বঙ্গবন্ধুর শিল্প-সংস্কৃতি ভাবনা : ফকির আলমগীর
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২০
বাংলার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ে তাঁর অবিনাশী ভূমিকা মহাকাব্যিক উপাখ্যানে আকীর্ণ। বাঙালির হৃদয়ে তিনি কালোত্তীর্ণ রাজনীতির কবি। এই মহাকবির ভাষা :রাজনীতি।
জনজীবনের রক্ত-অশ্রু-ঘাম নিষিক্ত প্রতিবাদী ও আপসহীন নেতৃত্বে মেহনতি মানুষের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রেরণায় যেভাবে শেখ মুজিবুর রহমান 'পুরুষোত্তম তুমি পিতা আমার' হতে পেরেছেন, তেমনটি আর কেউ পারেননি। শেখ মুজিব সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বলেছেন, 'বাংলার গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে মুজিবের তুলনা নেই।' প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, 'একজন মানুষ একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেন। আবার ইতিহাসও তার নিজের প্রয়োজনে একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটাতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মনে হয় এমনি একজন মানুষ। ইতিহাসের প্রয়োজনে তাঁর আবির্ভাব। আবার তিনি ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করে গেছেন। নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রায় অবলুপ্ত একটি জাতিসত্তারও পুনরুদ্ধারকারী। তিনি নব্য বাংলার জনক।... অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছে শতাব্দীর মহানায়ক। আসলে তিনি বাংলাদেশের বহু শতাব্দীর মহানায়ক। একজন বিদেশি ঐতিহাসিকের ভাষায় :প্রায় বারোশ' বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পরে বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে যিনি রঙে, বর্ণে, ভাষায় এবং জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি নব্য বাঙালি জাতির স্রষ্টা।'
ঐতিহাসিক টমাস কারলাইল ইতিহাস সম্পর্কে বলেছেন, 'ইতিহাসের মূলে আছে অসংখ্য জীবনী।' বাঙালির হাজার বছরের মুক্তির ইতিহাসেও নিঃসন্দেহে রয়েছে অনেক জীবন ও জীবনী। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুভাষ, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, সূর্য সেন, তিতুমীর, প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, ভাসানী প্রমুখ বাঙালি মনীষী যে বাঙালি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছেন, এই ধারাবাহিক ইতিহাসের চরম বিস্ময়কর একজন সেনাপতি ছিলেন শেখ মুজিব। একজন কালোত্তীর্ণ মহৎ শিল্পীর মতোই মুজিবের অমর শিল্পভাবনা ছিল বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য, তাঁর এই শিল্পভাবনার মাধ্যম ছিল রাজনীতি। রাজনীতির রংতুলিতেই তিনি একজন দক্ষ শিল্পীর মতো বড় চড়া মূল্যে স্বাধীনতার ধ্রুপদি স্বপ্নটিকে এঁকেছিলেন বাংলাদেশ নামক বিশাল এক ক্যানভাসে। এই ক্যানভাসে সমগ্র জাতির চিন্তাচেতনা, আশা-আনন্দ, বেদনা-বিদ্রোহের দ্রবণে সিক্ত বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্যিক চিত্রকল্পের তিনিই ছিলেন সার্থক রূপকার। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে শীর্ষতম স্থান, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুরও অবস্থান সেই একই জায়গায়- শীর্ষতম স্থানে। সংকটে, বিপর্যয়ে, ভয়-বিহ্বলে রবীন্দ্রনাথ যেমন আমাদের চৈতন্যের উজ্জ্বল উচ্চারণ, তেমন মুজিবও আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে প্রচণ্ড প্রতিবাদী বজ্রকণ্ঠ-কাণ্ডারি, আপসহীন অবিসংবাদিত নেতা, আমাদের পিতা। 'বাঙালীর গর্ব শুধু এতটুকুন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পসাধনা বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি যুগে যুগে প্রতিভাবান মানুষ ঈর্ষান্বিত হবেন, বারেবারে হয়তো সৃষ্টি হবে নতুন বিরোধিতা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চিরকাল মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শিল্প হিসেবে বেঁচে থাকবেন। আমরা যদি তাঁর অমর শিল্পসাধনাকে রক্ষা না করি, সেভাবে গ্রহণ করবে সমগ্র বিশ্ব।' (রবীন্দ্র বিরোধিতা কেন, ভবানী সেন বিজ্ঞাপন পর্ব :এপ্রিল-জুন ১৯৮৬)। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও ঠিক একই কথা। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে তিনি যুগে যুগে ঈর্ষার পাত্র হয়ে থাকবেন। তাঁকে নিয়ে নতুন নতুন বিরোধিতারও সৃষ্টি হবে এই ঈর্ষা থেকে। তথাপি মানবজাতির শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতার সারিতে তাঁর অবস্থানকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। ১৯৯২ সালে লন্ডনের টাইমস পত্রিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছে পোয়েট অব পলিটিক্স। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে টাইমস পত্রিকার এটি ছিল যথার্থ একটি মূল্যায়ন।
