তোফায়েল আহমেদ
শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের গণরায় নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আজ ভাবতে ভালো লাগে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে রক্তঝরা পথ ধরে আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সে সব কিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সেল ছিল ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান- যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।
প্রতি বছর বাঙালি জাতির জীবনে জানুয়ারি মাস ফিরে এলে ১৯৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলি আমার স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। আমার জীবনেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ১৯৬৯ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। এই কালপর্বে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। জীবনের সেই সোনালি দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। অনেক সময় ভাবি, কী করে এটা সম্ভবপর হয়েছিল।
১৯৬৯-এর জুনে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। ছাত্রলীগের সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি ছিলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যেও। এই ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অনেক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাদের নেতৃত্ব দিতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে মুজিব বাহিনীর ৪টি সেক্টরের একটির ৮টি জেলার অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের সুযোগ অর্জন করেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দেন আমি তখন ইকবাল হলের সহসভাপতি। ইকবাল হলে বসেই ৬ দফার পক্ষে আমরা আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমার কক্ষ নম্বর ছিল ৩১৩। এই কক্ষে প্রায়ই থাকতেন শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক। ৬ দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ অর্থাৎ এই ৬ দফার সিঁড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতায় পৌঁছবেন। ৬ দফা দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ঝটিকা সফর করে ৩২টি জনসভা করেন এবং বিভিন্ন জেলায় বারবার গ্রেপ্তার হন।
শেষবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকা আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর ১৯৬৬-এর ৭ জুন আমরা যে হরতাল পালন করেছিলাম, তার পরিকল্পনা আমার কক্ষে বসেই হয়েছিল। ১৯৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেপ্তার করা হয়। আমার সৌভাগ্য ওইদিনই ডাকসুর ভিপি হয়েছিলাম। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে বঙ্গবন্ধু চিঠি লিখে বিশ্বস্ত এক কারারক্ষীর মাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন; চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘স্নেহের তোফায়েল, তুই ডাকসুর ভিপি হয়েছিস, এ কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে।
বিশ্বাস করি এবারের এই ডাকসু বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে।’ জেলগেট থেকে গ্রেপ্তার করে প্রিজনভ্যানে তোলার প্রাক্কালে এক টুকরো মাটি কপালে ছুঁইয়ে বলেছিলেন, ‘হে মাটি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ওরা যদি আমাকে ফাঁসি দেয় আমি যেন মৃত্যুর পর তোমার বুকে চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে পারি।’ প্রথমে আমরা জানতাম না প্রিয়নেতা কোথায় কীভাবে আছেন। আমরা ছাত্রসমাজ এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে মিছিল করি।
১৯৬৮-এর ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যে দিন শুরু হয়, সে দিন থেকে আমরা জানতাম আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদ- দেবে। কারণ, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান উপলব্ধি করেছিল, সবাইকে বশে আনা যায় কিন্তু শেখ মুজিবকে বশে আনা যায় না। তাই আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই একটি কণ্ঠকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে হবে। কেননা, একটি কণ্ঠে কোটি কোটি কণ্ঠ উচ্চারিত হয়। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা।
ডাকসুসহ ৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আমার কক্ষে বসেই আমরা ১১-দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আজ যখন স্মৃতিকথা লিখছি বারবার মনে পড়ছে ১৯৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতা- ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আব্দুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফের একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এই ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান।
আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী। ১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১১ দফা প্রণয়নের পর এটাই আমাদের প্রথম কর্মসূচি। এর আগে আমরা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন বটতলায় আমরা সমবেত হলাম। মাত্র শ’পাঁচেক ছাত্র জমায়েত হয়েছিল।
যদিও কলাভবনের বারান্দা এবং অন্যান্য স্থানে দূর থেকে দাঁড়িয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী আমাদের কার্যক্রম অবলোকন করছিল। হয়তোবা আমাদের সংগ্রামের সফলতা নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তারা উপলব্ধি করতে পারছিল না যে, আজকের এই পাঁচশ আগামীতে রাজপথে পাঁচ হাজার থেকে লাখে লাখে পরিণত হয়ে গণঅভ্যুত্থান সফল করবে। আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সভাপতি হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেয়ার যে আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব কি ভাঙব না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এমনকি গুলিও চলতে পারে, গ্রেপ্তার তো আছেই।
জমায়েতে উপস্থিত ছাত্রদের চোখেমুখে ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ়তা। যারা বক্তৃতা করছিলেন প্রায় সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে শ’পাঁচেক ছাত্র নিয়ে রাজপথে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। আমরাও যতদূর সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। শুরু হয় কাঁদানে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলে আহত হন। পরদিন ১৮ জানুয়ারি, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও শনিবার ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি দেই।
