যশোরে বঙ্গবন্ধু

হাবিবুর রহমান সিজার

১৯৫৪ সালের গ্রীষ্মকালে নির্বাচনের আগে গোটা দেশ ব্যাপীসাংগঠনিক ও নির্বাচনী প্রচারাভিযান চলছে। ৭টি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। যশোরে এলেনজাতির জনক বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমান। উঠলেনযশোর আওয়ামী লীগের রাজনীতির মহাপ্রাণ এডভোকেট মশিউর রহমানের বাসায়। এর আগেও বৃটিশ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলনের বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা অকৃত্রিম অগ্রজ বন্ধুমশিউর রহমানের বাসায় উঠেছেন তিনি। যশোর ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট সংলগ্ন এ বাসায় স্বদেশীআন্দোলন, বাংলা ভাষা, বাঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আগমন করেছেন- দেশবন্ধু চিত্তরহঞ্জন দাস, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, মুজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খানভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমান প্রমুখ।


১৯৫৪ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত ২০ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ওপরে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঅসংখ্যবার যশোরে এসেছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬ তে ৬ দফা ঘোষণার পরে এবং৭০ এর নির্বাচনে প্রচারণা, বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ এর ২৬ ডিসেম্বর এবং  সর্বশেষ ১৯৭৪সালে বেনাপোল বন্দর পরিদর্শন করতে এসেছিলেন।


যশোর বিশিষ্ঠ রাজনীতিবিদ এ্যাড.মোশাররফ হোসেন এর সহধমীনী খুবইকাছ থেকে দেখেছেন  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানকে। ১৯৬৬-র ছয় দফা ,’৬৯-র গণ অভ্যুথ্থান ,’৭০-র নির্বাচন এবং১৯৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধ সবই কাছ থেকে দেখেছেন। ষাট -সত্তরের দশকজুডে তার যশোরের বাড়িতেছিল সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আসা যাওয়া। সেসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ,তাজউদ্দিনআহমেদ, ক্যাপ্টন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মেজর জলিলসহ ছাত্রনেতা সিরাজুল আলমখান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক ,কাজী আরেফ আহমেদ,আ স ম রব, আব্দুল কুদ্দুসমাখন, নূর আলম সিদ্দিীক, শাজাহান সিরাজ, সৈয়দ মোদাসসির আলী, স্বপন চৌধুরীর মতদেশের শীর্ষ নেতারা এসেছেন। তিনি নিজ হাতের রান্নায় তাদের কে আপ্যায়িত করেছেন। তিনিবঙ্গবন্ধুকে অ্যাডভোকেট হবিবর রহমানের বাসায় এবং তাঁদের বাসায় একাধিকবার সাক্ষাৎ ওআপ্যায়নের সুযোগ পেয়েছেন।


বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবনে যশোর শহরের খড়কী পীর বাড়ি অধ্যক্ষ আব্দুল হাই,চান্দুটিয়া গ্রামে বন্ধু রফিউদ্দীনের বাড়ি এবং ছাতিয়ান তলা গ্রামের আদম ভিলাতে মাঝে মাঝেরাত্রি যাপন করেছেন। এছাড়া স্বাধীনতার অনেক পূর্বে যশোরে এসে জেলা আওয়ামী লীগকার্যালয়ে (আলী মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায়) এবং শহীদ মসিয়ূর রহমানের বাড়িতে, ওয়াপদারেস্টহাউজে এবং যশোর সার্কিট হাউজে অনেকবার রাত্রিযাপন করেছেন বাঙালির এই অবিসম্বাদিতনেতা।


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করে যশোরেবিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাইসাইকেলে চড়ে ঘুরেছেন যশোরেরগ্রাম-গ্রামান্তরে, মানুষের দুঃখ-কষ্টের খোঁজ নিয়েছেন। অসুস্থ দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণমানুষকে দেখতে জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছেন।


বর্তমান শহরের দড়াটানায় তাজ হোটেলের পিছনে তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় উদ্বোধনকরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। টাউন হলে, টাউন হল ময়দানে এবং যশোর স্টেডিয়ামে বক্তব্য রেখেছেন তিনিএকাধিকবার। আওয়ামীলীগের জেলা কার্যালয়ের টেবিলের উপর শুয়ে রাত্রিযাপন করারঅভিজ্ঞতাও  রয়েছে এ মহান নেতার। বঙ্গবন্ধু যখনইযশোরে এসেছেন একটু জানাজানিতে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়।

ছাত্রজীবনে যশোরের পল্লীতে:

১৯৪৬/৪৭ সালে সেদিনের ছাত্র জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন এবং বেকার হোষ্টেলে থাকতেন। তিনি বেকার হোষ্টেলের ২৪নম্বর রুমে থাকতেন। যশোর সদর চাঁন্দুটিয়া গ্রামের রফিউদ্দীন তাঁর রুমের পাশের রুমেথাকতেন। উভয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক ছিল। তাঁদের গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তিও ছিল একই বছর। তাদেরবন্ধুত্ব ছিল অটুট ও নিবিড়। লেখাপড়ার সুত্রে খড়কীর আব্দুল হাই সাহেব ও বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ছিলেন।তার আরেক বন্ধু ছিলেন শার্শা থানার বাহাদুরপুর গ্রামের আতিয়ার রহমান, যার ছোট ভাইহাজী গোলাম মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর।


সেসময় টুঙ্গীপাড়ার সাথে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুরুহ,হয় লঞ্চে খুলনা হয়ে ট্রেনে-নয়তো বাসে যশোর হয়ে ট্রেনে। কলকাতা থেকে টুঙ্গীপাড়া ফেরারপথে যশোর নামলে সঙ্গে থাকতেন হয় এম এম কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল-বন্ধু আব্দুল হাই নয়তোচাঁন্দুটিয়ার বন্ধু রফিউদ্দীন। ছাত্র শেখ মুজিব রাত্রি যাপন করতেন খড়কী,চান্দুটিয়াতে নয়তোছাতিয়ানতলায়। চাঁন্দুটিয়া গ্রামটি ছিল বিল এড়োল বিধৌত- যশোর ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন। জানামতে শেখ মুজিব চাঁন্দুটিয়া গ্রামেই বেশী থাকতেন। ইংরেজ আমলের শেষ দিকে ছিল দ্বিতীয়বিশ^যুদ্ধেরও শেষ। তখন চলাচলে ছিল বড় বেশী বিধিনিষেধ। বিশেষ করে বেলের মাঠ তথা যশোরক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন গ্রামগুলোতে বিকেল হলেই ছিল চলাচল বন্ধ। বিকেল নামলে চাঁন্দুটিয়াগ্রামে যাওয়া চলতনা। ফলে বিকেল বা সন্ধ্যা নামলে রফিউদ্দীন শেখ মুজিবকে সাথে নিয়ে ইউনিয়নবোর্ড প্রেসিডেন্ট আব্দুল গফুরের ছাতিয়ানতলার আদম ভিলাতে নিয়ে আসতেন। বঙ্গবন্ধুকে আদমভিলাতে নিয়ে আসারও রয়েছে আরেক ইতিহাস।


প্রেসিডেন্ট আব্দুল গফুরের বড় শ্যালক ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ওকলাম লেখক আমিরুল ইসলাম রন্টুর মামা রফিউদ্দীন আহমেদ ছাতিয়ানতলায় অবস্থান করেমনোহরপুরে মুনশী মেহেরউল্লাহ প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে ৫ম অথবা ৬ষ্ট শ্রেণীতে লেখাপড়াকরতেন। তাঁর সাথে একই ক্লাসে পড়তেন চাঁন্দুটিয়া গ্রামের পিতৃহীন রফিউদ্দীন। নামেরকারণেই সম্ভবত তাদের মধ্যে সম্পর্কটা দৃঢ় হয়েছিল। এই সময় জঠিল রোগে সম্ভবত নিউমোনিয়ারোগে আক্রান্ত হয়ে আব্দুল গফুরের বড় শ্যালক রফিউদ্দীন মারা যান। বয়সে ছোট প্রিয় ভাইয়েরমৃত্যুতে আব্দুল গফুরের স্ত্রী শোকে পাগলপারা। সকলে তাঁকে সান্তনা দিতে ব্যার্থ হলেন । এসংকট সময়ে চাঁন্দুটিয়া গ্রামের রফিউদ্দীন এগিয়ে এসে তাঁর পাশে এসে দাড়ালেন। বললেন-আপনারআপন ভাই মারা গেছে ঠিকই তাকে তো আর কোনদিন কোন ভাই ফিরে পাবেন না-যতো আহাজারি করেন না কেন। আমি আপনারআর এক ভাই রফিউদ্দীন তো আছিই। আমি আপনার আপন ভাই রফিউদ্দীনের মতই আপনার পাশেথাকব। তিনি রফিউদ্দীনকে আপন ভাইয়ের মত বুকে টেনে নিলেন। এভাবে ছাতিয়ানতলার আদমভিলাতে রফিউদ্দীনের অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। দুপরিবারের সম্পর্ক উত্তোরোত্তর দৃঢ় হয়। দুপরিবারের আত্মীয়তা, ঘনিষ্ঠতা ও নিবিঢ়তা বৃদ্ধি পায়। এভাবে রফিউদ্দীনের সূত্রে বঙ্গবন্ধুছাতিয়ান তলা আদম ভিলাতে মাঝে মাঝে রাত্রি যাপন করতেন।