বাংলার এই পোয়েট অব পলিটিক্স রবীন্দ্রনাথের মতো গীতাঞ্জলি কিংবা নজরুলের মতো অগ্নিবীণা লেখেননি, জীবনানন্দের মতো রূপসী বাংলাও তিনি রচনা করেননি; তথাপি তাঁর কোনো কোনো বাণী, বক্তৃতা ও কাব্য সুষমায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও উদ্ভাসিত। তাঁর এই বিশেষ মুহূর্তে জ্বালাময়ী বাণী ও বক্তব্য-বক্তৃতা বা ভাষণের আকারে মূর্ত হলেও এর মধ্যে যে বিদ্রোহের আবাহন আছে, যে হাহাকার আছে, আছে দুঃখ-জাগানিয়া গানের স্বরলিপি, তা তো পরিপূর্ণভাবে কবিতারই বেদনা। সঙ্গত কারণেই তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে শুধু ভাষণই নয়, কালোত্তীর্ণ একটি ঐতিহাসিক কবিতা বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। এই কাব্যিক ভাষণে প্রচলিত কবিতার ছন্দ, মিল, উপমা, উৎপ্রেক্ষা হয়তো অনুপস্থিত; তথাপি এই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেরণাব্যঞ্জক আবেদন অবিস্মরণীয় একটি গদ্য কবিতায় উত্তীর্ণ। কারণ, আধুনিক একটি কালজয়ী গদ্য কবিতার মতোই এই ভাষণেরও হয়েছে প্রসাদগুণসম্পন্ন মহিমা এবং হৃদয়ভেদী কার্যকারিতা। বলা যায়, যে কোনো হৃদয়গ্রাহী গদ্যের মতোই এই ভাষণও কাব্য-স্বভাবমণ্ডিত। 'উনিশশ আটচল্লিশ, বায়ান্ন, চুয়ান্ন এবং ঊনসত্তর-একাত্তর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পর্যায়। এই পর্যায়ক্রমিক উন্নতির সর্বোচ্চ রেখা একাত্তর সালের ২৬শে মার্চ। ঐ তারিখে প্রকাশ্যে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ন' মাস সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে চূড়ান্ত সফলতা আসে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠালাভ করে' (ধর্মচিন্তা, জাতিচিন্তা এবং রাষ্ট্রচিন্তা, সোচ্চার উচ্চারণ : আবু জাফর শামসুদ্দিন)।
৭ মার্চের ভাষণকে বলা যাবে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের মুখবন্ধ। এ ভাষণের ভাষা ও ব্যঞ্জনা, বিন্যাস ও ভাবগাম্ভীর্যতা, ক্ষোভ ও দ্রোহ-রক্ষিত বাঙালির হৃদয়ে সমুদ্রের লাখো ঢেউ ফণা তুলেছে এবং এ ভাষণের সঞ্জীবনী শক্তিতেই যার যা কিছু আছে, তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাঙালি। আমাদের কাব্যে নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতাটির মুক্তিপাগল বিদ্রোহের যে আবেদন, আমাদের ভাষা আন্দোলনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একুশ নিয়ে গানটির যে অপার মহিমা, বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণেও তেমনি রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিস্ম্ফুলিঙ্গ, রয়েছে বাঙালির দিকনির্দেশনা। তাই বঙ্গবন্ধু যখন বজ্রকণ্ঠে এ বক্তৃতায় বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', তখন তা কেবল একটি সাধারণ বক্তৃতা বা ভাষণ না হয়ে তা হয়ে ওঠে আমাদের চেতনায় মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের এক স্মারকস্তম্ভ, হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক এক দলিল- রাজনীতির ইতিহাসে অমর একটি কবিতা যার নাম। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ মুজিবের শ্রেষ্ঠতম কবিতা। কালোত্তীর্ণ ও তেজোদীপ্ত এই ভাষণ সমকালীন বিশ্বের ইতিহাসে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ যেমন একটি অমর কবিতা, তেমন রেসকোর্সের ময়দানে এই ভাষণদানরত ঐতিহাসিক মুহূর্তটিরও রয়েছে বৈপ্লবিক ও নান্দনিক আবেদনের সমাহার। তাই তো রাজনীতির কবি বলা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বাঙালি জাতি, বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি নির্মাণে তিনি রেখেছেন এক অবিস্মরণীয় অবদান, উপহার দিয়েছেন বাঙালি জাতি। একজন অবিসংবাদিত নেতাকে ইতিহাসের এক নির্মম ঘটনায় আমরা হারিয়েছি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, ইতিহাস কি নেতা তৈরি করে, না নেতা ইতিহাস তৈরি করে- এ বিতর্কটি এখনও অবিসংবাদিত। সেই পাল রাজাদের আমল থেকে সেন রাজা, স্বাধীন সুলতানি আমল, মোগল আমল, মুর্শিদাবাদের নবাবি আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল, শেখ মুজিব ও স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়- এই দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যাবে, নদীর মতোই ইতিহাস তার নিজস্ব স্রোতের গতিতে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে, পুরোনো অনেক কিছু ভেঙেছে আবার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের গতিপথ কখনও সরলরেখায় এগোয়নি। কেউ কেউ ভুল পথে এগিয়ে পদস্খলিত হয়ে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ নতুন ইতিহাস সৃষ্টিতে সফল হয়েছে। আধুনিক যুগের বাংলা গড়ায় যে নতুন রাজনীতির সূচনা করে গেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শেরেবাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম ও মওলানা ভাসানী, তাকে বৈপ্লবিক সমাপ্তিতে টেনে আনার বিরাট কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি ইতিহাসের সন্তান। নিজে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগে পাকিস্তানের দুই আমলের জন্য দুই অর্থনীতি অনুসরণের সে আন্দোলন শুরু হয়; সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন শেখ মুজিব। এই পর্যায়গুলোতে কখনও তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কখনও নিজের সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক করার কাজে এগিয়ে গেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও ৬ দফা আন্দোলনে কারা নির্যাতিত হয়েছেন, জেলে বসে বামপন্থি সহবৃন্দদের কাছে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে দীক্ষা নিয়েছেন এবং এ দুটি আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর চার দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাঁর রাষ্ট্রভাবনা ও স্বাধীন বাংলার রূপকল্প তৈরি করেছিলেন এবং সেই রূপকল্পের ভিত্তিতেই তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে পূর্ণ স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দেশবাসীকে ডাক দিয়েছিলেন।
গণসঙ্গীত শিল্পী