মীযানুল করীম
রাজধানীর একটি সড়কে চোখে পড়ল একটি ডিজিটাল বোর্ড। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে লাগানো। দেড় হালি নেতার ছবি। কোনোমতে ঠাঁই পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ছবিটি। একটু পরই রাস্তার ধারে আরেকটি বোর্ডে পৌনে এক হালি নেতার ছবি থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি পর্যন্ত নেই। অথচ তিনি যে দলের সভানেত্রী, সে দলের অঙ্গসংগঠনের নামেই এসব বিলবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার লাগানো হয়েছে। এগুলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আছে ঠিকই, তবে কোনোমতে কোনায় পড়ে থাকার মতো। আরো অবাক কাণ্ড! অনেক ক্ষেত্রে তার ছবির চেয়ে অঙ্গসংগঠনের ওয়ার্ড বা ইউনিট পর্যায়ের পাতি নেতার চেহারা অনেক বড় করে তুলে ধরা হয়েছে। একটি বিলবোর্ডে অখ্যাত ব্যক্তির ছবি প্রায় ২০ গুণ বড়। বলা যায়, এ যেন ‘আমের চেয়ে আঁটি বড়’। ফার্মগেটের অদূরে বিশাল বিলবোর্ড শোক দিবসের। অথচ এটা দেখে মনে হবে, মুজিব ননÑ দলের একজন তরুণ কেন্দ্রীয় নেতাই বুঝি মুখ্য! যত্রতত্র এই বিপুল প্রচারণার উদ্দেশ্য এবং ব্যয়ের উৎস নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট উপলক্ষে অনেকেই লেখালেখি করেন। অনেক লেখাতেই নতুন নতুন কথা পাওয়া যায়। এর অনেকটা আবেগ কিংবা পরম শ্রদ্ধার কারণে। এ ধরনের তথ্যের সূত্রের উল্লেখ না থাকলেও এগুলো কৌতূহলোদ্দীপক এবং গবেষণা বা অনুসন্ধানের বিষয়। কিছু তথ্য বিস্ময়কর, কিছু তাৎপর্যবাহী বা ইঙ্গিতপূর্ণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবির দৈনিক যুগান্তরে ৪ আগস্ট লিখেছেন (বঙ্গবন্ধুর) নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন ঘটনা। “গ্রামের ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টির চাল সংগ্রহ করলেন। বিক্রীত অর্থ ব্যয় করলেন অসহায় ও গরিব পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার পেছনে। সে সময়েই কিশোর মুজিবের মধ্যে ভবিষ্যৎ নেতা হওয়ার লুক্কায়িত গুণাবলির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।” একই নিবন্ধকার আরো উল্লেখ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু কিছু দিন সাংবাদিকতায়ও যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘ইত্তেহাদ’ কাগজের পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি ছিলেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ৯ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘স্বপ্নদর্শনে বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সভা’। এতে কল্পনা করেছেন, মুজিব ফিরে এসেছেন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য। তবে খোঁজ করে বিমানবন্দর, রেলস্টেশন বা লঞ্চঘাটে তাকে পাওয়া গেল না। অবশেষে সাংবাদিকেরা ‘আবিষ্কার’ করলেন, নেতা মুজিব বুড়িগঙ্গার বুকে ছইওয়ালা একটি নৌকায় বসে আছেন। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মুখে সেই পাইপ। জানা গেল, খুব ভোরে এসে তিনি রিকশায় দিনভর ঢাকা ঘুরে দেখেছেন। এখন নৌকায় করে ফিরে যাবেন টুঙ্গিপাড়ায়।
সাংবাদিকেরা জানতে চাইলেন মুজিবের কাছে, ‘ঢাকা শহর ঘুরে আপনার কী অভিজ্ঞতা হলো?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমার স্বপ্নভঙ্গের অভিজ্ঞতা। সারা জীবন যে স্বপ্ন দেখেছি, যে জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, সে স্বপ্নের ভাঙ্গা টুকরার ওপর শোষণ ও অশ্লীল সমৃদ্ধির কংক্রিটের শহর গড়ে উঠেছে। এ তো সোনার বাংলা নয়, কংক্রিটের বাংলা। এই কংক্রিটের তলায় মানুষের সব মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ববোধ চাপা পড়ে গেছে। লোভ, শোষণ, লুণ্ঠনের এমন দানব চেহারা আমি পাকিস্তান আমলেও দেখিনি।’ সাংবাদিকেরা বললেন, ‘তাহলে এই বাংলাদেশ আপনি চাননি?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না, এই বাংলাদেশ আমি চাইনি। আমি পাকিস্তানের ২৩ পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম ২৩ হাজার বাঙালি পরিবার জন্ম দেয়ার জন্য নয়। এই ২৩ হাজার পরিবার তো পাকিস্তানের ২৩ পরিবারের চেয়েও নির্মম শোষক।’
