১৯৭৩ সাল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘সংগ্রাম’-এর শুটিং চলছে। সিনেমার শেষ দৃশ্যটি এমন—সদ্যঃস্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্যালুট করছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কিভাবে রাজি করানো যায়, তাই নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। মুশকিল আসানের উপায় বাতলালেন সিনেমার নায়ক খসরু। স্বাধীনতার আগে খসরু ছিলেন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। তাঁর হাত ধরেই ১৯৬৯-এ মুসলিম লীগের এনএসএফ গুণ্ডাবাহিনী ঢাকা থেকে উত্খাত হয়েছিল। বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর তিনি চলচ্চিত্রে আসেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র খসরু। সেই স্নেহের সুযোগ নিয়েই শেষ দৃশ্যের একটা ব্যবস্থা করতে চাষীকে নিয়ে সোজা বঙ্গবন্ধুর কাছে হাজির হলেন খসরু। তারপর দুজনের কথোপকথন শুনুন চাষী নজরুল ইসলামের কাছে—
খসরু : আপনের কাছে একটা কাজে আইছি।
বঙ্গবন্ধু : কী কাজ, ক।
খসরু : আর্মি মার্চপাস্টের একটা দৃশ্য করব আমরা। আপনে স্যালুট নিবেন।
বঙ্গবন্ধু (ধমকের সুরে) : চুপ, আমি ফিল্মে অ্যাক্টিং করব না।
খসরু : এটা তো অ্যাক্টিং না।
বঙ্গবন্ধু (আবারও ধমক) : অ্যাক্টিং হইল না কী? যা এখান থেকে।
খসরু : না, আপনাকে করতেই হবে। আপনি না হলে সিনেমাটা শেষ করতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু : মান্নানরে ডাক, দেখি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান এসে খসরু ও চাষী নজরুলকে নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন।
খসরু : বঙ্গবন্ধুরে অ্যাক্টিং করতে হইব।
আবদুল মান্নান : বঙ্গবন্ধু অ্যাক্টিং করব, এ-ও সম্ভব?
খসরু : সম্ভব না হইলে কিন্তু আপনারে অ্যাক্টিংয়ে দাঁড় করাইয়া দিমু। আপনি বঙ্গবন্ধুরে উল্টাপাল্টা কিছু বইলেন না। শুধু বলবেন, অ্যাক্টিং করা যায়।
সবাইকে নিয়ে মন্ত্রী আবদুল মান্নান আবার ফিরে গেলেন বঙ্গবন্ধুর রুমে।
বঙ্গবন্ধু : কী তাইলে?
আবদুল মান্নান : ওই ঠিকই আছে। তয় করবেন কবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে রাজি হলেন বঙ্গবন্ধু। খসরুকে বললেন, ‘যা, করে দেব।’
সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পিলখানায় শুটিংয়ের ব্যবস্থা হলো। মার্চপাস্টের বিশাল আয়োজন। এক চান্সেই শট ওকে করতে হবে। একবার মিস হলে সব শেষ। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন। পেছনে সারি বেঁধে বসলেন জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফসহ সেনাবাহিনীর সব শীর্ষ কর্মকর্তা। মঞ্চের সামনে প্যারেড করে স্যালুট দিয়ে এগিয়ে চলেছে সুসজ্জিত সেনাদল। পরিচালকের কথামতো স্যালুট নিতে কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধু। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অধৈর্য হয়ে পরিচালককে এক ধমক, ‘এই, কতক্ষণ হাত তুইলা রাখব রে।’
চাষী : আর অল্প কিছুক্ষণ।
বঙ্গবন্ধু : আরে কী করস না করস তোরা।
এভাবেই ধারণ করা হলো ‘সংগ্রাম’ ছবির শেষ দৃশ্য।
সূত্র : চাষী নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার