচার হবে? যারা আগ্রাসী তাদের সৈন্য কাশ্মিরে থাকবে, আর যারা ভিকটিম তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, আমি কায়েদে আযমকে আক্রমণ করছি। কায়েদে আযম মৃত। কাউকে আক্রমণ করছি না। কিন্তু এটাই হলো জাতিসঙ্ঘের হাল-হকিকত।
জাতীয় সংসদে এক বন্ধু বললেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা ২৫ বছর ধরে ভারতের সাথে বিরোধ মেটাবার চেষ্টা চালিয়ে আসছি। প্রিয় বন্ধু, এ কথাও বলব যে, এ ২৫ বছরে আমরা যুদ্ধও করেছি। শান্তিপূর্ণ উপায়ে গত ২৫ বছরে ভারতের কাছ থেকে আমরা কিছুই পাইনি। কিন্তু যুদ্ধ করেও কি আমরা লাভবান হয়েছি? লাভের মধ্যে যা হয়েছে তা হলো, পাকিস্তানের বড় অংশকে আমরা হারিয়েছি। আজ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ভারতে আটক। একই সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত শক্তিশালী। বাস্তবতা হলো, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতের কাছ থেকে আমরা যদি লাভবান হতে না পারি যুদ্ধের মাধ্যমেও কোনো কিছু লাভ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ভুট্টো এমপিদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যুদ্ধ না শান্তি চান? আমি বিষয়টি তরুণদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এই সময়ে যুদ্ধের মতো বিলাসিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ’৭২ সালের ১৪ জুলাইয়ের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট আরো বাড়ানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ ক্ষেত্রে আপনারা কি ভারতের সাথে যুদ্ধে যেতে চান? আপনারা আমাকে উৎখাত করতে পারেন। এতে হয়তো আপনারা সন্তুষ্ট হবেন।
ভুট্টো বলেন, স্ট্রাগল আমাদের জন্য কোনো নতুন বিষয় নয়। ওয়ালী খান সাহেব বলেছেন, সীমান্ত প্রদেশের প্রতিটি শিশুই কী করে বন্দুক চালাতে হয়, তা জানে। ফলে আমরা জানি কী করে শুট করতে হয়। আমরা যদি চাই, তাহলে আমরা অবশ্যই যুদ্ধ করব। আমাদের আত্মোৎসর্গ করতে হলে তা করব। এটা একটি আন্তর্জাতিক অবস্থান। এর থেকে আর ভালো কোনো অবস্থান হতে পারে না।
জাতীয় পরিষদের চেয়ারম্যানকে সম্বোধন করে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেন, ইদানীং ভারতের সাথে হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সাবজেকটিভ কনসেপ্ট। এটা অবজেকটিভ নয়। আমরা হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাবো এবং পাকিস্তানের জনগণ যদি এতে অস্বীকৃতি জানায়, তারা আমাকে পাগলাগারদেও পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু বিষয়টি হলো, পাকিস্তানের জনগণ ধারণাটি মেনে নিয়েছে।
‘হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া’র অর্থ কী? এর অর্থ কি এটাই যে, আমরা সবাই একটা মেশিনগানের পেছনে দাঁড়িয়ে যাব এবং হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাব ভারতের বিরুদ্ধে? এমনকি আমেরিকারও কিন্তু অত অস্ত্র নেই। এ কথার প্রকৃত অর্থ হলো, জাতি তাদের অধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যাবে। রোমান সাম্রাজ্যের পর থেকে মানুষ তো বর্তমান পর্যন্ত তাদের অধিকার আদায়ে যুদ্ধই চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা এই উপমহাদেশে হাজার বছর বাস করব। ভবিষ্যতের আলোকে হাজার বছর কিছুই নয়। কোনো ব্যক্তির পক্ষে শত বছর শাসন করে যাওয়া সম্ভব নয়। হিটলার এমনটি চেয়েছিলেন; কিন্তু ১২ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। সে ক্ষেত্রে এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্ট্রাগল নয়। এটা হলো একটা জাতির স্ট্রাগল, যুদ্ধ। যে জাতি স্ট্রাগলে অনাগ্রহী, তার সাফল্যও নেই।
পাকিস্তানিদের এই যুদ্ধ হাজার বছর ধরে হতে পারে, ১০ হাজার বছর ধরেও হতে পারে। আমি যদি এ বিষয়ে উৎসাহিত নাও করি, একটি জাতি উদ্বুদ্ধ হলে ১০ হাজার বছর স্ট্রাগল করতে পারে।
ভুট্টো তার ভাষণে বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে রাজনীতিকে সোপর্দ করতে হবে। আমরা কি কাশ্মির দখল করিনি? কিন্তু তখন মার্শাল আইয়ুব খান হুনজায় লুকিয়ে ছিলেন। আমরা তাকে খুঁজে বের করেছি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বিপর্যয়ের মূলে ছিল রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, দুর্বলতা ইত্যাদি। সত্যি হলো পাকিস্তান তখন দিল্লি পর্যন্ত সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগিয়ে যেতে পারত। একটি জাতির সামনে সুযোগ; কিন্তু সব সময় দরজার কড়া নাড়ে না। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় আমেরিকা আমাদের যেসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল, এর তুলনা হয় না। মি. নেভিল ম্যাক্সওয়েল তার এক বইয়ে লিখেছেন যে, তিনি পাকিস্তানের জয়লাভ দেখার জন্য আগে থেকেই ব্যাংককে বসেছিলেন। কেননা খুবই অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ছিল পাকিস্তানের এবং ’৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের জয়লাভ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে আমরা কাশ্মির দখলে নিতে পারতাম। কেননা ভারত সীমান্ত থেকে সব সৈন্য সরিয়ে এনেছিল। কিন্তু আপনি যদি সুযোগ হারানÑ তা হলে কেউ আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। ভারত ঠিকই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল।
ভুট্টো বলেন, নেপোলিয়ানকে কেন পছন্দ করি জানেন? কারণ নেপোলিয়ান ছিলেন সর্বশেষ পেশাদার সৈনিক; যিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। পেশাদার সৈনিকরা যুদ্ধে যায় না। একমাত্র বেসামরিক নেতারাই যুদ্ধে লিপ্ত হন।
kaikobadmilan1955@gmail.com