আগাচৌ আরো লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বললেন, আওয়ামী লীগে এখন মুজিবকোট আছে, মুজিব নেই। গ্রামের অসহায় মানুষ আমার সমাধিতে এসে চোখের পানি ঝরায়। বলে, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর মন্ত্রী, মেম্বারদের অত্যাচার থেকে আমাদের বাঁচান। ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি থেকে বাঁচান। দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে।’ মুজিব তার দলের এবারের শোক দিবস কর্মসূচি প্রসঙ্গে বললেন, ‘৪০ দিন ধরে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করে আদর্শের পতাকা তুলে ধরা যাবে না।’ আওয়ামী লীগ এতে ব্যর্থ হলে নতুন দল ও নতুন নেতৃত্ব আসবে বলেও আওয়ামী লীগের প্রাণ-পুরুষ মুজিবের বিশ্বাস। এটাও আবদুল গাফফার চৌধুরী তার স্বপ্নসূত্রে জানিয়ে দিলেন।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী ২ আগস্ট ইত্তেফাকে তার নিয়মিত কলামে মুজিব-ফজলুল কাদের চৌধুরী সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেছেন। রাজনীতির ময়দানে পরস্পর বিপরীত দু’মেরুতে অবস্থান সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত উভয়ের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বজায় ছিল। একজন ছিলেন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা। অন্যজন, তদানীন্তন ক্ষমতাসীন (কনভেনশন) মুসলিম লীগের শীর্ষনেতাদের অন্যতম এবং সে সরকারের প্রথমে মন্ত্রী ও পরে স্পিকার। ওই সরকার মুজিবকে মারাত্মক দুশমন গণ্য করত। আজকাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ দু’জন দূরের কথা, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের অন্য নেতাদের মধ্যেও ওই রকম সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি কল্পনাও করা যায় না।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী সম্পর্কে, সাংবাদিক হিসেবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার পর থেকে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। রাজনৈতিক মতামতে আমরা বিপরীত দুই মেরুর লোক হলেও তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেই আমাকে টেলিফোন করে বলতেন, ‘তোমার জন্য পতেঙ্গার লাল তরমুজ এনেছি। তাড়াতাড়ি এসে নিয়ে যাও।’ চট্টগ্রামে তার টাইগার হিলের বাসাতেও কয়েকবার গেছি।”
তিনি আরো লিখেছেন, ‘ফজলুল কাদের চৌধুরীর মুখেই শুনেছি, কলকাতায় ছাত্রজীবনে তিনি এবং শেখ মুজিব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও এখনো বজায় আছে। কলকাতায় ছাত্র থাকাকালে ফজলুল কাদের চৌধুরী নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি এবং শেখ মুজিব একসঙ্গে সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জানিয়েছেন, ফজলুল কাদের অকপটে প্রশংসা করতেন মুজিবের গুণগুলোর। এমনকি, তার মাধ্যমে মুজিবকে আপস বা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খান। মুজিব এতে সম্মত হননি। বরং ফজলুল কাদেরকে মুজিব বড় ভাইতুল্য মনে করতেন বলে তার সাথে তখন রাগ করতে পারেননি। উল্লেখ্য, ফজলুল কাদের চৌধুরী হচ্ছেন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মরহুম ফখরুদ্দীন আহমেদ তার বইতে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল সম্পর্কে। এবার ১৫ আগস্ট উপলক্ষে দৈনিক কালের কণ্ঠে তার লেখার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ফখরুদ্দীন বলেছেন, ‘সাংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর পর এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাকে ইঙ্গিত করে উচ্চস্বরে বলেন যে, তিনি (ফখরুদ্দীন) বাকশালে যোগ দেননি।’ এটা থেকে ধারণা করা যায়, তিনি বাকশালে যোগ দিলে নেতা খুশি হতেন। যদিও সরকারি কর্মচারীদের এ জন্য চাপ দেয়া হয়নি। ফখরুদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু জানতেন, ফখরুদ্দীন সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেয়ার বিরোধী ছিলেন।
ফখরুদ্দীন আহমেদ লিখিত বইটির নাম Critical Times : Memoirs of a South Asian Diplomat (সঙ্কটাপন্ন সময় : দক্ষিণ এশিয়ার একজন কূটনীতিকের স্মৃতিকথা)।
তিনি লিখেছেন, মুজিব আমলে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিভিন্ন আরব দেশের, এমনকি সৌদি আরবের মনোভাবেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছিল। ফখরুদ্দীনের দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ১৫ আগস্টের দু’সপ্তাহ আগেই সুইডেনের একটি সংবাদপত্র আসন্ন অভ্যুত্থান সম্পর্কে অনেকটা সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছিল। এতে জানানো হয়েছিল, সেনাবাহিনীর একাংশে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুজিব হত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবরের কাটিং নিয়ে ফখরুদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছিলেন। তবে মুজিব ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন, সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে এ বিষয়ে দেখতে বলবেন।