জানা যায়,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৫-৪৭ সাল পর্যন্ত চাঁন্দুটিয়ারগ্রামে বন্ধু রফিউদ্দীনের বাড়িতে বহুবার গিয়েছিলেন। প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা দুস্কর। সেইসুত্রে কতবার ছাতিয়ানতলার আদম ভিলায় অবস্থান করেছিলেন তাও অনুমান নির্ভর। ছাত্রাবস্থায়শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ টুঙ্গীপাড়া যাবার পথে কলেজ বন্ধ ও ছুটি ছাটা হলে কলকাতা হতে যশোররেলষ্টেশনে নামতেন। সেসময় দুবন্ধু বাড়ী ফিরতেন এবং যশোর রেলষ্টেশনে নেমে চাঁন্দুটিয়ার পথধরতেন। আর ১৯৪৬-৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিম্বা দেশ বিভাগের রাজনৈতিকউঞ্ষতা  তাঁদেরকে হয়তো ঘনঘন  কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করত। সেই সাথে ছিল ১৯৪৬সালের গণভোট। নানাকারণে যশোর থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে টুঙ্গীপাড়ায় ফেরার প্রসঙ্গটি ছিলোজোরালো-খুলনার চেয়ে। খুলনা হতে টুঙ্গীপাড়া দীর্ঘপথ যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলোনদীপথ। বঙ্গবন্ধুর ছাতিয়ানতলার আদম ভিলায় ৩ বার আসা ও থাকার বিষয়টি জীবদ্দশায় নিশ্চিতকরেছিলেন আওয়ামীলীগ কর্মী মরহুম আব্দুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধু কলেজ জীবনে চাঁন্দুটিয়া গ্রামেযাতায়াত করেছেন বাগডাঙ্গা গ্রামের উপর দিয়ে-যা জীবদ্দশায় নিশ্চিত করেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ওউপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রয়াত সোলায়মান হোসেন। ষাটের দশকে চান্দুটিয়া গ্রামেররফিউদ্দীনের বৈঠকখানায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিটা ছিল। আমার পিতা এম ইউ স্কুল (মুনশী মেহেরুল্লাহ একাডেমী) এর সাবেক প্রধান শিক্ষক মরহুম গোলাম মোস্তফা জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর চাঁন্দুটিয়া গ্রামে একাধিকবার দেখা ও সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।


অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যশোর:

‘সন্ধ্যা হয় হয়, ঠিক এই সময় ট্রেন বেনাপোল এসে পৌছল। ট্রেনথামবার পূর্বেই আমি নেমে পড়লাম। একজন যাত্রীর সাথে পরিচয় হল। তাকে বললাম, আমারমালগুলি পাকিস্তানের কাস্টমস আসলে দেখিয়ে দিবেন, আমার একটু কাজ আছে। আসতে দেরীওহতে পারে। অন্ধকারে একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। এখানে ট্রেন অনেকক্ষণ দেরী করল।গোয়েন্দা বিভাগের লোক ও কিছু পুলিশ কর্মচারী ঘোরাফেরা করছে, ট্রেন দেখছে তন্ন তন্নকরে। আমি একদিক থেকে অন্যদিকে করতে লাগলাম। একবার ওদের অবস্থা দেখে ট্রেনের অন্য পাশেগিয়ে আত্মগোপন করলাম। ফাঁকি আমাকে দিতেই হবে। ট্রেন ছেড়ে দিল, আস্তে আস্তে ট্রেনচলছে, আমি এক দৌড় দিয়ে এসে ট্রেনে উঠে পড়লাম। আর এক মিনিট দেরী হলে উঠতে পারতামকিনা সন্দেহ ছিল। ট্রেন চলল, যশোরেও হুশিয়ার হয়ে থাকতে হবে। রেলষ্টেশনে যে গোয়েন্দাবিভাগের লোক থাকে, আমার জানা আছে। যশোরে ট্রেন থামবার কয়েক মিনিট পূর্বেই আমিপায়খানায় চলে গেলাম। আর ট্রেন ছাড়লে বের হয়ে আসলাম। একজন ছাত্র আমার কামরায় উঠেবসে আছে। আমি পায়খানা থেকে বের হয়ে আসতেই আমাকে বলল,“ আরে মুজিব ভাই।” আমিওকে কাছে আসতে বললাম এবং আস্তে আস্তে বললাম, “আমার নাম ধরে ডাকবেনা।” সেছাত্রলীগের সভ্য ছিল, বুঝতে পেরে চুপ করে গেল।


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেযশোরের বুকে পা রাখার এ নির্মম বর্ননা দিয়েছেন। সময়টা ছিল আওয়ামীলীগ প্রতিষ্ঠার প্রথমদিক, যখন মাওলানা সাহেবের নির্দেশে তিনি গ্রেফতার এড়াতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতহয়ে  বেনাপোল দিয়ে  যশোরে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্য ছিল খুলনা হয়ে বাড়ীফেরার। এর বাইরে বহুবার তিনি যশোরে এসেছেন। নেতা হিসেবেই তার আগমন ঘটে বেশী। দেখাযায় আওয়ামীলীগের জন্মের প্রথম দিকে যশোর ছিল সক্রিয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে‘আমরা এখন জেলা কমিটি গুলো গঠন করতে পারি নাই। তবে দু’একটা জেলায় কমিটি হয়েছিল। চট্টগ্রামে এম এ আজিজ ও জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং যশোরে খড়কীর পীর সাহেব ওহাবিবুর রহমান এ্যডভোকেটের নেতৃত্বে। মশিয়ুর রহমান সাহেব ও খালেক সাহেব সাহায্যকরেছিলেন, কিন্ত প্রকাশ্যে তখনও যোগদান করেন নাই। ফরিদপুরে সালাম সাহেবের নেতৃত্বেঅর্গানাইজিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ভিতরেই আমরা সমস্থ জেলায় প্রতিষ্ঠান গড়েতুলব ঠিক করেছি।’


বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত কামালপ্রতাপ গ্রাম: 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফুফু বাড়ি নড়াইলসদরের কামাল প্রতাপ গ্রাম। বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ফুটবল খেলার মাঠ এখনো আছে।১৯২১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো ফুফু শেখ হায়াতুন্নেছার নড়াইল সদরেরকামাল প্রতাপ গ্রামের কাজী আবুল হায়াতের সাথে বিয়ে হয়।


ছোট বেলায় নড়াইলের কামালপ্রতাপ গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুররহমানের ফুফু বাড়ি আসা যাওয়া ছিল। ওই মাঠে তিনি ফুটবল খেলেছেন। ফুফুর ছেলেরাসমবয়সী হওয়ায় তাদের সাথে বন্ধুত্ব আর ফুফুর টানে নড়াইলে কয়েকবার এসেছেন শেখ মুজিবররহমান,স্থানীয় কামালপ্রতাপ হাইস্কুল মাঠে ফুটবল খেলেছেন।


জানা যায়, ১৯৫১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমান কামাল প্রতাপ স্কুলমাঠে ফুটবল খেলেছেন।তিনি ৩-৪ বার কামালপ্রতাপ গ্রামে তার ফুফু বাড়ি এসেছেন। একবার এসে এক নাগাড়ে ৪দিনছিলেন। আরো জানা যায় কামাল প্রতাপ গ্রামের বঙ্গবন্ধুর ফুফু শেখ হায়াতুন্নেছার ছেলে কাজীনূরূল ঈমান (সইয়ুব) ও কাজী নুরুজ্জামান (আইয়ুব) এর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। যে কারনে যখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও যে কোনরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের খবর কাজী নুরুজ্জামান আইয়ুব সন্ধার পরে স্কুটার করে এসে রেনু বুজিরকাছে বলে যেতেন। তথন কাজী নুরুজ্জামান আইয়ুব ডিএসবি দারোগা ছিলেন। পরে অতিরিক্তপুলিশ সুপার অবস্থায় মারা যান। বর্তমান প্রধান মন্ত্রী তখন আইয়ুব কাকা সইয়ুব কাকা বলেডাকতেন চিনতেন।


১৯৫১ সালে সাংগঠনিক কাজে:

১৯৫১ সালে বৃহত্তর যশোরে আলী মঞ্জিলে যশোর আওয়ামী লীগকার্যালয়ে মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সাথে যশোর আওয়ামী লীগনেতা মোশাররফ হোসেন, রওশন আলী এবং অ্যাডভোকেট মশিউর রহমানসহ আরও অনেকে উপস্থিতছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা দেন এবং সাথে অন্যান্যসাংগঠনিক আলোচনাও অংশ নেন।


১৯৫৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে:

১৯৫৪ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেরনির্বাচন সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সাবেক আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী শহীদ মসিউর রহমান ও অন্যন্য নেতৃবৃন্দের নির্বাচনী প্রচারে আসেন। দীর্ঘ সাংগঠনিক ওনির্বাচনী আলাপ শেষে সিদ্ধান্ত হল মশিউর রহমানের এলাকায় জনসভা করে (বৃহত্তর যশোর)জেলার নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করবেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদেরসদস্য পদে প্রার্থী ছিলেন শহীদ মসিয়ূর রহমান। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তখনোআওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে শেখ সাহেব, না হলে মুজিব ভাই বলে পরিচিত। সেকালেরবাঙ্গালীদের প্রিয় মুজিব ভাই যশোরের অসাধাণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতা মসিয়ূর রহমানকে আপনবড় ভাই’র মতো শ্রদ্ধা করতেন। তিনি সে সময় ঝিকরগাছা থানায় দুটি জনসভা করার সিদ্ধান্তনেন। এর একটি থানার উত্তর এলাকায়, অপরটি দক্ষিণে। যুক্তফ্রন্টের যশোরের ঝিকরগাছার দুইটিজনসভা ছিল এক ঐতিহাসিক যুযসন্ধিক্ষণে। এছাড়া তিনি যশোরে আরো কয়েকটি নির্বাচনী প্রচারেঅংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে একাধিকবার বাইসাইকেলচালিয়ে যশোরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন।


