আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে মুজিব: মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার
আলজিয়ার্সের একমাত্র ইংরেজি পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মুজিব সম্পর্কে প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। এম আর আখতার মুকুল বঙ্গবন্ধুর সেই সফর নিয়ে তার বইতে বিস্তারিত লিখেছেন।
১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় রাষ্ট্র আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ছোটবড় সব পাহাড়ি টিলার কোল ধরে গড়ে উঠেছে ইতিহাসের স্মৃতি-বিজড়িত এই মহানগরী। আলজিয়ার্স নগরীর পশ্চাৎ প্রদেশে রয়েছে ছোট ছোট জনপদ আর অসংখ্য আঙ্গুরের গাছ। এসব আঙ্গুর থেকেই তৈরি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মদ। আলজেরিয়ার প্রধান রপ্তানি ছিল বিভিন্ন ধরনের ওয়াইন আর খনিজ সম্পদ। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এসবের প্রচুর চাহিদা। শুধু আলজেরিয়া না অধিকাংশ ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর চিত্র একই রকম।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্স নগরীতে আয়োজিত চতুর্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তার সাথে ছিল উচ্চ পর্যায়ের একটা প্রতিনিধি দল। এ আলজিয়ার্স নগরীর সমুদ্র সৈকতে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের আমলে তৈরি করা হয়েছিল প্রায় শতাধিক কটেজ। প্রতিটি কটেজে রয়েছে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে সর্বাধুনিক আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা, এমনকি স্বয়ংসম্পূর্ণ বার। প্রতি কটেজেই থাকতো জনাকয়েক সুন্দরী কসবী। ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিপুল অর্থ ব্যয়ে এসব কটেজ তৈরি করেছিল। তাদের জেনারেলদের মনোরঞ্জনের জন্য।
বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশ বিমানে তার প্রতিনিধি দলসহ আলজিয়ার্স নগরীতে পৌঁছান তখনও সম্মেলন শুরু হতে একদিন বাকি ছিল। এর মধ্যেই রাজধানী আলজিয়ার্স এক উৎসব মুখরিত নগরীতে পরিণত হয়েছিল। প্রতি ঘণ্টায় বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের ভিআইপিরা এসে অবতরণ করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার নিখুঁত ব্যবস্থা। বিমানবন্দরে উড়ছিল ৯২টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় পতাকা। শত ব্যস্ততার মাঝেও বিমানবন্দরে স্বয়ং উপস্থিত থেকে প্রেসিডেন্ট বুমেদীন দারুণভাবে সংবর্ধনা জানালেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরদিন সকালে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু-বুমেদীনের কোলাকুলির ছবি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য লাভ করেছিল।
আলজিয়ার্স নগরীর উপকণ্ঠে এক বিশাল কনফারেন্স হলে নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেই মোট ৯২টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রশাসনিক প্রধানরা এসে পৌঁছেছিলেন। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাড়াও এদের মধ্যে যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো; সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল, মরক্কোর বাদশা হাসান, ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসী, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিবরগুইবা, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, পিএলও প্রধান ইয়াসির আরাফাত, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহাত, কাপুচিয়ার প্রিন্স রাদম সিহানুক, নাইজেরিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, উগান্ডার ইদি আমিন, কিউবার। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, নেপালের রাজা বীরেন্দ্র, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েক এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অন্যতম। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনের সদস্য নয় এবং এদের সদস্য লাভের বারবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এক অবিশ্বাস্য ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝ দিয়ে। তিন ধরনের পরিচয়পত্র দেখিয়ে কর্মকর্তাদের যথাসময়ে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করতে হয়েছিল। কনফারেন্স হলের অদূরেই আলজেরিয়া বিমান বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে একটি রানওয়ে-তে তিনটি মিগ যুদ্ধ বিমান স্টার্ট নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্বে দাঁড়িয়েছিল। এছাড়াও হলের সামনে হেলিপোর্টে সবসময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল আরও তিনটি হেলিকপ্টার।