‘বাকশাল’ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, বিবাদ ও বিভেদের শেষ নেই। মুজিবভক্তদের কারো মতে, এটা তার দ্বিতীয় বিপ্লব; কারো মতে, বড় নেতার বড় ভুল। অন্য দিকে, মুজিববিরোধীদের অনেকের ধারণা, ‘বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করা ১৫ আগস্টের ঘটনার একটা বড় কারণ।’ যা হোক, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ৪র্থ সংশোধনীর পরপরই প্রধানমন্ত্রী থেকে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’ রাষ্ট্রপতি হয়ে গিয়েছিলেন। তার সমালোচকদের অভিযোগ, তিনি আজীবন এ পদে থাকতে চেয়েছিলেন। অপর দিকে, আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষনেতা এবং বাকশালের তিন সম্পাদকের একজন, মরহুম আবদুর রাজ্জাক একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাকশাল বহাল রেখে বহুদলীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসতেন। কিসের ভিত্তিতে তিনি এতটা নিশ্চিত হয়েছিলেন, তা জানা যায়নি।
এদিকে, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমেদের বইতে একটি নতুন তথ্য পাওয়া যায়। এই লেখক জানিয়েছেন, ‘বাকশাল আমলে একদিন আলোচনাকালে তিনি নেতাকে বিষণœ দেখতে পান। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বলেন যে, দুই বছর পরই তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করে বিরোধী দল গঠন করবেন।’
কথাটা তিনি নিছক ঠাট্টা করে বলেছেন বলে মনে করা যায় না বইটি পড়ে। প্রশ্ন হলো : একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন কার্যত শুরু হতে না হতেই কেন মুজিব পদত্যাগের কথা ভাবছিলেন? এমনকি, এমন একটি গুরুতর বিষয় সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে প্রকাশও করে দিলেন কী কারণে? আরো গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা, বঙ্গবন্ধুর উক্তিমাফিক, যদি তিনি নিজে বিরোধী দল গঠন করেন, তখন সরকারি দল বা ক্ষমতায় থাকবেন কে?
বঙ্গবন্ধুর গুণগ্রাহী হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমেদ লিখেছেন, ‘তাকে বলা হয়েছিল- পোল্যান্ডের মতো যেসব দেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তারাও একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করেছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি তার ভাগ্নে শেখ মনির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন, যদিও পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন ছিল। দুঃখজনকভাবে বঙ্গবন্ধু নিজের অধিকতর ভালো বিবেচনার বিপরীতে অন্যের ধারণা গ্রহণ করেছিলেন।’
এ প্রসঙ্গে প্রবীণ কূটনীতিক ফখরুদ্দীন আরো লিখেছেন, ‘একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন ও বঙ্গবন্ধুর নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় শেখ মনির প্রভাব আরো বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ুব্ধ হয়েছিল। শেখ মনির সখ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে।’
স্মর্তব্য, বাকশালের তিনজন সম্পাদক নিযুক্ত করেছিলেন দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারা হলেন, জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি ও আবদুর রাজ্জাক। ১৫ আগস্ট শেখ মনি সস্ত্রীক নিহত হন।
১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে ফখরুদ্দীন লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাকশাল বা আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা রাতারাতি লাপাত্তা হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কোনো প্রতিবাদ, জনসমাগম, এমনকি কোনো সামরিক সদস্যও দেখেননি।
১৫ আগস্টের ট্র্র্যাজেডির পর গঠিত সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহকর্মীদের একজন, খন্দকার মোশতাক আহমদ। অনেকেরই কৌতূহল জাগতে পারে, তখন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অর্থাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কে?