(ক) ১৯৫৪ সালে প্রাদেসিক পরিষদ নির্বাচনে যশোর সদর আসনেরপ্রার্থী ছিলেন খান মোশাররফ। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরসদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের মোড়লপাড়া খেলার মাঠে উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিয়েছিলেনবলেজানান সাবেক নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আকরাম বিশ^াস ওরফেখিদির বিশ^াস। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবুল খায়ের(র.),অ্যাডভোকেট হবিবর রহমান, খান মোশাররফ, সাবেক দপ্তর সম্পাদক শরীফ আহমেদ, অধ্যক্ষআব্দুল হাই প্রমুখ ব্যাক্তি উপস্থিত ছিলেন। এদিন বঙ্গবন্ধু হযরত চেরাগ আলী শাহ (র.) এরমাজার জিয়ারত করে সভায় ভাষণ দেন।


(খ) বঙ্গবন্ধু ঝিকরগাছার উত্তর এলাকারজনসভার স্থান নিজেই নির্বাচন করে দিয়েছিলেন। স্থানটি ছিল নায়ড়া গ্রাম। সাতক্ষীরারসুলতানপুরের মরহুম খোন্দকার আব্দুল বাতেন (খ্যাতনামা কলামিস্ট আব্দুল গফফার চৌধুরীরঘনিষ্ট বন্ধু) মিয়ার বাড়িতে রাত যাপন করে বঙ্গবন্ধু সাতক্ষীরা-যশোর ইটের রাস্তায় চলাচলকারীলক্কড় মার্কা বাসে এসে নেমেছিলেন শার্শার বাগআঁচড়া বাজারে। সেখান থেকে সাইকেলে চেপেদুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সভা করেন আজকের নায়ড়ার বাজারে। নায়ড়াগ্রামের জনসভা পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর ‘সাবাশ চেয়াম্যান’ নামে খ্যাত আবুল ইসলাম।


যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায়বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশোরের ঝিকরগাছার  অজোপাড়াগাঁ নায়ড়া গ্রামে সফরে আসেন। নায়ড়াগ্রামের বাসিন্দা ৮২ বছরের বৃদ্ধ খোন্দকার জালাল উদ্দিন সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন।


নায়ড়া গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী খন্দকারআব্দুল ওয়াদুদ বলেন,‘বঙ্গবন্ধু যখন নায়ড়ায় আসেন তখন আমার বয়স ছিল ১০ বছর। ইত্তেফাকেরফোরম্যান খন্দকার বজলুর রহমানের কাছে শোনা-ঢাকায় একসাথে ক্যারামবোর্ড খেলার সময়বজলুর রহমান বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন,‘তুমিতো শুধু টুঙ্গীপাড়ার ঐতিহ্যের কথা বলো, আমাদেরনায়ড়ার ঐতিহ্য একবার দেখে আসো, দেখবা তোমাদের থেকেও তা ভালো।’ সেই আমন্ত্রণেইবঙ্গবন্ধু নায়ড়ায় এসেছিলেন।’


স্মৃতিচারণকালে খোন্দকার জালালউদ্দিন বলেন, ১৯৫৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা ১১টায় যশোর সাতক্ষীরা মহাসড়কের শার্শা উপজেলারনীলকান্ত মোড়ে পৌছান বঙ্গবন্ধু, সাথে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ ও যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মশিয়ুররহমান। সেখানে বাস থেকে নামার পরপরই খোন্দকার লুৎফর রহমান, কেসমত আলী মণ্ডল,খোন্দকার শফিউর রহমান, মোহাম্মদ গাজী, ইছার উদ্দীন মোড়ল, খোন্দকার আতাউর রহমান সহঅনেকেই তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়।  কাঁচারাস্তা তাই রাস্তাটি গাড়ী চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় তিনি শার্শার নীলকান্ত মোড় থেকেপায়ে হেটে সামটা বাজার পর্যন্ত আসেন। বাজারের পুর্বদিকে বেতনা নদীর উপরে একটি বাঁশেরসাঁকো ছিলো। সাঁকো পেরিয়ে ঝিকরগাছা উপজেলার দেউলী গ্রাম। এই গ্রাম থেকে গরুরগাড়িতে চড়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসেন নায়ড়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবখন্দকার বজলুর রহমানের ছেলে লুৎফর রহমানের গরুর গাড়িতে চড়েন। দৈনিক সংবাদপত্র প্রেসফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নায়ড়া গ্রামের খোন্দকার বজলুর রহমান নীলকান্ত মোড় থেকেগরুরগাড়িতে করে অতিথিদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন নায়ড়ায়। এখানে পৌছে বঙ্গবন্ধু দিঘিতেওজু করে হযরত শাহ সুফি সুলাইমান (র) এর মাজার জিয়ারত করেন। জিয়ারত শেষ করে মসজিদেজোহরের নামাজ আদায় করেন। দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন খোন্দকার বজলুর রহমানতার বাড়িতে। পরে বিকেলে নায়ড়া বাজারে তিনি এক জনসভায় বক্তব্য রাখেন। এটি এখন স্মৃতিরপাতায় ভেসে বেড়ায় নায়ড়া গ্রামবাসির।


জানা যায়, খোন্দকার বজলুর রহমানেরসাথে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বজলুর রহমান যখন কলকাতায় দৈনিক ইত্তেহাদে চাকুরী করতেনতখন বঙ্গবন্ধুও সেখানে যেতেন। ঔই সময় বঙ্গবন্ধু বজলুর রহমানের স্ত্রী আতিরুন নেছার কাছে তিনিনায়ড়ার দীঘির মাছ খেতে চেয়েছিলেন। সেইজন্য জেলেরা দীঘি থেকে বড় বড় মাছগুলোইধরেছিলেন। সেদিন ১৫ সের ওজনের রুই মাছ, ১৮ সের ওজনের কাতল মাছ, ২০ সের ওজনেরবোয়াল মাছ এবং গলদা চিংড়ী ও মায়া মাছ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়ণ করা হয়। সেদিন বঙ্গবন্ধুবলেন,আমার মাছ দাও, অনেক দিন মাছ তেমন খাওয়া হয়না। দীঘির রুই,কাতল, বোয়াল, চিংড়ীও মায়া মাছ দিয়েই তিনি খাওয়া শেষ করেন। মুরগির মাংস এবং ডিমের কোরমা রান্না করাহলেও তিনি তা খেতে চাননি। বহু পিড়াপিড়ীর পরে তিনি পাতে নিয়েছিলেন মাত্র। দুপুরেরখাবার খেয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বিকালে তিনি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা শেষে বজলুররহমানের স্ত্রী আতিরুন নেছা বাসায় রাত্রি যাপন করার জন্য বহু পিড়াপিড়ী করলেও কাজেরব্যস্ততায় তিনি থাকেননি তবে আবারো তিনি আসতে চেয়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর খোন্দকারবজলুর রহমান ঢাকায় ইত্তেফাকে চাকরি নেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।


খোন্দকার জালাল উদ্দীন বলেন, আমারবয়স তখন  ১৫-১৬ বছর। সামটা বাজারে আমিবঙ্গবন্ধুর সাথে হ্যাণ্ডসেক করি। সারাদিন আমি তার পিছনে পিছনে ঘোরাঘুরি করি। সেসময়যেখানে প্রাইমারী স্কুলের পাশে তালগোলা ( তালের মতো গোলাকার বলে এই আমকেতালগোলা আম বলতেন স্থানীয়রা) আমগাছ ছিল। ঔই গাছের নিচে দাড়িয়ে মসজিদের দিকে মুখকরে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। রাস্তা করার সময় সেই তালগোলা আমগাছটি কেটে ফেলা হয়। তিনিআসার সময় সাথে একটি টিনের চোঙ্গা নিয়ে এসেছিলেন, যেটি ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু ভাষণদিয়েছিলেন। উপস্থিত এক থেকে দেড়শ মানুষ সেই ভাষণ শুনেছিলেন। জানা যায় সেসময় নির্বাচননিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐ সফর  আর ভাষণের পরে নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহবেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বলেছিলেন, পাকিস্তানীরা আমাদের উপর আত্যাচারচালাচ্ছে। পাকিস্তানীদের ভোটে হারাতে না পারলে অত্যাচার আরো বাড়বে। এসময় তিনিযুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের ভোট দিতে বলেন। এদিন তিনি মানুষ কম হলেও এক ঘন্টার মতো বক্তব্যপ্রদান করেন। বক্তৃতার পরে তিনি সেখানে জড়ো হওয়া ছোট ছোট বাচ্চাদের কোলে তুলে নিয়েছিলেন।তিনি আসার সাথে সাথে  পিছুপিছু টিকটিকিও (গোয়েন্দা)এসেছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের চিনতে পেিেছলেন। তিনি রেগে তাদের বললেন, লেখো, আমার বিরুদ্ধেযা যা আছে লেখো। আমি যা যা বললাম সবই লিখে তোমার গভর্ণমেন্টকে জানাবে। দেখিআমার কি করে।’


যে আমগাছ তলায় দাড়িয়ে মানুষকে বঙ্গবন্ধুমুক্তির মন্ত্র শুনিয়েছিলেন জাতির জনক সেই আমগাছটি কাটা পড়েছে। সেখানে স্থান করে নিয়েছেএকটি বকুল গাছ। তার নীচে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাসকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি ফলকস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় সংসদের তৎকালীন সিনিয়র হুইপ অধ্যাপকরফিকুল ইসলাম ফলকটি উম্মোচন করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে বাঁকড়া-বাগআঁচড়া সড়কেরসংযোগস্থল থেকে শুরু করে নায়ড়া বাজারের স্মৃতিফলক পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটারসড়কের  নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’ সড়ক।