সম্মেলনে যোগ দেওয়া কোনও ভিভিআইপিকে ইসরায়েলি কিংবা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের অপহরণের সম্ভাব্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার লক্ষ্যে এই অতিরিক্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছিল। সম্মেলনের শুরুতেই বিভিন্ন দেশের নেতাদেন পরিচয় করিয়ে দেন সম্মেলনের সভাপতি ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদীন। একজন করে নেতা মঞ্চে এসে দাঁড়াবার পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীন ক্ষুদ্র বক্তৃতায় এদের পরিচয় করিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে হলে উপস্থিত সমস্ত প্রতিনিধিরা করতালির মাঝ দিয়ে জানিয়েলেন উষ্ণ অভিনন্দন। পিএলও-প্রধান ইয়াসির আরাফাতের পরিচিতির সময় করতালি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির পর সম্মেলন কক্ষে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালি পোশাকে শ্বেতশুভ্র পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরিহিত প্রায় ছ'ফুটের এক হিমাচল সদৃশ ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব। মুখে শিশুর সরল হাসি। সম্মেলন কক্ষের প্রতিটি মানুষ আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলেছিল, সে করতালি যেন আর থামার নয়। এভাবেই সেদিন বিশ্ব নেতারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জানালেন হৃদয়ের প্রাণঢালা সংবর্ধনা। তিন মিনিটের বেশি সময় ধরে এক নাগাড়ে করতালির পর প্রেসিডেন্ট বুমেদীনের ইশারায় সবাই আবার আসন নিয়েছিলেন। গর্বে উপস্থিত বাঙালিদের বুক ফুলে উঠেছিল।
এম আর.আক্তার মুকুলের ভাষ্যে, "সেদিন প্রতি মুহূর্তে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, এ দুনিয়ায় বাঙালি হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় জীবন আমার সার্থক।"
অসংখ্য নৈশ ক্লাব আর ক্যাবারের নগরী আলজিয়ার্সের একমাত্র ইংরেজি পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী মুজিব সম্পর্কে প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল।
শিরোনাম ছিল, "The leader without beard; neither visits any night club nor touched drinks In Life." (দাড়িবিহীন নেতা: যিনি জীবনে কোন নৈশ ক্লাবে যাননি কিংবা মদ স্পর্শ পর্যন্ত করেননি।)
সেবারের জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনের আয়োজনে এবং বিভিন্ন দেশের নেতাদের আদর-আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোথাও কোন ত্রুটি ছিল না। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। আলজিয়ার্স-এর সমুদ্র সৈকতে ফরাসি জেনারেলদের পরিত্যক্ত কটেজগুলো নবরূপে সজ্জিত করে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের নেতাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবের জন্যও নির্দিষ্ট হয়েছিল এই ধরনের একটি সুদৃশ্য কটেজ। নিরাপত্তার খাতিরে এ বিশেষ এলাকায় সম্মেলন চলাকালীন টুরিস্ট কিংবা স্থানীয় জনসাধারণের জন্য সমুদ্র স্নান ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার বিজ্ঞপ্তিতে আলজিয়ার্সকে প্রায় লক্ষাধিক পর্যটক মুক্ত করা হয়েছিল।
অভ্যাস অনুযায়ী খুব ভোরে একজনমাত্র নিরাপত্তা কর্মী আর দোভাষী মহিলাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মুজিব প্রাত:ভ্রমণ শেষ করে তার কটেজ-এ ফিরে এসেছেন। তারপর দেখেন বিরাট আকারের এক মটর ভ্যান কটেজ-এর সামনে দাঁড়িয়ে। বুকে নিরাপত্তা কর্মীর ব্যাজ লাগানো দুজন কর্মী তালিকা মিলিয়ে নানা ধরনের খাবার-দাবার, টিন ফুড, মাছ মাংস—এমনকি টাটকা শাক-সবজি আর ফল-মূল পর্যন্ত নামিয়ে রাখছে। শেষ আইটেম ছিল কয়েক ক্রেট পানীয়। ক্রেটগুলো নামাবার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু খুবই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বিকট এক চিৎকার দিয়ে দোভাষী মহিলাকে তর্জনী তুলে বললেন, “এই কটেজ-এ একমাত্র কোকাকোলা-সেভেন আপ ছাড়া বিয়ার, হুইস্কি, ভোদকা, জিন, রাম, রেডওয়াইন কিছুই সরবরাহ করা যাবে না।”
অবাক বিস্ময়ে দোভাষী মহিলার চোখ জোড়া একেবারে ছানাবড়া। জীবনে বহু ভিআইপির সঙ্গে দোভাষীর কাজ করা সত্ত্বেও এ ধরনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কী আশ্চর্য, প্রধানমন্ত্রী মুজিবের গালে দাড়ি আর মাথায় টুপি কোনওটাই নেই। অথচ কী ভয়ংকর ইসলামী নীতিবোধ! শেখ সাহেবের রাগের বহির্প্রকাশে দোভাষী মহিলা আমতা আমতা করে বার কয়েক ঢোক গিললেন। এরপর স্থানীয় দেহাতী ভাষায় কর্মী দুজনকে বুঝিয়ে বললেন মদের ক্রেটগুলো ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। তারা দুজন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে হুকুম তামিল করল। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রতিদিনকার অধিবেশনের পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বিভিন্ন বিশ্ব-নেতাদের মধ্যে সৌজন্য সাক্ষাৎকার আর একান্ত বৈঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কুশলাদি বিনিময় করলেন।