জাহিদ রহমান
শুধু রাজনীতির মাঠ নয়, খেলার মাঠেও এক আকর্ষণীয় চরিত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কৈশরে-তারুণ্যে তাঁর ছিল ভীষণরকম খেলাধূলোর নেশা। সময় সুযোগ পেলেই খেলতে ছুটতেন। ফুটবল, ভলিবল খেলাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। ফুটবল খেলতে এ গ্রামে ও গ্রামে ছুটে যেতেন। স্কুলে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। ভালো ফুটবলার হিসেবে একাধিক পুরস্কার পাওয়ার রেকর্ডও তাঁর রয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গন তথা ফুটবলের সাথে বঙ্গবন্ধুর সখ্যতা ছিল একটু বেশি। কেউ কেউ শুনে অবাকও হতে পারেন-বঙ্গবন্ধু সেসময় ঢাকায় প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলও খেলেছেন। ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট অনেকেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি ঐতিহ্যবাহী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে অনেকগুলো ম্যাচ খেলেন। আর এ কারণেই তাই আজীবন এই ক্লাবটির সাথে তাঁর ছিল একেবারে নাড়ির সম্পর্ক। ওয়ান্ডারার্স ক্লাব সূত্রেই জানা গেছে তিনি ক্লাবটির প্রধান পৃষ্টপোষকও ছিলেন। শৈশবে শেখ মুজিব যখন স্কুলে লেখাপড়া করতেন তখনই তিনি নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। আর গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিজ স্কুলের পক্ষে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। পরবর্তীতে চোখে সার্জারি করা হলে তিনি খেলাধূলোয় অনিয়মিত হয়ে পড়েন।
তবে ফুটবল এবং অপরাপর খেলাধূলোর প্রতি যে তাঁর প্রচন্ড অনুরাগ ছিল তা আরো ভালোভাবে বুঝা যায় বড় ছেলে শেখ কামালকে খেলাধূলোর সাথে সম্পৃক্ত করার ঘটনায়। আজকের জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামাল হলেও নেপথ্যের মূল অনুপ্রেরণাদাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে। আর এ জন্যেই দেখা গেছে শেখ কামাল তাঁর বন্ধু এবং অপরাপরদের সাথে নিয়ে যখনই দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে আধুনিক রুপ দিতে কিছু করতে চেয়েছেন তখনই তা সমর্থন দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর আহবানকে সামনে রেখেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে সে সময় একদল স্বাধীনতাকামী ফুটবলার গড়ে তুলেছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। যে ফুটবল দল মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা করতে ভারতের বিভিন্ন জায়গাতে একাধিক ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল। একাত্তরের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছেতেই ৭২ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল একটি প্রদর্শণী ফুটবল ম্যাচের। যেখানে মুজিবনগর একাদশ নামে মূলত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল অংশগ্রহণ করেছিল। এ দলে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু, শেখ আশরাফ আলী, কাজী সালাউদ্দিনসহ অন্যরা। অন্যদিকে যে সব খেলোয়াড়রা দেশে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট একাদশ। এ দলে মনোয়ার হোসেন নান্নু, গোলাম সারওয়ার টিপুসহ অন্য ফুটবলাররা ছিলেন।
প্রাক্তন ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী জানান, ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচ সরাসরি উপভোগ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিনসহ অন্যান্য নেতারা। এ ম্যাচে তাদের মুজিবনগর একাদশ হেরে যায় প্রেসিডেন্ট একাদশের কাছে। শেখ আশরাফ আরো জানান, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে বাংলাদেশ ফুটবল দল যতবার বাইরের মাঠে খেলতে গেছে ততবারই বঙ্গবন্ধুর সাথে পুরো দল দেখা করে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে তারা আর্শীবাদ নিয়েছে। শেখ আশরাফ বলেন, উনার সাথে দেখা করতে গেলেই উনি স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে আমাদের বলতেন, ‘ভালো করে খেলবি, স্বাধীন দেশের মান-সম্মান যেনো থাকে। আমি কিন্তু খেলাধূলোর সব খবর রাখছি।’ বঙ্গবন্ধুর ক্রীড়া সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দারুণ এক তথ্য দেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু কৈশরে, তারুণ্যে ফুটবল খেলতেন বলে ফুটবলারদের খুব ভালোবাসতেন। আর স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকার কারণে তিনি সবার কথা মনে রাখতে পারতেন। ৫৫ সালের দিকে রাজনৈতিক কাজে শেখ মুজিবুর রহমান একবার বরিশালের মঠবাড়িয়াতে যান। জাকারিয়া পিণ্টু তখন মঠবাড়িয়া স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। ফুটবল খেলা তার দারুণ নেশা। ঐসময় শেখ মুজিবুর রহমানের সৌজনে মঠবাড়িয়া হাইস্কুলের সাথে স্থানীয় অফিসার্স ক্লাবের মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। জাকারিয়া পিণ্টু জানান তিনি স্কুলের পক্ষে অংশ নিয়ে দু দুটি গোল করে অফিসার্স ক্লাবের পরাজয় ত্বরান্বিত করেন। খেলা শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁকে কাছে ডেকে খেলার প্রশংসা করে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন এবং জাকারিয়া পিণ্টুর বাবা নাজিমউদ্দিনকে ডেকে বলেন, ছেলেকে যেনো সে ফুটবল খেলতে আরো উৎসাহিত করে। জাকারিয়া পিন্টু বলেন, ৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দল দেশের বাইরে প্রথম মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত মারদেকা কাপ ফুটবলে অংশ নেওয়ার প্রাক্কালে পুরো ফুটবল দলের সদস্যরা গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যান। এ সময় এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। জাকারিয়া পিন্টু বঙ্গবন্ধুকে দেখে সালাম দিতেই তিনি চিন্তে পারেন এবং বলেন, ‘তোকে বলেছিলাম না তুই বড় ফুটবলার হবি’। জাকারিয়া পিন্টুর মতে, বঙ্গবন্ধু কৈশরে নিজে ফুটবল খেলতেন বলে ফুটবল খেলাটা খুব পছন্দ করতেন। আর তাই বাইরে খেলতে যাওয়ার আগে উনার সাথে দেখা করতে গেলেই উনি বলতেন, তোরা অবশ্যই ভালো করে খেলবি। মারদেকাতে যাওয়ার আগেও তিনি একই কথা বলেন।
প্রাক্তন ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী আরেকটি চমকে দেওয়ার মতো তথ্যের যোগান দেন। বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ এবং শেখ মুজিব এই দুটি নাম সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বাইরের অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশের নাম ঠিকমতো না জানলেও কেবলই নেতা শেখ মুজিবের নাম জানতো। আর এ কারণেই দেখেছি ৭৩ সালে প্রথম যেদিন আমরা কুয়ালালামপুর স্টেডিয়ামে খেলতে নামি সেদিন স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আর শেখ মুজিব বলে চিৎকার দিচ্ছে। সে ছিল এক অপূর্ব দৃশ্য। সদ্য স্বাধীন দেশ আর সেই দেশের নেতাকে সেদিন স্টেডিয়ামে আসা সাধারণ দর্শকরা যেভাবে অভিনন্দিত করেছিল তা কখনই ভোলার নয়। আসলে বঙ্গবন্ধু নামটি এমনই-‘যার অস্তিত্ব শুধু রাজনৈতিক ময়দান নয়, দেশের বাইরের ফুটবল ময়দানেও স্বচক্ষে দেখেছি। মানুষটি অসম্ভবরকম অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল’।