খোন্দকার বজলুর রহমানের মেয়ে  খোন্দকার পিয়ারা খাতুন বলেন, বাবার আমন্ত্রণেবঙ্গবন্ধু নায়ড়ায় পৌছানের পরপরই আমি ও আমার বোন সাবেরা খাতুন প্রথম তাঁকে গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে বরণ করি। সে যে কি আনন্দ তা বলে শেষ করা যাবেনা। গরুর গাড়ি থেকেনামার পরপরই আমার হাতে ফুলের মালা দেখে বঙ্গবন্ধু মাথাটা নিচু করেন, আর আমি মালাটাপরিয়ে দেই। বঙ্গবন্ধু আমার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, যা কোনদিন ভুলতেপারবনা। বঙ্গবন্ধুর আসার খবরে সেদিন চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সেসময় আমাদেরপাঁচচালা একটি মাটির ঘর ছিল। বারান্দার তক্তপোষে বসে খাবার খেয়েছিলেন জাতির জনক।সেসময় যেখানে বজলুর রহমানের বসতঘর ছিল সেখানে বর্তমানে রান্নাঘর। দুপুরে যেখানে বসেরান্না করেছিলেন বজলুর রহমানের ছেলে লুৎফর রহমানের স্ত্রী সাজেদা রহমান।


সেদিন দুপুরে খাবার জন্য ২৫ জনলোকের আয়োজন করা হয়। অতিথিদের জন্য দীঘির রুই, কাতল, বোয়াল, চিংড়ি ও মায়া মাছআর গরু ও মুরগির মাংস রান্না করা হয়। তবে সেদিন বঙ্গবন্ধু মাছ দিয়েই ভাত খেয়েছিলেন,মাংসের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখাননি। খোন্দকার মাহবুবুল হক,লুৎফর রহমান ও খোন্দকারআব্দুল ওয়াদুদ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দুপুরের খাবার পরিবেশন করেছিলেন।


খোন্দকার বজলুর রহমানের ছেলে জাভেদবলেন, নায়ড়া বাজারে আমাদের একটি জমি আছে যেটা আমরা বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টেরনামে লিখে দিতে চাই। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রিয়ভাবে যদি সহযোগিতা করেন, তবেএখানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স ও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকে সারা বাংলায় ছড়িয়েদিতে এবং নায়ড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই এটা করা দরকার। এখানে একটি স্মতি কমপ্লেক্সকরা গেলে আগামী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতি ধরে রাখা সহজ হবে।


প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শতমানুষ দিঘি ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্পটটি দেখতে এখানে আসেন। প্রতি শুক্রবার শত শত ভক্ত অনুরাগীআসে হযরত শাহ সুফি সুলাইমান (র) মাজার জিয়ারত করতে। পুরো এলাকাটি ইতোমধ্যে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হলে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকমপ্লেক্সকে ঘিরে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।


সভা শেষে সন্ধ্যা সাতটার একটু পরে নায়ড়া থেকে রওনা দিয়েছিলেনবঙ্গবন্ধু। তবে যেপথে তিনি এসছিলেন ফেরেন তার উল্টোপথে।নায়ড়া থেকে গরুর গাড়িতে চড়ে শংকরপুরেরবেত্রাবতী(বেতনা) নদী পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানে নদীর উপরের বাঁশের সাঁকো পার হয়েহেঁটে বাগআঁচড়া পর্যন্ত এসে তিনি বাস ধরেছিলেন।


বঙ্গবন্ধু রাত যাপন করেন ঝিকরগাছা মোটরব্রিজের লাগোয়া দীনবন্ধু দফদারের দোতালায়। দোতলার ওই কামরাটি তখন যুক্তফ্রন্টেরনির্বাচনী কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হত। তিনি রাতে দোতলার বিরাট খোলা ছাদে কর্মীদেরনিয়ে সভা করেন। সে সভার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় মরহুমহাজী নুর বক্স সাহেবকে। মরহুম হাজী নুর বক্স সাহেব ছিলেন ঝিকরগাছা থানা আওয়ামী লীগেরপ্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে জাতির ক্রান্তিলগ্নে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় তারউপর অর্পিত হয় যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বভার।


(গ) মরহুম হাজী নুর বক্স সাহেবেরবাড়ি উজিরপুর, যা চৌগাছা মুক্তারপুর গ্রামের একেবারেই লাগোয়া। মরহুম ভাটাই বিশ্বাসেরসাথে তার ছিল নিবিড় বন্ধুত্ব। শহীদ মসিয়ূর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মরহুম ভাটাইবিশ্বাস যার বাড়ি এই মুক্তারপুরে। মসিয়ূর রহমানের আগত স্নেহ এবং হাজী নুর বক্স সাহেবেরবন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে ভাটাই বিশ্বাস অনুরোধ করেছিলেন দক্ষিণের জনসভাটি হবে মুক্তারপুরে।যশোর জেলা পরিষদ প্রথম কিস্তিতে যে কয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অনুদান দিয়েছিল, তারএকটি আজকের মুক্তারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।


এই বিদ্যালয়ের মাঠে নির্বাচনী সভাকরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের নৌকা প্রতীকের পক্ষেসেই বিশাল জনসভার শ্রোতাদের মধ্যে আজো যারা জীবিত আছেন তারা গর্বের সাথে স্মরণকরেন বঙ্গবন্ধুকে। বর্ণনা দেন যুবক মুজিবের তেজোদীপ্ত বজ্রকন্ঠের অসাধারণ বক্তৃতার। সেসময়মুক্তারপুর গ্রামের ধুলিয়ানী ইউনিয়ন ছিল ঝিকরগাছা থানার অধীন। কপোতাক্ষ নদের তীরেঅবস্থিত ধূলিয়ানী ইউনিয়নের সর্ববৃহৎ গ্রাম মুক্তারপুর। ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম হওয়ায়ধূলিয়ানী ইউনিয়নের একমাত্র ডাকঘর এই মুক্তারপুর গ্রামে অবস্থিত। ধূলিয়ানী ইউনিয়নের জন্মমুক্তিযুদ্ধের পর। চৌগাছা থানার সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভানিয়ে চৌগাছা উপজেলা গঠিত। এরমধ্যে ৩টি ইউনিয়ন যথাক্রমে সুখপুকুরিয়া, নারায়নপুর ওস্বরূপদাহ নেয়া হয়েছে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা থেকে। আর একই জেলার কালীগঞ্জউপজেলা থেকে নেওয়া হয়েছে হাকিমপুর, পাতিবিলা ও জগদীশপুর ইউনিয়ন। চৌগাছা,সিংহঝুলি, ফুলসারা, পাশাপোল ও বহুল আলোচিত ধূলিয়ানী এ পাঁচটি ইউনিয়ন ছিলঝিকরগাছা উপজেলার অর্ন্তভূক্ত।


নির্দিষ্ট দিনে যশোর থেকে দুপুরেরখাবার শেষে লক্কড় বাসে চেপে সোজা ১৪ মাইল পশ্চিমে শহীদ মশিউর রহমানের গ্রামের বাড়িসিংহঝুলি উঠলেন বঙ্গবন্ধু। নির্বাচনী প্রার্থী এডভোকেট মশিয়ুর রহমান। প্রতিদ্বন্দ্বি মুসলিমলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ঝিকরগাছার এডভোকেট সামসুর রহমান। বাদ বাকী সফর সঙ্গী শার্শারতবিবর রহমান সরদার, এডভোকেট মোশারফ হোসেন, এডভোকেট রওশন আলী এবং নূর বক্স হাজী।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সঙ্গে মানুষ স্রোতের মতোহাঁটছেন।


ঝিকরগাছাসহ বিভিন্ন স্থানেযুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচার শেষে একটি ট্রাক, শত শত বাইসাইকেল, অগণিত গরুর গাড়ি এবং ঘোড়ারগাড়ি, নৌকা যোগে যথাসময়ে মোক্তারপুর স্কুল মাঠে জমায়েত হলেন কৃষক, ছাত্র, জনতা।জনতার ঢল, উপচে পড়া ভিড়ে নিঝুম নিভৃত মোক্তারপুর মুহূর্তে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল।


নির্দিষ্ট দিনে সকালে শহীদ মশিউররহমানের গ্রামের বাড়ি সিংহঝুলি থেকে ১০ টায় বঙ্গবন্ধু ও মশিউর রহমান দু’টো বাইসাইকেলযোগে উপস্থিত হলেন মোক্তারপুর ভাটাই বিশ্বাসের বাড়িতে।


সভাশেষে নেতাকর্মীদের খাওয়া-দাওয়ারব্যবস্থা হয়েছিল ভাটাই বিশ্বাসের বাড়িতে। সদা সহৃদ্যতায় ভরা, এলাকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টভাটাই বিশ্বাস ২৭ সের ওজনের খাশি, কপোতাক্ষ নদের কৈ শিং মাগুরসহ নিজ পুকুরের ১২ সেরওজনের রুই কাতলা ধরলেন। সফর সঙ্গীদের খবর পেয়ে আপ্যায়ন এবং তাঁদের বিশ্রামের জন্যপ্রস্তুতি নিলেন।


নাস্তা ও খাওয়া শেষে স্কুল মাঠকপোতাক্ষ নদের পাড়। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের বক্তৃতায় উঠে এল বাংলার মাটি, মানুষ, পানির স্বভাব,প্রকৃতির প্রভাব। এ মাটি কিভাবে বৃটিশবেনিয়া ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ফুসে উঠেছিল, নব্যপাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তি কতবড় নির্যাতনকারী, লুন্ঠনকারী, শোষক শ্রেণীর অভিভাবক। গরীবকৃষককূলের উপর চিরায়ত অবিচার , নির্যাতন অব্যাহত। জনসভার সংবাদে চৌগাছা, ঝিকরগাছাএবং শার্শা এলাকায় বাঁধভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার। সাথে মোক্তারপুর এবং ভাটাই বিশ্বাসেরইউনিয়নের ৩২ গ্রামের অধিবাসী ও পাশ্ববর্তী বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণ। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনেরবিপ্লবী নেতাদের আগমন বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনে জন জোয়ার শুরু হয়। ৪৭সালের খন্ডিত স্বাধীনতায় মুসলিম লীগের সীমাহীন দূনীতি, ঘৃণা, অত্যাচারের বিরুদ্ধেসোচ্চার আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা তাদের পাশে। মহান ২১শে ফ্রেবুয়ারীর স্মৃতিকে চিরঅম্লান করে রাখার জন্য যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কর্মসূচী ২১টি দফায় বিন্যস্ত করা হয়। তাদেরঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের বিপক্ষে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।যুক্তফ্রন্টের প্রদত্ত ২১ দফা পূর্ব বাংলায় শোষিত এবং নিপীড়িত জনগনের দাবীসহ প্রাদেশিকস্বায়ত্ব-শাসন ও বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষারুপে প্রতিষ্ঠার দাবী প্রাধান্য লাভ করে।যুক্তফ্রন্টের ঘোষিত ২১ দফা ইস্তেহার পূর্ববাংলার জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠে।কেননা এটি পূর্ব বাংলার কৃষি, শিক্ষা ও পাটজাত শিল্পের উন্নয়নসহ রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকেপ্রতিষ্ঠা এবং ২১শে ফ্রেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ঘোষণা পূর্বক শহীদ মিনার নির্মাণে জনগনেরদাবী প্রতিফলিত হয়। উপরন্ত পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগেরবিরুদ্ধে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই নির্বাচনে ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট৩০০টি আসনে বিজয়ী হয়ে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করে।


যুক্তফ্রন্টের ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেনআওয়ামী লীগের সিংহঝুলি ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও থানা সম্পাদক সামসুজ্জোহাভাটাই বিশ্বাস। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী এডভোকেট মশিউর রহমান- এর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যে মুহূর্তমুহূর্ত করতালীতে জনসভা মুখরিত হয়ে উঠে।


জনসভায় বঙ্গবন্ধুর মুখের কথা শুনতে মানুষউতলা। তিনি বক্তব্য রাখার জন্য উঠে দাড়ালেই মানুষের মধ্যে পিনপতন নীরবতা।


প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু ২১ দফারআলোকে তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে উপস্থিত নরনারীর হৃদয়ের পুঞ্জীভূত বেদনা, শিক্ষা,অর্থনীতি, কৃষি সংস্কৃতি, শোষণ-বঞ্চনার গভীর দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন।


এখনও যশোরের চৌগাছার মুক্তারপুরেরমানুষ বঙ্গবন্ধু কে ভোলেননি। তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন তাদের মুক্তারপুরে, কপোতাক্ষ নদের পাশেএকটি মাঠে। মানুষ ওই পথ দিয়ে গেলে এখনও স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের কথা।


(ঘ) কেশবপুরে বঙ্গবন্ধু:

১৯৫৪ সালে নির্বাচনী প্রচারের কাজেবঙ্গবন্ধু বাইসাইকেল চালিয়ে কেশবপুরে যান। এসময় তিনি কেশবপুর উপজেলার পাজিয়া ইউনিয়নেরহরিপ্রসন্ন বসুর বাড়িতে দুপুরের খাবার গ্রহণ করেন।


(ঙ) মণিরামপুরে বঙ্গবন্ধু:

১৯৫৪ সালে নির্বাচনী প্রচারের কাজে মণিরামপুরেররাজগঞ্জ বাজারে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। বর্তমানে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে ম্যুরাল।


চৌগাছায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ:

বঙ্গবন্ধুর দূর্লভ মুহুর্তের স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করে চলেছে মুক্তারপুরবঙ্গবন্ধু স্মৃতিস্তম্ভ। বঙ্গবন্ধুর সভাস্থলের স্মৃতিস্তম্ভ ঐতিহাসিক সাক্ষ্য হিসাবে ১৯৯৯ সালেআওয়ামী লীগ এম.পি জনাব অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম-এর নির্দেশে চৌগাছা ইউনিয়নের পাঁচবারস্বর্ণপদক প্রাপ্ত চেয়ারম্যান এস, এম হাবিবুর রহমান (বর্তমানে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতিও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) মোক্তারপুর গ্রামের গণ্যমান্যদের সাথে পরামর্শ করে বঙ্গবন্ধুস্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। 


১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঝিনাইদহে:

দীর্ঘ ৬ দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বহন করে আসছে ঝিনাইদহশৈলকুপা উপজেলার বাখরবা গ্রামের একটি ঘর। ১৯৫৪ সালের কোন একসময় এই ঘরটিতে রাত্রিযাপন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের স¦াক্ষী হয়ে জরাজীর্ণঅবকাঠমো নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে মাটির ভিটার এই ঘরটি। অথচ শৈলকুপা উপজেলারঅধিকাংশ মানুষ জানে না সে ইতিহাস। যারা জানে, তাদের কেউ কেউ এক নজর দেখতে আসে এইঘরটি।


এখানে এলে কিছুটা হলেও আপনিও হবেন স্মৃতিকাতর। এই ঘরটিতৎকালীন পাকিস্থানের জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাবেকসদস্য এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের বসত বাড়ি।


তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টপ্রার্থী অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের পক্ষে নৌকা প্রতীকের প্রচারনায় তিনি এই অজপাড়াগাঁ বাখরবাগ্রামে এসেছিলেন। ঝিনাইদহ-শৈলকুপা-হরিনাকুন্ডু আসনে যুক্তফ্রন্টের নৌকা প্রতিকের প্রার্থিছিলেন তিনি। সেই নির্বাচনে প্রচারনার জন্য বঙ্গবন্ধু এখানে এসেছিলেন। তিনি ট্রেন যোগেঢাকা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে খোকসা আসেন। পরে নেতাকর্মীদের নিয়ে গড়াই নদী পার হয়েবাখরবাতে আসেন। বাড়ির পাশে একটি পুকুরে গোসল করেন বঙ্গবন্ধু।


দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে বিকালে কাতলাগাড়ী বাজারে নির্বাচনীজনসভায় ভাষণ দেন। রাতে কামরুজ্জামানের বাড়িতে গেস্টরুমে রাত্রি যাপন করেন। সকালে তিনিঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন ও শেখআজিজ। বঙ্গবন্ধুর রাতে অবস্থান নেওয়া সেই ঘরটি আজ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।


১৯৫৫ সালে:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্টসরকারের মন্ত্রী থাকাকালীন যশোরে রাজনৈতিক সফর করেন এবং টাউন হল মাঠে মিটিং করেন।তাঁর সাথে ছিলেন সাবেক স্পীকার আব্দুল হাকিম।


১৯৬০ সালে:

১৯৬০ সালে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সফরে যশোরে আসলে যশোর সার্কিটহাউজে রাত্রি যাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।


১৯৬২ সালে:

১৯৬২ সালে যশোর সার্কিট হাউজে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদেরনেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তৎকালীন যুবনেতা শেখমুজিব।


১৯৬৬ সালে:

১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন চলাকালে খুলনার এক বিশাল জনসভায়ভাষণ দেন  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনসভাশেষে তাঁর যশোর হয়ে ঢাকাতে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঐ সময় ঢাকা না ফিরে কয়েকজনসহকর্মী নিয়ে যশোরে মশিয়ূর রহমানের বাসভবণে রাত্রি যাপন করেন। পরের দিন যশোর ঈদগাহময়দানের পাশে থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মোসলেম খানের নির্দেশে এক আটকাদেশ বলে তাঁকেগ্রেফতার করা হয় এবং কোন জামিন ছাড়াই তাঁকে ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এসময়মশিয়ূর রহমান উক্ত আটকাদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাঁরই প্রচেষ্টায় কোর্ট সোপর্দকরতে বাধ্য হয়। কোর্ট মশিয়ূর রহমানের সুন্দর বাচনভঙ্গী ও  যুক্তিতর্কে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেআন্তবর্তীকালীন জামিনে মুক্তি দেয়। সামরিক সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুকে জামিন লাভ করানোমশিয়ূর রহমানের একটি বিরাট সাফল্য।


১৯৬৭ সালে :

১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পরে ১৯৬৭ সালে টাউন হল ময়দানেরমুক্ত মঞ্চে বক্তব্য রাখেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সেদিন অনলবর্ষী ভাষণ দেন। সেদিন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর সাথেকয়েকজন সঙ্গীত শিল্পী ছিল। বঙ্গবন্ধু একেকটি দফা নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী সঙ্গীতপরিবেশন করছিলো। এভাবে মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনায় সেদিন তিনি ৬ দফা উপস্থাপন করেন। এদিনেরবক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন-আয়ুব খান তুমি পূর্ব বাংলার কতটুকু জান! তুমি বাঙালীকে দুর্বলমনে কর। বাঙালী দুর্বল না। এই বাংলার মাটি বর্ষায় নরম হয়, চৈত্র মাসে ফেটে চৌচির হয়েযায়। তার এক টুকরো কপালে মারলে রক্ত ঝরবে। বাঙালী যেমন নরম হতে জানে, তেমনি শক্ত হতেওজানে।


১৯৬৯ সালে:

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক এবং বর্তমান যশোর জেলাজাসদের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা অশোক রায়েরও সুযোগ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যেযাওয়ার। তিনি নিজেকে এ জন্যে ধন্য মনে করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে এবং উপহার দিয়েতাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে।


