মঈনুল আলম
১৯৭৪-এর ৩০ অক্টোবর ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী (তখন) শেখ মুজিবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়, সে বৈঠকে বঙ্গবন্ধু উপদেশের সুরে কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে অত্যধিক আসনে জয়লাভ করবেন না। দেখুন না, নির্বাচনে অত্যধিক আসনে জয়লাভ করায় আমার কী ঘটেছে! ...’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এখন গোপনীয়তামুক্ত করা রেকর্ডপত্র থেকে ওই বৈঠকে কথোপকথনের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি। বৈঠকে বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন, পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দিন আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব রুহুল কুদ্দুস ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টার, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের রবার্ট ওকলি এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
এই কথোপকথনে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তায় সারল্য ও সাবলীলতা এবং কূটনৈতিক পরিভাষামুক্ত সাদামাটা ভাষায় ইতস্তততাবিহীনভাবে ভাব প্রকাশ করা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এর কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি :
“মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার : বিদেশে সাহায্য প্রদানের ব্যাপারে আমাদের কংগ্রেসেই সমস্যা রয়েছে।
আগামী মঙ্গলবার আমাদের কংগ্রেসের নির্বাচন হবে। অবশ্য আমরা আশা করছি না ১৯৭০-এর নির্বাচনে আপনি যে রকম একচেটিয়া সংখ্যাধিক্য আসনে জয়লাভ করেছিলেন, আমাদের প্রশাসনও সে রকম জয়ী হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব : ও রকম অত্যধিক সংখ্যক আসনে জয়ী হয়েন না। দেখুন না, ওই রকম বিপুল সংখ্যক আসনে জয়ী হওয়ায় আমার উপর কী ঘটেছে! পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর হামলে পড়ল, আমার দেশকে ধ্বংস করল, তারা আমাকে গ্রেফতার করল। আমার পাঁচ বছর বয়স্ক সন্তান পরিস্থিতিটা পুরো বুঝে ফেলেছিল, সে পরে আমাকে বলেছে,‘আর কখনো নির্বাচনে দাঁড়াবেন না।’ আমার দেশের ওপর জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানল, গৃহযুদ্ধ বাধল, সাইক্লোন আঘাত করল এবং সামগ্রিক যুদ্ধ বেধে গেল। নির্বাচনে আমার জয়লাভে এটাই আমি পেয়েছিলাম!
কিসিঞ্জার : আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এটা বলে বোঝাতে চাচ্ছেন না যে, আপনি কিছুকাল নির্বাচন করতে যেতে চান না। (তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ বদলে, ফলে বঙ্গবন্ধুকে এ প্রশ্নের জওয়াব দিতে হলো না) আমার নিজের ইচ্ছা এবং প্রেসিডেন্ট ফোর্ডেরও ইচ্ছা যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য আমরা সর্বতো প্রচেষ্টা চালাব। খাদ্য সাহায্যের ব্যাপারে আমরা ’৭৫ অর্থবছরের শেষার্ধে অবশ্যই আরো কিছু বেশি করতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী মুজিব : বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং এ রকম আরো কিছু বিষয় ভুলে যাবেন না, যাতে আমরা অধিক খাদ্য উৎপাদন করতে পারি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জন্য কঠিন সমস্যা হয়ে আছে।
কিসিঞ্জার : সব জায়গাতেই এই সমস্যাটি রয়েছে।
মুজিব : তা ঠিক। তবে আপনাদের জনগণ শিক্ষিত। আমাদের জীবনে বৈচিত্র্য নেই। আমরা একটা সার্বিক স্বাস্থ্য পরিকল্পনা করেছি এবং এটা আমাদের সাহায্য করবে। এ মাসের ৫ তারিখ মিসরে যাওয়ার আশা করছি, চার দিনের জন্য।
কিসিঞ্জার : আমিও হয়তো একই সময়ে থাকব ওখানে। জানার চেষ্টা করছি, রাবাতে কী হয়েছিল।
মুজিব : আপনি আপনার সর্বোত্তম চেষ্টা করছেন।
কিসিঞ্জার : আমি সাদাৎকে (মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাৎ) পছন্দ করি। আপনি করেন?
মুজিব : খুবই পছন্দ করি।
কিসিঞ্জার : আসাদকে (সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ) পছন্দ করেন?
মুজিব : হ্যাঁ, আমি তাকেও পছন্দ করি। তিনি এক নাটুকে ব্যক্তিত্ব।
কিসিঞ্জার : বাংলাদেশের নেতারাও রঙবিহীন নন!
মুজিব : আমরা দীর্ঘকাল আন্দোলন করেছি এবং ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এসেছি। পাকিস্তানিরা দু’বার আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি বেঁচে বেরিয়ে এসেছি। আপনাদের সরকার সাহায্য করেছিল।
কিসিঞ্জার : আমরা তাদের ওপর চাপ দিয়েছি, যদিও আমরা জানতাম না, প্রকৃতই কোথায় তারা আপনাকে রেখেছিল। আমরা অনেক অনুরোধ জানিয়েছি তাদের।
মুজিব : যদি আমাকে হত্যা করা হতো, সে সময় বাংলাদেশে যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ছিল তারা তৎক্ষণাৎ গুরুতর বিপদে পড়ত। কিন্তু আমি সব ভুলে গেছি। আমি এ উপমহাদেশে শান্তি চাই। ঠিক যে রকম আপনাদের যুদ্ধ শেষে আপনারা জার্মানিতে করেছিলেন। আমি চাই, পাকিস্তান সহযোগিতা করুক।
কিসিঞ্জার : তাহলে প্রধান বিষয় হলো, (দু’ দেশের মধ্যে) সম্পদ বিভাজন এবং (আটকে পড়াদের) প্রত্যাবর্তন?
মুজিব : আর কিছু নয়। এটা এখন পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করছে। আমার হাতে কিছু নেই। ভুট্টো জানেন, পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর কী নির্যাতন করেছে। তাকে প্রমাণ দেখিয়েছি, জেনারেল ফরমান আলী ‘সবুজ বাংলাদেশকে রক্তলালে রঞ্জিত করতে চেয়েছিলেন’। এটা একটা উদ্ধৃতি, যা ফরমান তার সৈন্যদের প্রতি জারি করা হুকুমনামায় লিখে দিয়েছিলেন।
কিসিঞ্জার : ভুট্টো কী বললেন?
মুজিব : ভুট্টো বিস্মিত হয়েছিলেন এবং এই কক্ষে বসা তার সব বন্ধুকে প্রমাণটি দেখিয়েছিলেন।”
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক