১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরেছেন বঙ্গবন্ধু। জনসভা ও পথসভা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রমুখ। কিশোরগঞ্জ সদরের বটতলায় অবস্থিত স্টেডিয়ামেও ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই জনসভার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জেলা গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ভূপেন্দ্র ভৌমিক বলেন, তখন আমরা ছোট। জনসভায় শেখ মুজিব কী বলেন, শুনতে দুপুরেই স্টেডিয়ামে চলে যাই। দুপুর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সাধারণ মানুষ দলে দলে স্টেডিয়ামে আসতে থাকে। তাঁকে একনজর দেখতে কী ব্যাকুল মানুষ! বিকেলের আগেই স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যায়। অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরায় না। অবশেষে একটি গাড়িতে চড়ে তিনি এলেন, তখন রাত হয়ে গেছে। তার পরও মানুষের উত্সাহের কমতি নেই। এত মানুষ জড়ো হয়েছিল যে সবাই ভেতরে যেতে পারেনি। ওই জনসভায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তখনকার ছাত্রলীগ নেতা অ্যাডভোকেট এম এ আফজলও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিভাবে বাঙালির সঙ্গে প্রতারণা করছে তার বর্ণনা দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সবাইকে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান। সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা শেষে তিনি করিমগঞ্জ স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল কদ্দুসের নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেন।’
জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান সত্তরের নির্বাচনের সময় হাওরাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই দিনের নির্বাচনী সফরে সঙ্গী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত অক্টোবর মাসের ঘটনা। কুলিয়ারচরে নির্বাচনী সভা করে পরের দিন লঞ্চযোগে বঙ্গবন্ধু হাওরে নির্বাচনী সফর শুরু করেন। জাতীয় পরিষদের প্রার্থী বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অনুরোধে আমিও তাঁর সঙ্গে কুলিয়ারচর যাই। অষ্টগ্রামের বাঙ্গালপাড়ার সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের চাতলপাড় যান। উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর বাড়ি গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর আশীর্বাদ নেন। বঙ্গবন্ধুকে আদর করে তিনি বলেছিলেন, ‘হয়তো তোমাকে ভোট দেওয়ার জন্যই আমি বেঁচে আছি।’ পরে সেখান থেকে অষ্টগ্রাম বাজারে একটি জনসভায় যান। সেখানেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এরপর বাজিতপুরের দীঘিরপার ও নিকলীতে লঞ্চে মাইক লাগিয়ে জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। পরের জনসভা মিঠামইনে। সেখানে মঞ্চ করা হয়েছিল। মঞ্চে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতারা বক্তব্য দেন। সেখান থেকে ইটনার দেওয়ানবাড়িতে রাতে আরেকটি নির্বাচনী জনসভা হয়। স্থানীয় ডাকবাংলোয় রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মাত্র একটি বিছানা। তাই এ বিছানায় বঙ্গবন্ধুকে থাকার জন্য বলা হয়। কিন্তু তিনি এমনিতে লঞ্চের বেঞ্চে তোশক পেতে ঘুমাতেন। খাওয়াদাওয়াও লঞ্চে করতেন। ডাকবাংলোয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা শেষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন উঠতে যাবেন তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে জোর করে ওই বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলেন, এ বিছানা আপনার জন্য। আপনারা সৈয়দ মানুষ, আপনাদের ভালো জায়গা লাগবে। আর আমি শেখ, চাষাভূষা মানুষ, আমি মাটিতেও ঘুমাতে পারব। তিনি লঞ্চে ঘুমাতে যান। তাঁর সঙ্গে যান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আলাউদ্দিন হাজি ও আবদুল হামিদ। আর আমি (অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান) নিচে লঞ্চের একটি বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত দেড়টা কি দুটা বাজে। দেখি আমার সামনে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে। আমি স্বপ্ন দেখছি কি না বুঝতে পারছি না। তখন তিনি প্রায় ধমকের সুরে বললেন, ‘এই তুই খেয়েছিস? উত্তরে আমি বলি খেয়েছি। আবার ধমকের সুরে বললেন, মিথ্যা বলবি না, ঠিক করে বল। তার পরেও বলি খেয়েছি। আসলে তাঁরা যখন ওপরে খাওয়াদাওয়া করছিলেন তখন আমাকে দেখেননি। তাই তাঁর মনে হয়েছে আমি খাইনি। এরপর তিনি লঞ্চের কর্মচারীদের কাছে আমি খেয়েছি কি না নিশ্চিত হয়ে ঘুমাতে যান।