আগুনের পরশমনি

-শাপলা রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মার্চ মাস এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল সব দিন অন্য মাস গুলোর চেয়ে বেশি উজ্জল, গৌরবের, বেশি আলোময়।
১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে বাংলার আলোর দূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের মধ্য দিয়ে রোপিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার স্বর্ণ বীজ। আর সে বীজ অংকুরিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শেই। মুজিব নামের পরশমনির পরম যত্নে, পরম সাবধানতায় স্বাধীনতা নামের ছোট্ট বৃক্ষটাকে রুপ দিয়েছিলেন বিশাল মহীরুহু হিসেবে। যে মহীরুহুর ছায়াতলে আজ সমগ্র বাঙালী পরম নিশ্চিন্তে। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে বঞ্চিত নিপীড়িত ভূখা-নাঙ্গা জাতির মুক্তির ত্রাতা হিসেবে বাংলা মায়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার গর্ভে বেড়ে উঠেছিলেন ”মুজিব” নামের ভ্রুণটি তিনি ও জানতেন না স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীর মুক্তির দূত একটু একটু করে তার গর্ভে বেড়ে উঠছেন। যার হাত ধরে হাজার বছরের স্বাধীনতাবঞ্চিত বাঙালি অর্জন করেছিল আজন্ম কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। যিনি ছিলেন “ক্যারিশম্যাটিক ভয়েস”, এর অধিকারী। তার কন্ঠের জাদুতে এই মার্চেই একত্রিত হয়েছিল গোটা জাতি। আর নিজে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রিয় বন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

বিভিন্নভাবে এ মার্চ মাসটি বাঙ্গালীর কাছে আরাধ্য, সম্মানের, ভালোবাসার। মার্চের শুরু হয় দেশ স্বাধীনের কাজ।কার্যত অনেক আগে থেকে শুরু হল্ওে পরিপূর্ন রুপ নেয় এ মার্চেই। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৩ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের শাসন অকার্যকর করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায়। তাঁর নির্দেশে তখন বাংলাদেশের শাসন কার্য চলছিল। প্রাথমিক স্কুল থেকে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় পর্যন্ত সব সরকারি, আধা-সরকারি কার্যালয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলছিল। সে দিন একজন নির্বাচিত নেতা হিসেবে ভোটের অধিকার বলে একজন রাজনৈতিক নেতা কিভাবে রাষ্ট্র গঠন করবার পূর্বেই তার জনগণকে শাসন করতে পারেন, ইতিহাসে এরূপ এক বিরল ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। অসহযোগ আন্দোলন হয় ৩রা মার্চ  থেকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিন বাংলাদেশের মানুষের কি করণীয় তার দিক নির্দেশনা দিলেন মার্চের ভাষণে।দিনটা ছিল মার্চের ৭ তারিখ। 

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির একটা গৌরবজ্জ্বল দিন। ওই দিন বাঙালি জাতির জনক মহানায়ক সাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। হাজার হাজার মুক্তিকামীর উপস্থিতিতে তার এ ভাষণ ছিল যুদ্ধদিনের দিক নির্দেশনা। যা পরবর্তীতে উত্তাল মার্চের ভাষণে পরিচিতি পায। গুরুত্বপূর্ণ এ ভাষণটি ইউনেস্কো কর্তৃক পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ওই স্বীকৃতির কারণে বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই গর্ববোধ করে। ইতিহাসের এমন এক বিপর্যয়কালে ভাষণটি দেয়া হয়েছিল, যখন '৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানালেন ও আসন্ন জাতীয় সংসদে দাবি উত্থাপনের পরিকল্পনা করলেন, তখন ৩রা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনের তারিখ ঘোষণার পরেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেয়া হয়।

এরপর এলো ২৫ মার্চ। বাঙ্গালীর শোক স্তব্ধ একটি দিন। বাঙালির সংঘবদ্ধতা রুখে দিতেই ২৫ মার্চের লোমহর্ষক নারকীয়তা ঘটায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বড় বেদনার দিনটি ছিল সেদিন। এদিনের ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালি মনোবল আরো চাঙ্গা হলো। আরও দ্বিগুণ শক্তি অর্জন করে কালরাতের শোককে শক্তিতে রুপান্তরিত করে গর্জে উঠল।  বাঙালি একযোগে জেগে ওঠার প্রেরণা পায়। ফলে তৎক্ষণাৎ দেশের জনগণের মধ্যে অখন্ড পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ অনাস্থার প্রকাশ ঘটায়। কালরাতের পরদিন ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার যুবা-তরুণ এবং আবালবৃদ্ধবনিতা। ২৫ মার্চের একটি কালরাতের  মোড় ঘুরিয়ে দিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের। শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলার জনগণই সূচনা করল যুদ্ধজয়ের ইতিহাসের। যে ইতিহাস বাঙালি জাতির ত্যাগ সংগ্রাম আর গৌরবের ইতিহাস। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজারবাগে ২৫ মার্চ কালরাতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করা হয় বাংলার মাটি। এরপর সারা দেশে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ। পাকিস্তানের শোষণ-শাসন, বৈষম্যে অতিষ্ঠ বাঙালি জাতি এ প্রতিরোধের জন্যই উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এই মার্চেই। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই কাজটি করেন যার জন্য উন্মুখ ছিল গোটা জাতী। নতুন প্রত্যয়ে স্বার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তিনি।

-লেখক: সাংবাদিক।



SUMMARY

2326-1.jpg