১৫ আগস্টের অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, বাকশাল আমলে তিনি দেশে ছিলেন না। অধ্যাপনা উপলক্ষে ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আর ফেরেননি। আসলে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তার মনোপূত হয়নি। ১৫ আগস্টের পরই মোশতাক তাকে দেশে ফিরে দায়িত্ব নিতে বার্তা পাঠান। কামাল সে বার্তা সরাসরি অগ্রাহ্য না করে সুকৌশলে খবর দেন, চিকিৎসা চলমান থাকায় তার দেশে প্রত্যাবর্তন সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ পরে ড. কামালের পরিবারের লোকজন ঢাকা থেকে লন্ডন চলে যান। মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানীর হস্তক্ষেপে এটা সম্ভব হয়েছিল। এবার কামাল প্রবাসে মুখ খোলেন মোশতাকের বিরুদ্ধে।
এদিকে মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন লিখেছেন, মোশতাক বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন জার্মানি থেকে রাষ্ট্রদূত হমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সচিবের পরামর্শে তিনি এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত ছিলেন। তদুপরি, সুযোগ খুঁজছিলেন বিদেশ পাড়ি দিতে। মোশতাক তা টের পেয়েছিলেন। অবশেষে সচিব ফখরুদ্দীনের জোরালো পরামর্শে মোশতাক অনুমতি দেন আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিদেশ যেতে।
মুজিবতনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মশিউর রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী মুজিবের একান্ত সচিব। তিনি এক নিবন্ধে মুজিব সরকারের চরম বিরোধী একাধিক রাজনীতিকের সাথে মুজিবের অবিশ্বাস্য ঘনিষ্ঠতার চিত্র তুলে ধরেছেন। দৈনিক কালের কণ্ঠে মশিউর রহমান লিখেছেন, ‘একবার বঙ্গবন্ধুকে মওলানা ভাসানী চিঠি লিখলেন যে, তাঁর ওষুধের দরকার। থাইল্যান্ডে বা সিঙ্গাপুরে চেষ্টা করে আমরা ব্যর্থ হই। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনুরোধ জানালে তাঁরা ওষুধটি পাঠান। মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে সেই ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয়।’
মশিউর রহমানের লেখায় সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত চরম বামপন্থী নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী মুজিবের ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের বয়ানও রয়েছে। তার ভাষায়, ‘একদিন সকালে গণভবনের দরজায় একজন কলা ফেরিওয়ালা উপস্থিত। তার মাথায় টুকরিতে কলার কাঁদি। গণভবনের রক্ষীরা তাকে আসতে দেবে না।... এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু চলে এসেছেন। তিনি ফেরিওয়ালাকে গণভবনে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গণভবনের পেছনের বারান্দায় চলে গেলেন। ফেরিওয়ালা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন আধা ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি। ফেরিওয়ালা যখন যায়, তাকে কলার দাম হিসেবে অর্থ দেওয়ার নির্দেশ দেন।.... আমি কৌতূহলী ছিলাম। প্রেস সচিব তোয়াব খান আমার চেয়ে বেশি খবর রাখেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সুস্পষ্ট বা সরাসরি উত্তর দিলেন না। কিছুটা এড়িয়ে যাওয়ার সুরে তিনি বললেন যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বহু ধরনের রাজনীতিবিদের সম্পর্ক আছে, হক-তোহা তাঁর অপরিচিত নন, তাঁরাও হতে পারেন।’
‘হক-তোহা’র ব্যাখ্যা আসলে নি®প্রয়োজন। কমরেড আবদুল হক (যশোর) ও কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা (নোয়াখালী) মাওবাদী বা চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে প্রায় কিংবদন্তিতুল্য ছিলেন। মুজিব আমলে তারা নিজ নিজ এলাকায় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ‘যুদ্ধে’ তৎপর ছিলেন এবং উভয়ের সংগঠন ছিল আইনের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।
উপরিউক্ত ঘটনা থেকে বোঝা যায়, উল্লিখিত কলাওয়ালা কোনো হকার নন, তিনি খুব সম্ভবত কমরেড তোয়াহা কিংবা সে পর্যায়ের কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড লিডার। যে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ‘বিপ্লবী জনযুদ্ধ’, এর প্রধানের সাথেই ছদ্মবেশে এসেছিলেন সাক্ষাৎ ও আলোচনা করতে! এমন নজিরবিহীন ঘটনার হিসাব মেলানো গতানুগতিক রাজনীতির গণিতে অসম্ভব।
সোহরাব হাসান ১৫ আগস্ট উপলক্ষে সিরিজ রচনা লিখেছেন প্রথম আলোতে। ৯ আগস্ট সংখ্যার লেখায় কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে। উদ্ধৃতি : ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ সদস্যপদের আবেদন করলে ভুট্টো বিরোধিতা করেন। তাঁর দাবি, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ। ভুট্টোর এই আচরণে বঙ্গবন্ধু ুব্ধ হন। ১৫ জানুয়ারি লন্ডনের অবজারভারে গ্যাভিন ইয়ংকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেব এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করবো। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেবো।’