১৮ জানুয়ারি, বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সফল ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খ- খ- মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ অবাক হয়ে লক্ষ করলাম গতকালের চেয়ে আজকের সমাবেশ বড়। সে দিনও বাইরে ১৪৪ ধারা। যথারীতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করল। পরদিন ১৯ জানুয়ারি ছিল রবিবার। সে সময় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত।
কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। কর্মসূচি নেয়া হলো আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল শুরু করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। রবিবার আমরা ওখান থেকেই মিছিল শুরু করি। শুরু হয় লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস। কিছুই মানছে না ছাত্ররা। আজ আর মানতে চাইছে না কিছুই। শঙ্কাহীন প্রতিটি ছাত্রের মুখ। গত দুদিনের চেয়ে মিছিল আরো বড়। পুলিশ শেষ পর্যন্ত গুলি চালাল। একজন ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ল রাজপথে। ছাত্রলীগের এই কর্মীর নাম আসাদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি দিনাজপুর। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ২০ জানুয়ারি সোমবার পুনরায় বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দিলাম। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের ইতিহাসে মাইলফলক। এ দিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট! প্রথমদিন শুরু করেছিলাম শ’পাঁচেক নিয়ে, আজ কয়েক সহস্র, যেন জনসমুদ্র। তিনদিনে আমরা সাধারণ ছাত্র ও বিপুলসংখ্যক জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি।
আরো লক্ষ করি, বটতলায় শুধু ছাত্র নয়, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও ভিড় করেছে। তারা সংগ্রামের কর্মসূচি চায়। আসাদুল হকের রক্তের প্রতিশোধ চায়। আমরা ভাবতেও পারিনি এত বেশি সংখ্যক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করবে। যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখনো দলে দলে মানুষ আসছে। সভাপতির ভাষণে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণায় বলেছিলাম, ‘যতদিন আগরতলা মামলার কার্যকলাপ ধ্বংস করে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে মুক্ত করতে না পারব, ততদিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।’ মুহূর্তে ফুঁসে উঠল মিছিল! কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! লাখো মানুষের ঢল নেমে এল রাজপথে।
আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝখানে। মিছিল যখন আগের কলাভবনের (বর্তমান মেডিকেল কলেজ) সামনে ঠিক তখনই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলী, আসাদুজ্জামান ও আমি, আমরা তিনজন একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করেই এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোড়ে। গুলি আসাদুজ্জামানের বুকে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়েন আসাদ। আমি আর খালেদ আসাদকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজে নেয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একজন শহীদের শেষ নিঃশ্বাসটি আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মৃত্যু এত কাছে হাতের ওপর! আমার শরীর তখন আগ্নেয়গিরির লাভায় পরিণত! মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হয়।
২১ জানুয়ারি অর্ধদিবস হরতাল এবং হরতালের পর পল্টনে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২১ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত হরতালের কর্মসূচি পালনকালে চারদিক থেকে স্রোতের মতো মানুষের ঢল নামে পল্টন ময়দানে। এ দিনও মাইক, মঞ্চ কিছুই ছিল না। পল্টনে চারাগাছের ইটের বেষ্টনীর ওপর দাঁড়িয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়। বক্তৃতার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি : ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালোব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল। ২৪ জানুয়ারি দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল।
এরপর মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তৎকালীন ন্যাপ নেতা, পরে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মহিউদ্দীন আহমদ ও কারগারের বাইরে থাকা নেতাদের উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২০ জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সে আন্দোলনের সফল পরিণতি- বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেয়ার আইয়ুব খানের ষাড়যন্ত্রিক পরিকল্পনাকে বানচাল করে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১০ লক্ষাধিক লোকের বিশাল জনসমুদ্রে গণসংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
সেই সভায় দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের উদ্দেশে স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছো, যদি কোনোদিন পারি নিজের রক্ত দিয়ে আমি সেই রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’ তিনি একা রক্ত দেননি, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ তিনি শোধ করে গেছেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি নিয়ে জাতির পিতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে ছিলেন।
তাঁর দুটি লক্ষ্য ছিল- এক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা; দুই. ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা কায়েম করা। একটি তিনি সফলভাবে সমাপ্ত করেছেন। দ্বিতীয়টি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলার মানুষের গণরায় নিয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে দক্ষতা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। আজ ভাবতে ভালো লাগে, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের যে রক্তঝরা পথ ধরে আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, সে সব কিছু অর্জনের ড্রেস রিহার্সেল ছিল ১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান- যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য।