১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কথিতআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগের পরে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথ্থাানঘটে। সেবছরই ২২ ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব কারামুক্ত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগতৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা দেয়। সংবর্ধনায় ছাত্রলীগ সভাপতি ও ডাকসু ভিপিতোফায়েল আহমেদ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত করেন। এরপর জেলায় জেলায় শুরু হয় বঙ্গবন্ধুরসংবর্ধনা। তারই অংশ হিসেবে ৩০ আগষ্ট যশোর টাউন হলে জেলা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুর সংবর্ধনারআয়োজন করে। এদিন সমাবেশের প্রচার মাইকিং করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা খুরশিদ আনোয়ারবাবলু এবং অ্যাড. রওশন আলীর ছেলে আবু সেলিম রানা। এসময় ইয়াহিয়া খানের মার্শাল লচলার কারণে খোলা ময়দানে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় টাউন হলে সংবর্ধনার আয়োজন করাহয়। জেলা আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুকে একটি রুপার খেজুর গাছ  উপহার দেবার সিদ্ধান্ত নিলে ছাত্রলীগ কি দেবে তানিয়ে ভাবতে থাকেন। সেসময় ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের পকেটে টাকা থাকতনা। সিদ্ধান্ত হলোঅশোক রায় যেহেতু ভালো ছবি আকতে পারে, সেহেতু তিনি বঙ্গবন্ধুকে একটি ছবি একে দেবেন।এ কথা শুনে আওয়ামীলীগের এক নেতা পরামর্শ দেন, বঙ্গবন্ধু ছাড়াও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীওেএকটি ছবি আঁকলে বঙ্গবন্ধু আরো বেশী খুশী হবেন। যে কথা সেই কাজ।  নিজেদের পকেট কুড়িয়ে পোনে চার টাকায় দুটোআর্ট পেপার, একটি ফোর এইচ পেন্সিল, একটা রাবার, এক পট চায়না কালি কিনে অশোক রায়কেদেয়া হয়। তিনি বড় আর্ট পেপারে ছবি আকতে থাকেন। সেই দুটি ছবি আওয়ামীলীগের এক নেতারখরচে কাঁচ দিয়ে বাঁধানো হয়। যথারীতি ছবি দুটি নিয়ে ছাত্রলীগ হাজির হয় টাউন হলে। তখনশুধু হল নয়, পাশের মাঠেও হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায়। টাউন হলের সংবর্ধনায়বঙ্গবন্ধুকে জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া হয় ‘রূপার খেজুর গাছ’ ।


বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামীলীগের সংবর্ধনা দেবার পরে জানানো হয়,ছাত্রলীগও সংবর্ধনা দেবে। তিনি উল্লসিত হয়ে জানান, ছাত্রলীগের সংবর্ধনা নেবেন সন্ধ্যায় সড়কবিভাগের বাংলোয়। সেখানে ছাত্রলীগ মিছিল নিয়ে যথাসময়ে হাজির। বাংলোর বারান্দায় সোফাসাজানো। বঙ্গবন্ধু এলেন। সেখানে ছাত্রলীগের নেত্রীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আলী হোসেন মনি, খানটিপু সুলতান, রবিউল আলম, রাজেক আহমেদ, নজরুল ইসলাম ঝর্ণা, কামরুজ্জামান বাচ্চু, শেখআব্দুস সালাম, মশিয়ার রহমান, আলীমুশ^ান, আব্দুল হাই প্রমুখ। সেসময় বক্তৃতা পবের্র পরেবঙ্গবন্ধুর হাতে ছবি দুটো তুলে দিতেই তিনি উল্লসিত কণ্ঠে ছবি দুটির প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধুনিজের ছবি দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠেন, কে এঁকেছে? কে করেছে এ ছবি? তখন সাধারণনেতা-কর্মীদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন অশোক রায়। সহকর্মীরা তাকে চ্যাংদোলা করে বঙ্গবন্ধুরকাছে পৌঁছে দেয়। তাকে জড়িয়ে ধরেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু।


বেশ প্রশংসা করে অশোক রায়কে বলেন, ‘রিক্ত আমি সিক্ত আমি/দেবারকিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা/ তোকে দিলাম তাই।’ একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নিজ পকেট থেকে দু’টি৫০ টাকার নোট তার হাতে ধরিয়ে দেন। অশোক ভীষণ লজ্জায় টাকা নিতে চাইলেন না। বঙ্গবন্ধুতাকে জোর করে ওই টাকা ধরিয়ে দেন। তার সেই পুরস্কার পরদিন টক অব দি টাউনে পরিণত হয়।আর এ থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে বেশ পরিচিত হয়ে পড়েন তৎকালীন এ ছাত্রনেতা। এরপর যশোরে যখনইএসেছেন বঙ্গবন্ধু একনজর দেখেই কাছে ডেকে নিয়েছেন অশোক রায়কে। শুধু তাই নয়সোহরাওয়ার্দীর ছবি আওয়ামী লীগের তৎকালীন কার্যালয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি তাঁর বেডরুমেটাঙানো হয়েছিল।


১৯৬৯ সালের ৩০ আগষ্ট রাতে সড়ক ও জনপথ এর গেষ্ট হাউজে রাত্রী যাপন করেন  


১৯৭০-এর নির্বাচনে :

১৯৭০ সালে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য মার্চ বঙ্গবন্ধু নির্বাচনীপ্রচারে ঝটিকা সফর করেন সারাদেশ। নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল সাংগঠনিকতৎপরতা বৃদ্ধি করা। পুরো সত্তর সাল সারা দেশ ঘুরে বেড়ান বঙ্গবন্ধু। ৯ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু খুলনারজনসভা থেকে ফেরার পথে যশোরে আসেন।


খুলনা থেকে মিটিং করে যশোরে ফেরার পথে রুপদিয়া বাজারেনির্বাচনী প্রচারের জন্য গেট করা হয় বর্তমান নারিকেল হাটার কাছে। যশোর সদরের রওশনআলী ছিলেন নির্বাচনী প্রার্থী। সেসময় বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ষ্টেজে উঠে বলেন- ভাইসব এখানেআমি বেশী সময় দিতে পারবনা। আপনার যশোর টাউন হল মাঠের প্রগ্রামে আসেন। সেদিনেরপ্রগ্রামে উপস্থিত ছিলেন নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আকরামবিশ^াস।


৯ ফেব্রুয়ারী সকাল ১১ টায় তাঁর গাড়ীবহর যশোর শহরের খুলনাস্ট্যাণ্ডে পৌছলে সেখানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর গলায় মালা পরাবারসুযোগ পান অশোক রায়। তবে তিনি ভিড় ঠেলে গাড়ীর পাশে যেতে পারেননি। অগত্যা তাঁকেবহণকরা খোলা জিপের  বনেটের উপর দাড়িয়েবঙ্গবন্ধুর গলায় মালা পরান, যা ছিল এক অন্য রকম ঘটনা। এরপর ধীরে ধীরে শহরের রবীন্দ্রনাথসড়ক পথে তাঁর গাড়ীর বহর চলতে থাকে। এসময় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা রবিউল আলম ‘জয়বাংলা’ যশোরে প্রথমবারের মত স্লোগান তুলে প্রকম্পিত করেন গোটা শহর।


সেদিন বঙ্গবন্ধুর গাড়ীবহর ঘিরে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগেরনেতাকর্মীরা শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে গণপুর্তের ডাকবাংলো পর্যন্ত এসেছিল। সে মিছিলেঅশোক রায় বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকা নিজ হাতে তৈরি ফেস্টুন নিয়ে চলছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সড়কেরমাঝ বরাবর মিছিলটি আসলে বঙ্গবন্ধুর চোখের ইশারায় অশোক রায় তাঁর গাড়ীর পাশে চলেআসেন। এসময় আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতা ধমক দিলেও বঙ্গবন্ধুর ফের ইশারায় জিপের পাদানিতে উঠে উপরের হ্যাণ্ডেল ধরে দাড়িয়ে যান অশোক রায়। বঙ্গবন্ধুর ঠিক পাশে জিপে ঝুলেঅশোক রায় সমস্থ পথ শ্লোগান দিতে দিতে ডাকবাংলো পর্যন্ত আসেন। এসময় বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন করেছাত্রলীগের খোজ খবর নেন।


সেদিন সে মিছিলে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের  মাঝে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন,জামালউদ্দীন প্রমুখ। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মাঝে ছিলেন শেখ আব্দুস সালাম, আলী হোসেন মনি,মশিয়ার রহমান, খয়রাত হোসেন প্রমুখ।


সেদিন বিকাল তিনটায় তিনি যশোর ঈদগাহ ময়দানে ভাষণ দেন।অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল খালেক, সোহরাব হোসেন , শহীদ মশিউর রহমান, রওশন আরীপ্রমুখ ব্যাক্তি উপস্থিত ছিলেন।


১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় বঙ্গবন্ধু যশোর রেষ্ট হাউজেআসলে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাংগঠনিক সাক্ষাৎ করেন যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের বারীসাহেব খ্যাত  এম এ বারী। তিনি বঙ্গবন্ধুর শুধুস্নেহভাজন ছিলেন না, বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়িতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সাক্ষাতের সময়  বঙ্গবন্ধুর একপাশে বসেছিলেন রওশন আলী, অন্যপাশে এমএবারী। এসময় যশোরে  আওয়ামী লীগের বিভিন্নসমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দুজনের উদ্দ্যেশ্যে বলেন, সংগঠন একসাথেমিলেমিশে চালাতে কেউ হাত মেলায়, কেউ বুক মেলায়। আয় আমরা মাথা মেলাই। একথা বলেবঙ্গবন্ধু দুপাশে বসা দুজনের মাথা ধরে নিজের মাথার সাথে ঠুকাঠুকি করেন, যা পরে সার্কিটহাউজের বদ্ধ ঘরের বাইরে প্রচার হলে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়।


