এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্থপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ভাষাসংগ্রামী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্কুল জীবন থেকেই রাজনীতি, প্রগতিশীল আন্দোলন ও সমাজসেবায় অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
১৯৪২ সালে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সক্রিয় সদস্য মনোনীত হন এবং ১৯৪৪ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে দিল্লি কনভেনশনে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভাষা আন্দোলনে, অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক এই সন্ধিক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। চরম প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বিষয়াদিসহ সব দিক সংগঠিত করে তোলেন।
তাঁর সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ মাত্র নয় মাসেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম সবাইকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রী হিসেবে আত্মনির্ভর বিকাশমান অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি মন্ত্রিত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিন সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি এবং পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বন্দি অবস্থায় ৩ নভেম্বর ১৯৭৫, কারাগারের সব নিয়ম ভঙ্গ করে বর্বরতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমদ এবং বাংলাদেশের তিন জাতীয় নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে তাজউদ্দীন আহমদ একটি অবিস্মরণীয় নাম। ভাষা-আন্দোলনের একেবারে শুরু থেকেই তিনি একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এ মহান আন্দোলনে। ১৯৪৭ সালে কমরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত গণআজাদী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে তিনি প্রথম ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
২ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণের সময় ফজলুল হক হলে যে বৈঠক হয় তাজউদ্দীন আহমদ তাতে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে যে হরতাল পালিত হয় তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ১১ মার্চের সফল হরতালের পর ধর্মঘট কর্মসূচি পরবর্তীকালে অব্যাহত রাখার সময় তাজউদ্দীন আহমদ এতে অংশগ্রহণ করেন।
১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট শেষে যে সভা হয়েছিল, তিনি সেখানেও অংশগ্রহণ করেন। ২৪ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ছাত্র নেতাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে যুবলীগ গঠিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ ওই সংগঠনের কার্যকরী সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে যুবলীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুবলীগ সদস্য সংগঠন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ যুবলীগের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি ১৯৫১-৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলের ছাত্রদের ওই সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পক্ষে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি ১৯ বছর বয়স থেকেই ডায়েরি লিখতেন। ওই ডায়েরিতে রয়েছে ভাষা আন্দোলন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
তাঁর ডায়েরিতে ভাষা আন্দোলনের অনেক সত্য ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। লেখক, শিক্ষাবিদ বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ডায়েরির চতুর্থ খণ্ড পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তাঁরই কন্যা সিমিন হোসেন রিমির সম্পাদনায়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাজউদ্দীন আহমদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।