শামসুল হক

এম আর মাহবুব
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, লেখক ও ভাষাসৈনিক শামসুল হক আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আজ তার জন্মশত বার্ষিকী। ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলাধীন এলাসিন গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শামসুল হক।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরপরই কিছুসংখ্যক প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী একত্রিত হয়ে গঠন করেন গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এরা বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করার কথা বলেন। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শামসুল হক।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যে বৈঠক হয় শামসুল হক সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ওই বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

শামসুল হক ওই সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী হরতাল পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ওই কর্মসূচি সফল করার জন্য ৩ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ১৪ জন জননেতার যুক্ত স্বাক্ষরে একটি বিবৃতি পত্রিকায় প্রেরিত হয়।

এই বিবৃতিতে শামসুল হক স্বাক্ষর করেন (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ মার্চ ১৯৪৮)। হরতাল কর্মসূচিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিভিন্ন রকম প্রস্তুতিমূলক কাজে শামসুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতেও শামসুল হক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

১১ মার্চ হরতাল চলাকালে শামসুল হক মিছিল ও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এক পর্যায়ে আবদুল গণি রোডে সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটে তিনি কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। তার সঙ্গে পুলিশের তর্কবিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে তিনি পুলিশের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন এবং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা চুক্তি স্বাক্ষর হলে চুক্তির শর্তানুসারে অন্যান্য বন্দির সঙ্গে শামসুল হক মুক্তি লাভ করেন। ১৬ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদ ভবনের সামনে ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং ১৫ মার্চ স্বাক্ষরিত চুক্তি সংশোধনের দাবিতে পিকেটিং ও সভা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শামসুল হক ওই পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন।

১৯ মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নার ঢাকায় আগমনের পর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এতে ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি দল ২৪ মার্চ রাতে জিন্নাহর সঙ্গে দেন-দরবারে মিলিত হন। ওই প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন শামসুল হক।

ভাষা আন্দোলনে শামসুল হকের সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি তার নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং নিজ এলাকায় ভাষা আন্দোলন সংগঠনে কাজ করেন। টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে শামসুল হক জয়ী হন।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে, যেসব বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক নেতা আন্দোলনের মাধ্যমে নাজিমুদ্দীনের চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, শামসুল হক তাদের মধ্যে অন্যতম।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, শামসুল হক তাতে যোগদান করেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি আদায়ের জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন।

এই বৈঠকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং শামসুল হক তাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিনিধি হিসেবে অন্যতম সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হন। ১ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পথসভা, মিছিলসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট, ৬ ফেব্রুয়ারির সভা, ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালনসহ অন্যান্য কর্মসূচিকে শামসুল হক প্রাণান্ত পরিশ্রম করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন সার্থক করে তোলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শামসুল হক ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের হরতাল কর্মসূচিকে সামনে রেখে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার ১ মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন।

এ সময় করণীয় বিষয় নির্ধারণের জন্য ৯৪নং নওয়াবপুর রোডের আওয়ামী মুসলিম লীগের সদর অফিসে প্রধান নেতা আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, শামসুল হক ওই বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা সমীচীন হবে না বলে মত দেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের যুক্তিগুলো ছিল প্রথমত, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে, দ্বিতীয়ত, গোলযোগের সরকার প্রস্তাবিত সাধারণ নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার গর্ভে নিক্ষেপ করবে; তৃতীয়ত, ধ্বংসাত্মক রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে’।

২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতার সমাবেশে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখার জন্য শামসুল হক সেখানে আসেন। এবং ১৪৪ ধারা না ভাঙার জন্য বক্তব্য রাখেন। ছাত্ররা সে বক্তব্য গ্রহণ করেনি। পরে সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা ১০ জন করে রাজপথে নেমে আসেন।

বেলা ৩টা থেকে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং সৃষ্টি হয় মহান একুশের রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও ছাত্র হত্যার পর শামসুল হক আন্দোলনের পক্ষে চলে আসেন এবং চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে নানা কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পর প্রথম যে রাজনৈতিক ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভাষা শহীদদের মরদেহ দেখতে আসেন তিনি হলেন শামসুল হক। পুলিশ বহু চেষ্টা করেও শামসুল হককে গ্রেপ্তার করতে না পেরে তিনিসহ ৯ জন শীর্ষ পর্যায়ের ভাষাসৈনিকের নামে ২ মার্চ হুলিয়া জারি করে গেজেট প্রকাশ করা হয (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা : ৩ মার্চ ১৯৫২)।

হুলিয়া জারির পরও কয়েকদিন শামসুল হক আত্মগোপন করে থাকেন। অবশেষে ১৯ মার্চ ১৯৫২ তারিখে তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বীর সেনানী শামসুল হক শেষ জীবনে সর্বহারা হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং অত্যন্ত অসহায় ও নির্মমভাবে তার মৃত্যু হয়।

দীর্ঘদিন তার মৃত্যু ও সমাধি সংক্রান্ত তথ্যাবলি ছিল অজানা ও রহস্যাবৃত। সম্প্রতি তার মৃত্যুর তারিখ ও সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যায়। সে অনুযায়ী শামসুল হক ১৯৬৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ভাষা আন্দোলন এবং এ দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন।

এম আর মাহবুব : নির্বাহী পরিচালক, ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর।

SUMMARY

234-1.jpg