ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি প্রয়োজনীয় মনে করে।
মহাকবি ইকবালের প্রতি শ্রদ্ধা : শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘(লাহোরে) আমাকে তার (খাজা আবদুর রহিম পূর্বে আইসিএস, এখন ওকালতি করেন) কাছে রাখলেন, ‘জাভেদ মঞ্জিলে’। তিনি জাভেদ মঞ্জিলে থাকতেন। ‘জাভেদ মঞ্জিল’ কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা শুধু কবি ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন। আমি এখানে তাঁর মাজার জিয়ারত করতে গেলাম এবং নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আল্লামা যেখানে বসে সাধনা করেছেন, সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি।’ (পৃ: ২১৭)।
যেকোনো সচেতন মুসলিমের ইকবালের ওপর শ্রদ্ধা খুবই স্বাভাবিক। অনেক অমুসলিমও ইকবালকে ভালোবাসেন। বিহারের একজন হিন্দু নেতা ইকবালের মাজারে গিয়েছিলেন। তিনি টিভির সামনে গর্ব করে বলেন, ইকবাল হলেন সেই সঙ্গীতের রচয়িতা ‘সারে জাঁহাছে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা’।
কমিউনিস্ট অনুপ্রবেশ : আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়া থেকে কমিউনিস্টরা এ দলে অনুপ্রবেশ করেছে, সে কথা শেখ মুজিব লিখে গেছেন এভাবেÑ “(গণতান্ত্রিক যুবলীগে) কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লোকও কয়েকজন (কার্যনির্বাহী) কমিটির সভ্য হলেন। ...কমিউনিস্ট নেতারা তখন ভারতবর্ষে স্লোগান দিয়েছেন, ‘স্বাধীনতা আসে নাই, সংগ্রাম করে স্বাধীনতা আনতে হবে।’ আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন সহকর্মীরা সেই আদর্শই কর্মসূচির মধ্যে গ্রহণ করতে চায়। এই সকল কর্মসূচি নিয়ে এখনই জনগণের কাছে গেলে আমাদের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।” (পৃ: ৮৫)।
ময়মনসিংহে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সভা হলে শেখ মুজিব সেখানে উপস্থিত হন কমিউনিস্টদের কারসাজি নস্যাৎ করতে। তিনি লিখেছেন, ‘মুসলিম লীগের এখনও কাউন্সিল সদস্য আমরা। অনেক তর্ক-বিতর্ক হলো, তারপর যখন দেখলাম যে, কিছুতেই শুনছে না, সকলেই প্রায় কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বা তাদের সমর্থকরা উপস্থিত হয়েছে, তখন বাধ্য হয়ে আমরা সভা ত্যাগ করলাম। যুবলীগও আজ থেকে শেষ। আপনাদের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা আমাদের জানা আছে। আমাদের নাম কোথাও রাখবেন না (আপনাদের কমিটিতে)।’ (পৃ: ৮৭-৮৮)।
তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম... দুই চারজন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন ছাত্র ছিল যারা সরকারকে পছন্দ করত না। কিন্তু তারা এমন সমস্ত আদর্শ প্রচার করতে চেষ্টা করত যা তখনকার সাধারণ ছাত্র ও জনসাধারণ শুনলে ক্ষেপে যেত।’ (পৃ: ১০৯)।
বিরোধী দল প্রসঙ্গে : শেখ সাহেব লিখেছেন, “আমি যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা (নাজিমুদ্দিন) সাহেবের সাথে দেখা করতে তাঁর অফিসে হাজির হলাম (করাচীতে)। ... আমাকে খাজা সাহেব তাঁর কামরায় নিজে এগিয়ে এসে নিয়ে বসালেন। যথেষ্ট ভদ্রতা করলেন। ... তিনিও জানতেন, ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি যে একজন ভাল কর্মী সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করতেন এবং আমাকে স্নেহও করতেন। ... তিনি বিশ মিনিটের জায়গায় আমাকে এক ঘণ্টা সময় দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে, আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি। তাকে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি।” (পৃ: ২১৩-২১৪)।
ধর্ম ও রাজনীতি : শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘১১ অক্টোবর আরমানিটোলায় বিরাট সভা হল। ... শোভাযাত্রা বের হল। মওলানা (ভাসানী) সাহেব, (শামসুল) হক সাহেব ও আমি সামনে চলেছি।... নাজিরাবাজারে এসে দেখি, পুলিশ রাস্তা আটক করেছে, আমাদের যেতে দিবে না। তখন নামাজের সময় হয়ে গেছে। মওলানা সাহেব রাস্তার উপরই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। শামসুল হক সাহেবও সাথে সাথে দাঁড়ালেন।’ (পৃ: ১৩২)।
তমদ্দুন মজলিস : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন, “ফেব্রুয়ারি ৮ই হবে ১৯৪৮ সাল। বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু শাখা জেলায় ও মহকুমায় করা হয়েছে। তমদ্দুন মজলিস একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যার নেতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সাহেব। ...এ সময় জনাব আব্দুস সবুর খান আমাদের সমর্থন করছিলেন।” (পৃ: ৯১-৯২)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা : তমদ্দুন মজলিসের প্রবীণ নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর এ সম্পর্কে যা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন, তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা কংগ্রেসের নির্দেশিত পথে সম্ভব নয়। এ লক্ষ্য পূরণে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের পথেই অগ্রসর হতে হবে। এই বাস্তববাদী কর্মপন্থার কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও অবাস্তব রাজনৈতিক কর্মপন্থার কারণে শেরে কাশ্মীর শেখ আব্দুল্লাহকে তাঁর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়।’ (ইনকিলাব, ১৫ আগস্ট ২০১৩)।
আরো কিছু উদ্ধৃতি : আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘শেখ বোরহান উদ্দিন কোথা থেকে কিভাবে এই মধুমতীর তীরে এসে বসবাস করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা-৩)। ‘ইংরেজরা মুসলমানদের ভাল চোখে দেখত না।’ (পৃ : ৫)। ‘মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেনুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম, আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না ও রেনুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে।’ (পৃ : ৭)। ‘১৯৪১ সাল : তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’ (পৃ: ১৫)। ‘মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। ‘(পৃ : ১৫)। ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে চুঁচুঁড়া সম্মেলনে... আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর (ছাত্র) দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম।’ (পৃ: ১৬)। ‘আমরাও কলকাতা (মুসলিম লীগ) অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও (ইসলামিয়া কলেজ) হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। ...পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব?’ (পৃ: ৩২)। ‘অখণ্ড ভারতে যে, মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। (পৃ: ৩৬)। ‘এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে, এই একটাই স্লোগান সকল জায়গায়।’ (পৃ: ৩৬)। ‘আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান।’ (পৃ: ৩৭)।
ওপরের এসব উদ্ধৃতি প্রমাণ করে, তার অনেক দৃষ্টিভঙ্গিই কংগ্রেস ও বামপন্থী সংগঠনগুলো থেকে আলাদা ছিল। এমনকি বর্তমানের আওয়ামী লীগের সাথেও তা মিলে না। আসলে তিনি ছিলেন একইসাথে বাঙালি ও মুসলমান।
সুত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত, প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০১৬