বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু কথা কিছু স্মৃতি

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিছু কথা কিছু স্মৃতি: ইঞ্জি. মোহাম্মদ আলী
 প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২০   
 
ঊনসত্তরে ছাত্রসমাজের ১১ দফা আন্দোলন তুঙ্গে। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পান। আর ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনায় তাকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করা হলো। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে তিন দিন নিরবচ্ছিন্ন সভায় ছাত্রলীগের পরবর্তী সভাপতি কে হবে, তা সমঝোতা হলো না। ৬ দফা আন্দোলনের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী এবং চলমান ১১ দফা আন্দোলনের নেতা তোফায়েল আহমেদ দু'জনই আগ্রহী। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি আব্দুর রউফ এবং সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী সভায় সিদ্ধান্ত দিলেন যে, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির দু'জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর মতামত আনতে যাবে- কে হবে ছাত্রলীগের সভাপতি। অগত্যা জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আরেফ (মরহুম) এবং বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি- এই দু'জনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। পরদিন সকালেই আমরা ৩২ নম্বরে হাজির হলাম। বঙ্গবন্ধু লাইব্রেরিতে বসা; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডাকলেন। 'কিরে, এত সকালে তোরা!' বঙ্গবন্ধু কর্মীদের সঙ্গে এতটাই আন্তরিক ছিলেন, আমরা সাত-পাঁচ না ভেবে কোনো ভূমিকা ছাড়াই ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা বলে জিজ্ঞেস করলাম- মুজিব ভাই, ছাত্রলীগের সভাপতি কাকে বানাব? নেতা বড় করে একটা হাসি দিয়ে বললেন, ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কে হবে- এর আগে আমি কখনও বলে দিইনি। এ ছাড়া আমি কার নাম বলব? নূরে আলম সিদ্দিকী ৬ দফা আন্দোলনের মহানায়ক আর তোফায়েল ১১ দফা আন্দোলনের মহানায়ক। আমি তোদের হাতে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দিলাম। তোরা খুশিমতো নাম বসিয়ে দিস। ১৯৭০-এ ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী।
পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব নেতা ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার পক্ষে; বঙ্গবন্ধু তাদের নিয়ে একটা মতবিনিময় সভার আয়োজন করলেন শাহবাগ হোটেলে (পরে পিজি হাসপাতাল, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। ওই সভায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উপস্থিত ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, সহসভাপতি কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ, সিন্ধুর নেতা লেঘারী, বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতি, বেলুচ নেতা পীর পাগারোসহ অনেকে। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, জামায়াত ছাড়া আর সব নেতা এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। ভুট্টো ও কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ দৌলতানা ছাড়া বাকি সবাই যেন ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান সমর্থন করেন, এটাই মতবিনিময় সভার মূল উদ্দেশ্য। ওই সভায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সভায় রাতের খাবার শেষে মুক্ত আলোচনা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু গেটের পাশে কাঠের চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন। অযাচিত লোকজন যাতে ঢুকতে না পারে, আমি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু ইশারায় আমাকে ডাকলেন। বললেন, 'টুলটা টেনে বস্‌।' আমি বললাম, লিডার, অ্যাডভোকেট সালাম খান ৬ দফার বিপক্ষে পিডিএমের সমর্থনে বিবৃতি দেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত ব্যারিস্টার ড. একে ব্রোহি, লন্ডনের বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়ামের মতো আইনজীবী থাকার পরও সালাম খানকে কেন? আবার আজকের সভায় তিনি দাওয়াতিও। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন- পাগল, সালাম যাতে প্রকাশ্যে আমার বিরোধিতা না করে, তার জন্য।
আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, 'তুই তো শিগগির ইঞ্জিনিয়ার হবি।' পাইপে একটা টান দিয়ে বললেন, 'ইঞ্জিনিয়াররা বেশি আওয়ামী লীগ করে না। কিন্তু আমার তো ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার।' আমি কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার ৩২ নম্বর বাড়ি কোন ইঞ্জিনিয়ার বানাইছে?' তিনি হেসে দিলেন এবং বললেন, 'গোপালগঞ্জের সিদ্দিক ইঞ্জিনিয়ার। ঘটনাটা শোন। আমি তখন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সারাদেশের নেতাকর্মীদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি আর প্রয়োজনে দৌড় দিই। বিশেষ করে নেতা (সোহরাওয়ার্দী সাহেব) যখন আসেন তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়।' আমি অফিসে বসে ফোন করছি। এক লোক ঢুকে বলে, আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ স্যার; রাজমিস্ত্রির কাজ করি। আপনার ধানমন্ডির জায়গাটা খালি পড়ে আছে। আপনি বললে ওখানে একটা বিল্ডিং বানাইয়া দিতাম। 'কীভাবে?' ২ গাড়ি ইটা, ১ গাড়ি বালি আর কিছু সিমেন্ট কিন্যা দেন; হয়ে যাবে। 'আমি যে টাকা দিয়া ইট-বালি কিনব, ওগুলো আমার কর্মীদের দিলে আমি বেশি খুশি হবো। সিদ্দিক মিস্ত্রি নাছোড়বান্দা। তাই বাড়িটা হয়েছে, তবে অনেক সময় লেগেছে।' সেদিন রাত বেশ হয়েছে। অনেকেই বিদায়ের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে উঠে বললেন, 'তুই খাইছস?' না। 'খাবার আছে।' নেতা সবার মাঝে মিশে গেলেন।


'৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের ঘণ্টা বেজে উঠল। আমি তখন নারায়ণগঞ্জে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ইঞ্জিনিয়ার। '৭০-এর নির্বাচনে অফিস ফেলে আমাকে চার মাস জামালপুর মহকুমার নির্বাচনের কাজ করতে হয়েছিল। নির্বাচন শেষে ঢাকায় ফিরে ইপিআইডিসি প্রধান কার্যালয়ে গেলে আমাকে চট্টগ্রামে বদলির একটা চিঠি হাতে তুলে দেওয়া হয়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। শেখ শহীদ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আমি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। '৬৯-এর গণআন্দোলনে নুর খান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের ওপর সব আলোচনায় শেখ শহীদ ও আমি ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম। পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ খুব সকালে ৩২ নম্বরে হাজির হই। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি বঙ্গবন্ধু বৈঠকখানা সংলগ্ন ডাইনিং টেবিলে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে কোরআন বন্ধ করে বললেন, 'কিরে, এত সকালে তোরা! কোনো প্রবলেম?' শহীদ বলতে লাগলেন, মামা, মোহাম্মদ আলী ঢাকায় দলীয় অনেক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বুয়েট চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, আর আব্দুল করিম সাধারণ সম্পাদক। পুলিশ যখন আমাদের ওপর হামলা চালায় তখন শেল্টার দেয় বুয়েটের কর্মচারীরা। মোহাম্মদ আলী না থাকলে ওইটুকুন পাব না। এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা সাহেবের শ্রমিক ফ্রন্টের বিভিন্ন মিটিংয়ে প্রতিনিধিত্ব করে মোহাম্মদ আলী। ওকে ঢাকায় রাখতে হবে।
নেতা বললেন, 'কফিল উদ্দিন মাহমুদকে লাগাও।' শহীদ ইপিআইডিসির চেয়ারম্যানকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে ঘটনাটা বললেন। উত্তর এলো, আপাতত যোগদান করে দরখাস্ত দিক। আমার আর দরখাস্ত দেওয়া হয়নি। কারণ এর পর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম আমার সেকেন্ড হোম হয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। '৭২-এর ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর বুঝলাম, রাজনীতিবিদ মুজিব আর সরকারপ্রধান মুজিবের পার্থক্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এখন আর যখন-তখন দেখা করা যায় না। তোফায়েল ভাই বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। ভাবলাম, আমাদের প্রস্তাবটা বঙ্গবন্ধুকে বলার আগে তোফায়েল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই আমার রাজনৈতিক মুরুব্বি। তাদের সহায়তায় ১৯৬৫ সালে বুয়েট ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। তোফায়েল ভাইয়ের কক্ষে ঢুকতেই 'কী খবর মোহাম্মদ আলী? তোমাকে দেখছি না।' আমি তো আপনার সামনেই আছি। চট্টগ্রামে চাকরি করি। 'চা, না কফি? কফি খাও। ভালো বিদেশি কফি আছে। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে খান।' আমি কফির কথা বলে প্রস্তাবটা উত্থাপন করলাম- বিশ্ব এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভরশীল। তাই আমরা বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক একটা মন্ত্রণালয় থাকুক। তিনি বললেন, প্রস্তাবটা তো যৌক্তিক। শেখ শহীদকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা কর। বঙ্গবন্ধু তিন দিন পর ভিয়েনা থেকে ফিরেছেন। আমি শেখ শহীদকে ধরলাম। পরদিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ৩২ নম্বরে হাজির হলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, 'বিষয়টা আমরাও ভেবেছি এবং ড. কুদরাত-এ-খুদা অথবা ড. মফিজকে দায়িত্ব দেব।' 
খুশি মনে ফিরছি। পল্লী কবি জসিম উদ্‌দীন লাঠি ভর দিয়ে গেটের ভেতর ঢুকছেন। বঙ্গবন্ধু কবিকে জড়িয়ে ধরলেন, 'এত সকালে আপনি! ফোন করলেই তো হতো।' খুব জরুরি মনে করে চলে এলাম। হাসুর জামাই মওদুদ এখনও জেলে। ওকে একটু মুক্তির ব্যবস্থা কর। মেয়েটা একা একা কান্নাকাটি করে। ইতোমধ্যে ডাইনিং টেবিলে নাশতা আসছে। 'আসেন নাশতা খাই।' 'স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আগে বলে দাও, তার পর নাশতা খাব।' অগত্যা শেখ শহীদকে আবার টেলিফোন করতে হলো। 'মান্নান চাচা, মামার নির্দেশ- মওদুদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে। পরের দিনই মওদুদ আহমদ জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলেন। এক মানবিক বঙ্গবন্ধু এভাবেই আজীবন সমাজ, দেশ, ব্যক্তির কল্যাণে কাজ করেছেন। 
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, সাবেক চেয়ারম্যান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনাল কমিটি, আইইবি
mohammadali.citizen@gmail.com

SUMMARY

2352-১.jpg