১৯৬৪ সালে ঢাকায় এসেছিলেন প্রথম। রজার গোয়েন প্রেমে পড়েছিলেন এই ভূখণ্ডের। সেই ভালোবাসার টানেই ১৯৭১ সালে রজার কাজ করেছেন লন্ডনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যুক্তরাজ্যের গ্লস্টারশায়ারের বাসিন্দা রজার গোয়েন ১৯৭১ সালে তাঁর কর্মকাণ্ড এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের গল্প লিখেছেন বাংলায়।
১৯৭১ সালে ব্রিটেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সমর্থন আন্দোলনে আমার অংশগ্রহণ। ১৯৬৪ সালে আমি প্রথম পূর্ব বাংলায় গিয়েছিলাম। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেএকটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজ করি। পরবর্তী সময়ে আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিই। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালে আমি বার্মিংহামের একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করি এবং সেই সময় আমি একজন বাঙালি জাহাজির বাড়িতেই ভাড়া থাকতাম। এভাবেই বার্মিংহামের বাঙালি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
১৯৭০ সালে বার্মিংহামে পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নামের একটি সংগঠন ছিল। তাদের মধ্যে আজিজুল হক ভুইয়া ও মো. ইসমাইল আজাদ ছিলেন অন্যতম। ওই দলের সঙ্গে আমার কিছু যোগাযোগ ছিল এবং আমি তাঁদের নিউজলেটার পড়তাম।
ক্ল্যারিজ হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে লন্ডনে আন্দোলন শুরু হয়। বার্মিংহামের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমিও যোগ দিই। তাজুল হকের নেতৃত্বে দ্য বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গড়ে উঠে বার্মিংহামে। আমি ওই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম শুরু থেকে। জগলুল পাশা, ইসমাইল আজাদ ছিলেন অন্যতম সংগঠক।
এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমি বিভিন্ন মিছিলে যোগ দিই। ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মকালে আমি চাকরি ছেড়ে দিই এবং আমি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি (বিডিএসি), বার্মিংহামে দপ্তর সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই। আমার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং সংগঠনের মিটিং আয়োজন করা। আমি প্ল্যাকার্ড তৈরি করতাম এবং বিভিন্ন মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন ও আন্দোলনে তরুণ কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশ মুকুল ফৌজ নামের একটি যুব সংগঠন গড়ে তুলি। যেটি বার্মিংহামে অ্যাকশন কমিটির সহযোগী হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ মুকুল ফৌজের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সুজাক আলী, আবদুল মান্নান জামাল খান, ওয়ালি আহাদ, গিয়াসউদ্দিন ইসলাম, হুসাইন আহমদ, মহিবুর রহমান, একলাস উদ্দিন, মুকিমুদ্দিন।
বিডিএসি ও বাংলাদেশ মুকুল ফৌজের লোগো, পোস্টার, মিছিলের ব্যানার আমাকেই করতে হয়। মহান নেতা শেখ মুজিবের একটি ছবি নিয়ে হাতে লিখে কোলাজ পোস্টার তৈরি করেছিলাম। পোস্টারে লিখি ‘বাঙালির জয় হবেই, ইতিহাস আমাদের অনুকূলে’। যে কথাটি আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম।
অন্যান্য অ্যাকশন কমিটির মতোই বার্মিংহামের বিডিএসি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ফান্ড’-এর জন্য চাঁদা তুলতো। বিডিএসির কর্মীরা বাঙালিদের ঘরে ঘরে যেতেন ও চাঁদা আদায় করতেন। বাংলাদেশ ফান্ডের পয়সাগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হতো। সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবকদের কিছু নাম আমি তুলে ধরছি। খলিলুর রহমান, আহসান ইসমাইল ও আমিন উদ্দিন।
১৯৭১-এর অক্টোবরে গ্রানাডা টেলিভিশনের একটি দল পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র করার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিল। তারা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় দোভাষী হিসেবে। দলটি মাদারীপুর জেলার একটি স্বাধীন এলাকা পরিদর্শন করে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা!
অক্টোবর ১৯৬৯; বার্মিংহামের ডিগবিথ হলে আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বিলেত সফরে আসেন। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কাছ থেকে তাঁকে দেখার। শেষ অবধি আশা পূরণ হয়নি, আকস্মিক সমস্যায় আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আফসোস ছিল খুব। আলোকচিত্রী ইউসুফ চৌধুরী সেই ঐতিহাসিক জনসভার ছবি তুলেছিলেন দেখেছি। বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেলাম আমরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। মনে ভয় ছিল তখনো স্বাধীনতার মহান স্থপতি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তাঁকে মেরে ফেলা হবে—এমন খবর নানা সময় চাউর হতো, আমরা হতাশায় ভুগতাম।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২; বেলা ১১টার দিকে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছেছেন। তড়িঘড়ি করে লন্ডনে রওনা হই। দুপুরে ক্ল্যারিজ হোটেলে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনের পর নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছিল। বিলেতে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অনেকেই আমাকে চিনতেন। হোটেলে ঢুকতে তাই তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। হোটেল রুমে গিয়ে দেখা পাই বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরেন। সেই অনুভূতি লিখে বলে বোঝানোর ন
আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মূহূর্তের একটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই দেখা।
লন্ডন, ১৯৭১: ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট দলের টেস্ট ম্যাচ বাতিলের দাবিতে মিছিল। ছবি: রজার গোয়েন