সফিয়ার রহমান
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী একজন মানুষ কখন হয়? যখন দেখা যায় এক হাজার বছরের মধ্যে বাংলার জনপদে যে কোন ক্ষেত্রে তাঁর বড় অবদান রয়েছে। যা চির স্বরণীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর আসন দখল করেছেন। বিভাবে করলেন? হাজারটা উত্তর আছে। সেদিকে না গিয়ে একটা বিষয় অন্তর থেকে অনুভব করলেই পরিস্কার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচেছিলেন প্রায় পঞ্চান্ন বছর। বৃটিশ আমলে (১৯৩৮) স্কুল ছাত্র জীবন থেকে দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত তিনি মোট ৪,৬৮২ দিন অর্থাৎ প্রায় চৌদ্দ বছর জেল খেটেছেন দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে। জীবনের চার ভাগের প্রায় এক ভাগ সময় জেলে কাঁটালে শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর মর্যাদা প্রাপ্তি সহজ হয়ে যায়। এতে কোন সন্দেহ নেই।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সহজ, সরল, হাস্যরসাত্বক ও ক্ষেত্র বিশেষ বজ্র কঠিন মানুষ। তাঁর জীবন থেকে কিছু খন্ডচিত্রে তা অতি সহজে অনুমেয়--
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি থাকেন তাঁর নিজ বাস ভবন বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডিতে। একদিন সকালে দুই তলাতে মহাব্যস্থ জরুরি মিটিং এ যাবেন। বাড়ির গেটে দারোয়ান চেঁচামেচি করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উঁকি মেরে দেখলেন একজন সাধারণ পোষাকের বৃদ্ধ দারোয়ানের হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলছে, সর ব্যাটা আমার মুজিবের কাছে যাব তার আবার কিসের অনুমতি লাগবে। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরটা খুব পরিচিত মনে হল। মনে পড়ে গেল শৈশবের পণ্ডিত স্যারের কথা। এতো সেই স্যার। দরাজ গলায় দারোয়ানকে ছেড়ে দিতে বললেন। স্যারকে কাছে পেয়ে, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরলেন। খাওয়া দাওয়া এক টেবিলে করলেন। তাঁর ব্যস্থতার কথা বলে স্যারকে থাকতে বললেন। স্যার বিশেষ কাজ থাকায় থাকলেন না। বিদায় নিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তড়িঘড়ি গুছিয়ে নিচ্ছেন এমন সময় মনে পড়ল, আহারে স্যার এল আমার বাড়িতে অথচ তাকে নতুন কাপড় কেনার জন্যে কিছু টাকা দেওযা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে কাজের লোককে ডাকলেন এবং বললেন, তাড়াতাড়ি নিচে যাও এবং আমার স্যারকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলবে যেন নতুন জামা কাপড় কিনে নেন।
গাড়িতে চড়ে গেটের বের হচ্ছেন, দেখেন স্যাার গেটের সামনে রিকসার জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। ড্রাইবারকে গাড়ি স্লো করতে বললেন। স্যারকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, স্যার সময়ের অভাবে নিজের হাতে কিনে দিতে পারলাম না। খামের মধ্যে এক হাজার টাকা আছে। মনে কিছু না নিয়ে ভাল জামা কাপড় কিনে নেবেন। স্যার বললেন, বাবা তুমিতো এক হাজার দাওনি। পাঁচ শ টাকা দিয়েছো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব বুজলেন। বললেন, স্যার যে দেশে দুই তলা থেকে এক হাজার টাকা দিলে নিচ তলায় এসে পাঁচ শ টাকা হয়ে যায় সেই দেশ আমি চালাব। আমার জন্যে দোযা করবেন।
দেশের সহজ সরল কৃষক সমাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাগলের মত ভালবাসতেন। কথিত আছে একবার এক কৃষক তার ক্ষেতের সবজি তুলে বঙ্গবন্ধুর জন্যে নিয়ে এলেন। বঙ্গবন্ধু ঐ কৃষককে কাজের লোকের মাধ্যমে বিশ টাকা বকসিস পাঠালেন। কৃষক টাকা পেয়ে রেগে গেলেন। হনহন করে হেঁটে উপরের তলায় বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির। দশ টাকা হাতের মধ্যে গুজে দিয়ে কৃষক বললেন, বাবারে আমি কি টাকার জন্যে আনলাম! আমিতো ভালবেসে এনেছি। বিশ টাকা দশ টাকা হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু নির্বাক হয়ে গেলেন। কর্মচারী সামনে থেকে সরে পড়ল।
দেশ স্বাধীনের আগে একবার এক জনসভায় সঠিক সময়ে যাওয়ার জন্যে রাতে নৌকায় চড়ে রওনা হলেন। মাঝপথে নৌকায় ডাকাতেরা হানা দিল। মাঝি হেঁকে উঠে বলল, জানিস, নৌকায় কে আছে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডাকাতেরা তাদের নৌকা নিয়ে সরে পড়ল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য বার বার জেলে যেতে হয়েছে। ৫৫ বছর (১৯২০-১৯৭৫) বয়সের মধ্যে তিনি প্রায় চৌদ্দ বছর জেল খেটেছেন। তাই তিনি হাসতে হাসতে প্রায়ই বলতেন, “জেলখানা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। আমাকে ঘন ঘন সেখানে যেতে হয়। যার দুই বাড়ি তার শুধু এক বাড়িতে থাকলে চলে না, দু’বাড়িরই খোঁজ খবর রাখতে হয়।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার জনৈক বিদেশী সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনার যোগ্যতা কী? বঙ্গবন্ধু বললেন,আমি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি।. চট করে বিদেশী ঐ ঝানু সাংবাদিক অন্য একটি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, আপনার অযোগ্যতা কী? বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে বললেন, আমি তাদের বড্ড বেশী ভালোবাসি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পদক পুরস্কার পাওয়ার চাইতে দেশের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাকে যখন জুলিও কুরি বিশ্ব শান্তি পদক গ্রহনের জন্য বিদেশে যাওয়ার আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল তিনি তখন বলেছিলেন। ‘যুদ্ধ বিধস্ত দেশের পুর্নগঠনের এই জরুরি মুহূর্তে তাঁর পক্ষে দেশ ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়’। তাঁর এই জবাব পেয়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল রমেশ চন্দ্র ঢাকায় এসে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে পদকটি দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণদানে বজ্রকঠিন হলেও সরল প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর শাসন আমলে দেওয়ালে এমন পোষ্টার আটা হয়েছিল- বঙ্গবন্ধু কঠোর হও। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা একবার বলেই ফেললেন- ওনার পা দ’ুটো কেঁটে বাদ না দিলে দেশের কিছু হবে না। শত অপরাধ করেও তাঁর দুই পা চেপে ধরতে পারলে সাত খুন মাফ। (ভোরের ডাক ৮ জুলাই ২০০৬)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৪ সালে একদিন ট্রেনে করে ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ যাচ্ছেন। সেখানে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পাকিস্থান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাকে ভোট দেওয়ার জন্যে তিনি জনগণকে বলবেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ একটি মাছ মারা ছিপ হাতে শেখ মুজিবের কামরার দরজায় অন্যান্যের সাথে ভিড়ে ঝুলতে ঝুলতে পথ চলেছেন। শেখ মুজিব এ দৃশ্য দেখে দরজা খুলে ভিতরে ডুকিয়ে নিতে বললেন। কবির হাতের ছিপটি নিয়ে শেখ মুজিব মাছ ধরার ভঙ্গিতে বসে ট্রেনের কামরায় ছিপ ফেলতে শুরু করলেন। সহযাত্রীরা স্বশব্দে হেসে উঠলেন। শেখ মুজিব বললেন- “এটা আমার খুব প্রিয় নেশা ছিল এক সময়। এখন সময় পাই না, তাছাড়া আমার ধৈর্যের অভাব আছে। আমি বেশিক্ষণ এক নাগাড়ে এক জায়গায় বসে থাকতে পারি না।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭০ এর দশকে প্রায় পুরো সময় জুড়েই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্ধি অবস্থায় কাটাতে হয়। ব্যক্তি জীবনে বঙ্গবন্ধুর শখ ছিল পাখিপোষা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্ধি থাকাকালীন পাখি প্রেমী বঙ্গবন্ধু নিজ কক্ষের সামনে একটা ময়না পাখি পুষতেন। বঙ্গবন্ধু যে খাঁচায় ময়না পুষতেন তা ভাঙ্গাচুরা অবস্থায় এখনো আছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। জেল কর্তৃপক্ষ জাতির পিতার একটি দুর্লভ স্মৃতি হিসেবে জেলখানার অভ্যন্তরের যাদুঘরে খাঁচাটি সংরক্ষনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৪ সালে সাহিত্য সম্মেলেনের উদ্বোধক হিসাবে দাওয়ার দিতে গেলে তিনি বলেন, সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করার আসল মানুষ লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। সেখানে রাজনীতিবিদ কেন? প্রসঙ্গক্রমে কলকাতায় ছাত্ররাজনীতি করার সময়কালের স্মৃতিচারনা করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, মুসলিম ছাত্রলীগের এক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করার জন্য তাঁরা কাজী নজরুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবীরকে নিয়ে গিয়েছিলেন। নানা যুক্তিতর্কের পর প্রধান অতিথি হিসেবে যেতে তিনি রাজি হন বটে। তবে বলে দেন, এ ধরনের অনুষ্ঠানে মূল সভাপতিই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কবি জসীম উদদীনকে যেন সম্মেলনের মূল সভাপতি করা হয়। আর জয়নুল আবেদিন, কুদরত-ই-খুদা ও ড.মতিন চৌধুরীকেও যেন সম্মেলনে আনা হয়। পরে সে সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতায় কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সাহিত্য ও প্রকাশনার দুর্বিসহ অবস্থা নিয়ে জসীম উদদীন চাঁছাছোলা ভাষায় মুজিব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্বভাব থেকেই পেয়েছিলেন। আশৈশব থেকে তিনি কারোর উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা পছন্দ করতেন না। নিজ দেশও পরনির্ভশীল থাকবে এটা ছিল তাঁর কাছে অসহ্য। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু অনেক সময় বলতেন, “আমার যেন আমার স্ত্রীর আগে মৃত্যু হয়। কারণ, বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীর সহায়তায় আমি বেঁচে থাকতে চাই না”।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসের জন্মসূত্রে একটা পা একটু খাট ছিল। হাঁটতেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছোট ভাইকে একজন পূর্ণ ভাই মনে না করে অর্ধেক ভাই মনে করতেন। এই নিয়ে আড্ডার আসরে রসিকতা করে বলতেন, আমরা দেড় ভাই।
সফিয়ার রহমান
সহকারি অধ্যাপক,সম্মিলনী ডিগ্রি কলেক, মণিরামপুর, যশোর।
মোবাইল-০১৭১৬ ০৪৩৯৭৪