লক্ষণীয়, তর্কের খাতিরে কিংবা কথার কথা হিসেবে মুজিব নিজেকে ‘পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী’ বলছেন। কিন্তু এর এক মাস আগেই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।
বিশিষ্ট বামপন্থী কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ৮ আগস্ট যুগান্তর পত্রিকায় লিখেছেন মুজিব প্রসঙ্গে। উল্লেখ করেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণা করতেন। তেমনি আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রেও তার কোনো দ্বিধা ছিল না। নিজের বাঙালি মুসলমান পরিচয় নিয়ে ছিল তার অহংকার।’
আবুল মকসুদ আরো লিখেছেন, ‘কথাটি অপ্রীতিকর হলেও সত্য যে, তিনি তার দলের যাদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন, সংসদ সদস্য বানিয়েছিলেন, বড় বড় পদে বসিয়েছিলেন, তারা তার সঙ্গে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বেঈমানী করেছেন।... এখন ডিজিটাল ব্যানারে তার ছবির সঙ্গে নিজেদের বড় বড় ছবি দিয়ে আত্মপ্রচার করছেন অনেকেই।’ মকসুদ আরো বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি, তা হলো চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে তার সরকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল।’
একটা কথা বারবার জোর দিয়ে প্রচার করা হয় যে, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরই পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আসলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যখন বঙ্গবন্ধু লাহোরে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে তাদের প্রথম হাইকমিশনার হিসেবে পাঠায় আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নেতাকে। নাম তার মুহাম্মদ খুরশিদ। তিনি ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরূপে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের একটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অপর দিকে, মোশতাক সরকার পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার করে পাঠায় মরহুম জহির উদ্দীনকে। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন থেকেই তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন তুখোড় বক্তা জহির উদ্দীন। আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন দীর্ঘ দিন। পাকিস্তান আমলে হয়েছিলেন মন্ত্রীও। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঢাকার মিরপুর-মোহাম্মদপুর থেকে আওয়ামী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনিই বঙ্গবন্ধুর অবরুদ্ধ পরিবারের দেখাশোনা করতেন। তার আত্মজীবনীতে জহিরের প্রশংসা করা হয়েছে।
চীন ও সৌদি আরবের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য মুজিব সরকার স্বাভাবিকভাবেই বেশ আগ্রহী ছিল। এ জন্য তখন নানা তৎপরতাও চলছিল। মুজিব আমলে খন্দকার মোশতাক যখন বাণিজ্যমন্ত্রী, তখন চীনে পাট রফতানির উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অজ্ঞাতসারে এটা হয়েছিল মনে করার কারণ নেই। তিনি বিশেষ করে হজযাত্রীদের সমস্যার কথা চিন্তা করে সৌদি স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। অবশ্য ১৯৭৫ সালে ইহুদিবাদী চক্রান্তে বাদশাহ নিহত হলে বঙ্গবন্ধুর সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালন করে এবং তখন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা মুজিব সরকারের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অনেকের মতে, সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা ছিল এর একটি বড় উদ্দেশ্য।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, খন্দকার মোশতাক সরকারকে ভারত স্বীকৃতি দিয়েছিল চীনেরও আগে। চীন ৩১ আগস্ট এবং ভারত ২৭ আগস্ট স্বীকৃতি দেয়। ভারতের রাষ্ট্রদূত মোশতাকের সাথে এর কয়েক দিন আগেই সাক্ষাৎ করে বৈঠকে মিলিত হন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্র মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার চার দিন আগেই এ সরকার স্বীকৃতি পেয়েছিল ব্রিটেনের কাছ থেকে, যে দেশ মুক্তিযুদ্ধে ছিল সহায়তাকারী। ব্রিটেন ১৮ আগস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্র ২২ তারিখে নতুন সরকারকে স্বীকার করে নেয়।
সুত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত, প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০১৫,রবিবার