ঝর্ণা মনি
অগ্নিঝরা একাত্তরের ২৬ মার্চ। সকাল ৮টায় একটি তারবার্তা পান পাবনার শাহজাদপুরের ওসি মো. আব্দুল হামিদ। তারবার্তাটির ওপরে ডানপাশে নীল কালিতে গ্রহণকারীর স্বাক্ষর, তারিখ ও সময় উল্লেখ রয়েছে। বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের অনন্য দলিল সেই তারবার্তাটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা, যে তারবার্তার মাধ্যমে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈনদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে জাতিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুমুক্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তার একটিমাত্র কপি সংরক্ষিত রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদের পরিবারের কাছে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ ওই তারবার্তাটি বুকে আগলে রেখেছেন তারা।
সম্প্রতি রাজধানীর পূর্ব বাসাবোর কদমতলায় নিজ বাসভবনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ভোরের কাগজের। আব্দুল হামিদের স্ত্রী জীবন নেছা হামিদ বলেন, ২৬ মার্চ জনগণকে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াতে দেখে মনে হলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। রাতে আমার স্বামী বাসায় ফিরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তার খবরটি জানায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাফেজখানা থেকে প্রকাশিত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা এবং ওসি আব্দুল হামিদের গ্রহণ করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের আগে বাংলার মাটি রক্তে রাঙিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর পান উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার ও লে. কর্নেল এ আর চৌধুরীর মাধ্যমে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠিয়ে দেন। পরদিন ২৬ মার্চ এই ঘোষণা সব থানা ও ইপিআর ক্যাপম্পগুলোতে পৌঁছে যায়। শাহজাদপুর থানার তৎকালীন ওসি আব্দুল হামিদ ওই তারবার্তাটি পান।
আব্দুল হামিদের স্ত্রী জীবন নেছা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৮ মার্চ সে (আব্দুল হামিদ) যুদ্ধে চলে যায়। নয় নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধের দিনগুলোতে তার কোনো খোঁজ আমি জানতাম না। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে ছিলাম। ভয়ঙ্কর দিন কাটিয়েছি। এদিকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ায় ১৬ জুলাই তাকে পাকিস্তান সরকার চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আসাদনগর (শরণখোলা) থানায় যোগ দেয়।’
আব্দুল হামিদ মারা যান ২০০৭ সালের ৭ জুন। মৃত্যু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর তারবার্তাটি যত্নে রেখেছিলেন তিনি। জীবন নেছা বলেন, বঙ্গবন্ধুর তারবার্তার মূল কপি মৃত্যুর আগপর্যন্ত আমার স্বামীর কাছে সংরক্ষিত ছিল। ২০০০ সালের ৩০ অক্টোবর মূল কপিটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটে সংরক্ষণের জন্য দান করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তারা এটি হারিয়ে ফেলে। তারবার্তাটির স্ক্যান করা কপি আমাদের কাছে রয়েছে। আমি ও আমার সন্তানরা প্রায়ই এই তারবার্তাটি দেখি এবং ইতিহাসকে স্পর্শ করি। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য এই সম্পদটির কপি আমরা কোনো জাদুঘর বা ব্যক্তিকে দিতে চাই যা আর কখনো কারো গাফিলতির কারণে হারাবে না।
আব্দুল হামিদের ছোট ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, আমার বাবাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুদ্ধের সময়ও তারবার্তাটি সংরক্ষণে রেখেছিলেন। যুদ্ধের পরও জাতির অমূল্য সম্পদটি বুকে চেপে রেখেছেন। হারাতে দেননি। আমরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভেবে মূল কপিটি সরকারের দায়িত্বশীল জায়গায় হস্তান্তর করেছিলাম। অথচ তারাই হারিয়ে ফেললেন।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, হাইকোর্টে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত রায় লেখার সময় ওই তারবার্তার খবর পেয়ে বিচারপতি খায়রুল হক তারবার্তাটি আদালতে পেশ করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি বলে জানায়। এই অমূল্য দলিলটি কি বিএনপি-জামায়াত আমলে গায়েব হয়ে গেল নাকি ভালো করে খোঁজা হয়নি, এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পাঁচ দশকে একাধিক সনদ, স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাননি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ। জীবদ্দশায় তো জোটেইনি, মৃত্যুর প্রায় দেড় দশক পরও রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। অথচ বাগেরহাটের মধ্য খোন্তাকাটা গ্রামের দলিল হাওলাদরের ছেলে আব্দুল হামিদকে মুুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতিস্বরূপ দুই বছরের পদোন্নতিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা উল্লেখ রয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশবাহিনী’সহ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লেখা একাধিক গবেষণাগ্রন্থে।
ছোট ছেলে ইশতিয়াক আহমেদ জানান, সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ অবসর নেন ১৯৯০ সালে। জীবদ্দশায় ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে সনদ পান। ২০০০ সালে মুক্তিবার্তায় (লালবই) নাম অন্তর্ভুক্তি দেখে যান। মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ২০০৫ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে সনদ দেয় এবং ওই বছরের ২৩ মে মুক্তিযোদ্ধা গেজেট তালিকায় তার নাম ওঠে। গেজেট নম্বর ১৩৮১। পরে তার পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাগেরহাট মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বিতরণ জেলা কমিটি ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী জীবন নেছার নামে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বরাদ্দ করে (সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-মুক্তি ৪৫২ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পরিশোধ বহি নম্বর-৪১৪)। এরপরও ভাতাবঞ্চিত তারা।
জীবন নেছা বলেন, বরাদ্দ তালিকায় নাম ওঠার পর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাগেরহাটে সোনালী ব্যাংকের রায়েন্দাবাজার শাখায় সম্মানী ভাতার হিসাব খোলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ব্যাংক হিসাবে কোনো অর্থ যায়নি। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়সহ স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমার মায়ের বয়স এখন ৮০ বছর। বাবা জীবদ্দশায় এ সম্মানী পাননি। মাও পাবেন কি না জানি না।
জীবন নেছা বলেন, মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আমি কখনো কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেইনি। এখন পর্যন্ত কোনো সম্মানী ভাতাও পাইনি। ভাতা বড় কথা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আমার ছেলেমেয়েরা সবাই ভালো চাকরি করছে। কিন্তু তারা তাদের বাবার স্বীকৃতি চায়। আমার নাতি-নাতনিরা তাদের দাদুর স্বীকৃতি চায়।
সুত্র: ভোরের কাগজ, প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২০