১৯৭০ সালে যশোরের ঝিকরগাছা থানায় সরাসরি ব্যালটের মাধ্যমেথানা আওয়ামীলীগের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঔই নির্বাচনে বিপুল ভোটে সভাপতি পদে ডা.গোলাম সরোয়ার এবং সাধারণ সম্পাদক পদে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুখুলনা যাবার পথে বিমানযোগে যশোরে আসলে ঝিকরগাছা  থানা আওয়ামীলীগের নবনির্বাচিত  নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহীদ মশিয়ুর রহমানের নেতৃতে¦বিমান বন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির হন। সেখানে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকেবিপুল সংখ্যক গাড়ি বঙ্গবন্ধুকে নিতে এসেছিল। সেসময় সমবেত হাজারো মানুষের সামনে শহীদমশিয়ুর রহমান বঙ্গবন্ধুর সাথে ঝিকরগাছা থানা আওয়ামীলীগের ব্যালটের মাধ্যমে নবনির্বাচিতসাধারণ সম্পাদক হিসেবে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি হাসিমুখেসস্নেহে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কপালে চুমু খান এবং পিঠ চাপড়ে মাথায় হাত দিয়েআর্শীবাদ করেন।


১৯৭০ সালের সময়কালে বঙ্গবন্ধুর সাথে স্মৃতির কথা বলেন মুক্তিযোদ্ধাআব্দুল মান্নান, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছোটখাটো একটা গাড়ীবহর নিয়েঝিনাইদহ থেকে যশোরের দিকে আসছিলেন। খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী মিলেনতুন খয়েরতলা ভাষ্কর্য মোড়ে দেবদারুর পাতা দিয়ে একটা গেট বানাই। সেখানে বঙ্গবন্ধুরগাড়ীবহর দাঁড় করাতে রাস্তায় দাড়িয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে আসেন। ছোট গাড়ি থেকে বিশালদেহীবঙ্গবন্ধুকে নামতে দেখে আমরা থতমত খেয়ে যায়। তিনি জিঞ্জেস করেন, আমরা কি চাই। আমিবলি, আমরা ছাত্রলীগ করি, আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে  বুকের ভিতর টেনে নেন। জিজ্ঞেস করেন, আমাদের সাথেবড় কেউ আছে কিনা! আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে আশেপাশে খুজতে থাকি। কিছু দুরেই দেখতেপাই, তৎকালীন থানা কৃষি অফিসার লে. কর্ণেল আকরামের বাবা নেছার উদ্দীন দাড়িয়ে আছেন।তাঁকে ইশারা করে ডাকতেই তিনি এগিয়ে এসে পরিচয় দিলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে হ্যাণ্ডসেক করে বলেন,এই ছেলেগুলো খুব ভালো। ওদেরকে দেখে রাখবেন। ওদের কর্মসূচী থাকলে একটু খোজ খবররাখবেন। সেই থেকে কৃষি কর্মকর্তা নেসার উদ্দীন আওয়ামীলীগের কর্মী বনে যান। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি আওয়ামীলীগ ত্যাগ করেননি।


১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে মশিউর রহমানের সহধর্মিনী সরকারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকা জনাবা মাহমুদা রহমানের ব্যবহৃত মাইক্রো চড়ে চুয়াডাঙ্গাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বর্তমানে সেই গাড়িটি কালেক্টরেট চত্বরে সংরক্ষিত আছে। সেই চালকসিদ্দিকুর রহমান জানিয়েছেন একবারই এই গাড়িতে চড়েন বঙ্গবন্ধু।


বঙ্গবন্ধু  ১৯৭০ সালেইমাগুরা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলসহ কুষ্টিয়ার বেশ কয়েকটি মহকুমায় জনসভা করতে যশোরে এসেওয়াপদা রেষ্ট হাউজে ওঠেন। তাঁর সাথে ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী সহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাওছিলেন। সেসময় কয়দিন টানা বৃষ্টি। সেসময় বঙ্গবন্ধুর জীবনাচরণ খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগহয়েছিল তৎকালীন যশোর ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের।


এক সাক্ষাৎকারে বর্তমান জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি ওতৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্ররীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম বলেন, ১৯৬৯ থেকে ৭০সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় যশোরে সড়কের বাংলোয় দুবার এবং  পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোয় একবার বঙ্গবন্ধুরাত্রিযাপন করেছিলেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোয় থাকাকালীন প্রচণ্ড বর্ষায় তিনি তিনদিনতিন রাত আটকে ছিলেন।’ সেসময় বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়ার দেখভাল করতেন রবিউল আলম। সেসময়খিচুড়ির সাথে ইলিশ মাছ ভাজা, কৈ মাছের দোপেঁয়াজা ইত্যাদিও বন্দোবস্ত করা হয়েছিলো।কেশবপুর থেকে বড় বড় কৈ মাছ আনা হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু কৈ মাছ খুব পছন্দ করতেন।


বঙ্গবন্ধু সেপ্টেম্বরে যান মাগুরা ও নড়াইল। সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিতহয় ৭ ডিসেম্বর।


১৯৭২ সালে:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে যশোর বিমানবন্দরে নেমে খুলনা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে জনসভা করতে যেতেন।কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে যশোরে জনসভা করে উঠতনা। তৎকালীন ছাত্রলীগের মনে এটা নিয়েঅভিমান ছিলো। তারা বিষয়টি এমপি রওশন আলীকে জানান। রওশন আলী পরামর্শ দিলেন বিমানবন্দরে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে। যে কথা সেই কাজ।তৎকালীন যশোর এমএম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল খালেক যশোর বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকেঘেরাও করে যশোরে জনসভা করার দাবী জানান। সেই দাবী অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু যশোরে জনসভাকরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে যাওয়ার স্মৃতিচারন করতে যেয়ে যশোর জেলা আওয়ামীলীগেরসহ-সভাপতি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল খালেক জানান, ‘১৯৭২ সালের কথা যশোরে তখনআমাদের  সর্বোচ্চ নেতা এমপি রওশন আলী।তাঁর কাছে আমাদের অভিমান জানালাম। তিনি পরামর্শ দিলেন, বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেহবে। খুলনায় একটি জনসভা শেষ করে সড়ক পথে বঙ্গবন্ধু যশোর বিমান বন্দর হয়ে  ঢাকায় যাবেন। খবর পেয়ে আমরা সমমনা বেশ কয়েকজনদুপুরে খেয়ে এমএম কলেজের পুরাতন হোষ্টেলের সামনে সমবেত হলাম। আমি ছাড়াও ছিলেনআব্দুল মান্নান, মোহন প্রমুখ। আমরা তখন বিমান বন্দরকে বেলেরমাঠ বলতাম। তখনকার ছাত্রলীগনেতাদের পকেটে টাকা থাকতোনা। আমরা পুরাতন কসবা থেকে ২০/২০ জনের একটা দল হেটেবেলেরমাঠ পৌছলাম। সেখানে দেখলাম  আতরআলীর চিরচেনা জিপ গাড়িতে করে আওয়ামীরীগ নেতা রওশন আলী ও আশরাফ আলী আগেইপৌছেছেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যেভাবেই হোকবঙ্গবন্ধুকে ধরতেই হবে। তিনি যদি সরাসরি বিমান বন্দরের ভিতরে চলে যান, তাহলে প্রয়োজনেপাচিল টপকে ভেতরে যাবো। সেসময় পাচিল ছিলো অনেক নিচু। আমরা সেভাবে দাড়ালাম। এর মাঝেইবঙ্গবন্ধুর গাড়িবহর এসে পৌছল। আমিসহ বেশ কয়েকজন গাড়ির সামনে দাড়িয়ে গেলাম। গাড়িদাড়ালো। বঙ্গবন্ধু নিজহাতে গাড়ির ডালা খুলে বেরিয়ে এলেন। আমরা বিশালদেহী বঙ্গবন্ধুকেদেখে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকি। আমাদের মুখে আর কথা থাকেনা। এসময় বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, ওরওশন তোমার পিচ্ছি বাহিনী কি বলতে চায়? রওশন চাচা কিছু বলার আগে আমি একটু সাহসকরে বলে উঠি আপনি সব যায়গায় যান, যশোরে কবে জনসভা করবেন তা জানতে চাই।


এসময় বঙ্গবন্ধু আমার গায়ে -মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন-এই কথা!যাও, এক সপ্তাহের মধ্যে আমি জানাচ্ছি। এরপর সত্যিই এক সপ্তাহের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু যশোরষ্টেডিয়ামে জনসভা করেছিলেন।’


স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান হেলিকপ্টারে করে যশোরে প্রথম আসেন ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর। যশোরস্টেডিয়ামে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দেন তিনি। ওইদিন রাত্রিযাপন করেন যশোর সার্কিট হাউসে। এইজেলার ইতিহাসে স্টেডিয়ামের সর্ববৃহৎ জনসভায় ভাষণ দেন সেদিনের রাষ্ট্রনায়ক ও স্বাধীনতাসংগ্রামের এই মহানায়ক। তবে তা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই এই ইতিহাস।


‘তেমনি রক্তের ঋণ মশিয়ূর, ভরে রাখে স্মৃতির ভাণ্ডার’

উর্বর বেয়নেট ছিন্ন ভিন্ন দেহ যার

তাঁর জন্য শোক নেই, খুজবোনা তাকে আর

যে শোনিতে দু:খ মোছে,বন্দিনী বাংলার

তেমনি রক্তের ঋণ মশিয়ূর, ভরে রাখে স্মৃতির ভাণ্ডার।


যশোর পৌর উদ্যানে শহীদ মশিয়ূর রহমানের স্মৃতিফলকেরভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত এইস্মৃতিফলকের শিলালিপিতে এভাবেই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মউৎসর্গকারী সূর্যসৈনিকদের অন্যতম যশোরের চৌগাছার কৃতিসন্তান তৎকালীন মেম্বর অব এ্যাসেম্বলী (এমএনএ)মশিয়ূর রহমানকে স্মরণ করা হয়েছে।


একই দিনে শহরের পুরাতন বাস টার্মিনালের বিজয় স্তম্ভেরভিত্তিপ্রস্তরও উদ্বোধন করেন তিনি। ঐ একই দিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শন করেন বঙ্গবন্ধু। মেজরজেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভুইয়া স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন-‘আমি তখন ১২ ইষ্ট বেঙ্গলরেজিমেন্টর ভারপ্রাপ্ত কমাণ্ডিং অফিসার। দিনটা ছিল ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু যশোরক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শনে এলেন। এ সময় ১২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শন করলেন। পরিদর্শনকালেট্রুপসদের মহড়া দেখলেন, কোয়ার্টার গার্ড পরিদর্শন করলেন, পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করলেন,অফিসার্স মেসে কিছুক্ষণ কাটালেন। তাঁকে সেদিন মহড়ার সময় এবং পরিদর্শনকালে অতি কাছ থেকেদেখার এবং তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার। আপ্যায়ণের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একবিশেষ মুহুর্তের ছবিও রয়েছে আমার।’


সেদিন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন জেলাআওয়ামী লীগের সে সময়কার সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট খান টিপু সুলতান এমপি। প্রয়াত টিপুসুলতান সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেদিন জেলায় দিনব্যাপীকর্মসূচি সেরে সার্কিট হাউসে রাতযাপন করেন। আমার (টিপু) নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিতসাংস্কৃতিক সংগঠন স্বরলিপির শিল্পীদের গান শোনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আমি অনুরোধ করি।’ তিনিবলেছিলেন, ‘ঠিক রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে গান শোনানোর সময় ঠিক করা হয়। সার্কিট হাউসের এককক্ষে সঙ্গীতের আসর বসে। স্বরলিপির শিক্ষার্থী শিল্পীদের নিয়ে প্রবেশ করি আমি।’ টিপু সুলতানবলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তখন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরিহিত অবস্থায় বিছানায় বসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকেডাকলেন। বসতে দিলেন তাঁর পাশে। বঙ্গবন্ধুকে গান গেয়ে শোনালেন শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদ,প্রণব ঘোষ, মধুসূদন, নাজনীন সুলতানাসহ অন্যান্য শিল্পী। গানের ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধু আমারসাথে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন। আলাপচারিতার একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাকে (টিপু) বলেন,একাকী থাকলে হাসুর মার (শেখ হাসিনার মা, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) কথা খুববেশী মনে পড়ে। তার কারণ জানিস?


বঙ্গবন্ধু আবার বলতে থাকেন, ‘৬-দফা ঘোষণার আগে বেশ চিন্তিতছিলাম,আমি গ্রেফতার হতে পারি, মারা যেতে পারি।’বঙ্গবন্ধু এ সময় বলেন, ‘কিন্তুস্ত্রী-সন্তানদের জন্য কিছু করতে পারিনি। তাদের কি হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হাসুর (হাসিনা)মা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। তাদের জন্য কোনো চিন্তা না করতে বলেছে। শুধু বলেছে, জাতিরজন্য তোমাকে উৎসর্গ করেছি।’


বঙ্গবন্ধু টিপুকে বলেছিলেন, ‘হাসুর মার জন্য আমি বঙ্গবন্ধু, আমিজাতির জনক।’ সেদিন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সেই সময়কার ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাজেক আহমেদ। তিনি এই মহাপুরুষের স্মৃতি চারণকরতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেকবারই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগহয়েছে তার। তিনি বলেন স্বাধীনতার আগে এবং পরে খুলনায় প্রোগ্রাম থাকলে বঙ্গবন্ধু বিমানেচড়ে যশোর হয়ে যেতেন। এসময় হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে আমিও উপস্থিত হতাম সেখানে। একবারেরস্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার পরিচিত এক রিক্সাচালক (নাম মনে নেই), বড়ি গোপালগঞ্জ,ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিল বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখবার। একদিন তার কথা মতো যশোর বিমান বন্দরেনিয়ে গেলাম। সেই রিক্সাচালককে বঙ্গবন্ধুর সামনে নিয়ে বললাম বঙ্গবন্ধু এ আপনাকে দেখতে এখানেএসেছে। ও আপনার দেশের লোক, এসময় বঙ্গবন্ধু রাজেক আহমেদের পিঠে আদর করেই একটা চড়দিয়ে বলেন, তুই কোন দেশের?


রাজেক আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে যেমন দেখা যায় বাস্তবেতিনি ছিলেন আরো আকর্ষণীয়। তাঁর সামনে দাঁড়ালে মনে হতো অনেক আগে থেকেই তাঁরসাথে সম্পর্র্ক, অনেক আপনজন। তাঁর কাছ থেকে সরতে ইচ্ছে করতো না।


কৃষি তথ্য সার্ভিস (এএস আই) ওয়েবসাইটে ‘আমার বঙ্গবন্ধু’শিরোনামে  প্রকাশিত একটি স্মৃতিচারণমুলকপ্রবন্ধে লেখা হয়েছে-


‘আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। আনন্দেরজোয়ার বইল। কিন্তু তবু বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে না পাওয়ার বেদনা আমাদের প্রতিমুহূর্তে উদ্বিগ্ন করে রাখল। তারপর এলো সেই সোনালি দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি।স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলেন আমাদের মাঝে।


শুরু হলো নতুন দেশের নবযাত্রা। হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা ফিরেএলাম স্কুলে। লুটপাটে বিধ্বস্ত বিবর্ণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অর্ধশতাব্দি বয়সীঐতিহ্যবাহী স্কুল। দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো ফিরে আসছে, চলছে পুনর্বাসনও পুনর্গঠনের কাজ। অক্লান্ত বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীরা নিরন্তর সচেষ্ট থেকে কাজ করছেনপুনর্গঠনের। এর মধ্যে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু যশোরে আসবেন। জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেনস্টেডিয়ামে।


আমাদের দর্শনা থেকে যশোর ৫২ মাইল দূরে। তাতে কি? অনেকচেষ্টায় কেরু কোম্পানির একটি ট্রাক যোগাড় করা গেল। এই খোলা ট্রাকে দাঁড়িয়ে আমরাছাত্রলীগের কর্মীরা গেলাম- স্বাধীনতার মহানায়ককে সালাম জানাতে, তাঁকে একনজর দেখতে।স্টেডিয়ামের কাছে ট্রাক নিয়ে যাওয়া গেল না, মানুষের ঢল নেমেছে। আমরা জনস্রোতে মিশেস্টেডিয়ামের দিকে প্রবাহিত হচ্ছি। পাছে হারিয়ে না যাই- সেজন্য একজন আর একজনের কোমরধরে বা হাত ধরে এগোচ্ছি। অনেক কষ্ট করে পদদলিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামেরএক কোনায় ঠাঁই নিতে পারলাম। দুচোখ সার্থক হলো ইতিহাসের মহানায়ককে দেখে, শ্রবণ ধন্যহলো-তার দেশ গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত ভাষণ শুনে।


যশোর প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি:

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে যশোর প্রেস ক্লাবের সঙ্গেও। শহরেরমুজিব সড়কে প্রেস ক্লাব নির্মাণের জন্য ১৮ শতক জমি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্লাবের সেদিনেরসভাপতি তৌহিদুর রহমান জানান, ১৯৭২ সালে সার্কিট হাউসে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখাকরতে গিয়েছিলেন তিনি সহ সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মীর। অনেকটা খোলামেলাভাবেইসার্কিট হাউসের সামনে বসেছিলেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সন্ধ্যা থেকে প্রচণ্ডভিড় ছিল সেখানে।


সাক্ষাৎপর্ব শেষে রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি কক্ষের দিকেযাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন মীর বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়েযান এবং নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসেনএবং কথা বলার আগ্রহ দেখান। ক্লাবের তিনি এবং সম্পাদক প্রথমেই বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্লাবের জন্যএক খণ্ড জমির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এ সময় ক্লাবের বর্তমান স্থানটি (মুজিব সড়কে)এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে ক্লাবের নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দআক্তার আলীকে নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।


বেনাপোল বন্দর পরিদর্শন :


১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেনাপোল পরিদর্শন ওআওয়ামীলীগ প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করেতিনি বেনাপোলে আসেন। তিনি এসময় পাট মন্ত্রণালকে আমদানিকৃত পণ্য রাখার জন্য গুদাম নির্মাণেরনির্দেশ দেন।


বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত গাড়ী সংরক্ষণ:

সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহৃত একটি গাড়ী কালেক্টরেট ভবনের সামনেপ্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। যেখানে লেখা রয়েছে ‘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯সালে  চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার সময় গাড়িটি ব্যবহারকরেন। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধেও সময় তৎকালীনমুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার রাজেক আহমেদ এই গাড়ীটি ব্যবহার করেন। গাড়ির নাম্বার যশোর-ব-২১৪।১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে গাড়ীটি ব্যবহৃত হয়। গাড়ীর মালিকযশোর মোমিন গার্লস স্কুল। গাড়ীর চালক ছিলেন মো: সিদ্দিক হোসেন।’


যশোরের পরতে পরতে বঙ্গবন্ধুর পদধুলি পড়লেও  সেই সব স্মৃতি ধরে রাখার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমানহয়নি। যদি জাতীয়ভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরস্মৃতিধন্য  যশোর শহরের খড়কীর পীরবাড়ী,  ছাতিয়ানতলার আদমভিলা, চাঁন্দুটিয়ার রফীউদ্দীনপরিবারের দহলীজ খানা অথবা কেশবপুর, মনিরামপুর , ঝিকরগাছা ও চৌগাছার স্মৃতিচিহ্ন  যদি সংরক্ষণ করা যায় অথবা স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণেরউদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু আরো জীবন্ত হয়ে উঠবেন।


লেখক: সাংবাদিক, গবেষক এবং সম্পাদক: bangabandhuvision.com


SUMMARY

2325-1.jpg