আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই: ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম
 
১৭ মার্চ ১৯৭২। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য দিন। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি সফরে এসেছিলেন। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসভায় বক্ততা করেন এই দুই নেতা। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ভারতের জনগণ ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। আর ইন্দিরা গান্ধি ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে বক্তৃতা শুরু করে বলেন, বাংলাদেশের ভাই ও বোনেরা ভারতের ৫৫ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা বাণী নিয়ে আমি সোনার বাংলায় এসেছি। বাংলাদেশের জনগণ যে সাহস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে দুঃখ-দুর্দশা মোকাবিলা করেছে তার জন্য আমার দেশবাসীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য আমি এসেছি।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বিষয়ে

বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, আমি জানি স্বাধীনতা পাওয়া যেমন সত্য, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনিই কঠিন। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে দালাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, তারা অস্ত্রপাচার করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, প্রয়োজনে স্বাধীনতার জন্য আরও এক কোটি মানুষ প্রাণ দেবে।

ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব

আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত আছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে তারা ষড়যন্ত্রকারী। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল ও রাজাকার আল-বদর। তাদের আমরা ক্ষমা করতে পারি না। স্বাধীনতা ও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য জনতা প্রাণ দিতে রাজি আছে কিনা বঙ্গবন্ধু তা জিজ্ঞেস করলে জনসমুদ্র সম্মতি জানায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার জন্য আমি আপনাদের ডাক দিয়েছিলাম। আপনারা লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে আমি আবার আপনাদেরকে ডাক দেবো, আপনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবো।
দেওয়ার মতো কিছুই নেই

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে সংবর্ধনা জানানোর সুযোগ বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক বিরাট ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের নানা কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাঝে এসেছেন এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাকে দেবার (দেওয়ার) মতো আমার কিছুই নেই। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তবে আমাদের পাশে আপনার মতো একজন মহান বন্ধু পেয়ে আমাদের মনের বল আরও শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনাকে আমি বাংলাদেশের অন্য কোনও স্থানে নিয়ে যেতে পারলাম না। বর্বর পাক বাহিনী বাংলাদেশের বুকে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম তাহলে আপনি আপনার অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না। শ্রীমতি গান্ধী আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, বাংলাদেশে দুই লক্ষ নারী পাকবাহিনীর হাতে নিগৃহীত হয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা জানি স্বাধীনতা অর্জন খুবই কঠিন কাজ। স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও বেশি কঠিন। আমাদের স্বাধীনতা বানচাল করার ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। এ সম্পর্কে আমাদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ভারতের সরকার ও জনসাধারণ সর্বদাই আমাদের পাশে থাকবেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভারতবাসী ও ভারত সরকার সমবেদনা ভালোবাসা ও সদিচ্ছার ভিত্তিতেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধন আবদ্ধ হয়েছে। আমরা রক্ত দিয়ে যে ইতিহাস রচনা করেছি তা চিরস্থায়ী হবে।

ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জনতার উদ্দেশে প্রথমে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিতে শুরু করেন। কিন্তু বাংলায় কয়েকটি কথা বলার পরে তিনি বাংলা ভাষায় ভাষণ দিতে তাঁর অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চেয়ে হিন্দি ভাষায় ভাষণ শুরু করেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য তিনি ভারতের ৫৫ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা বাণী নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ পরস্পরের মহান বন্ধু।

ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আমাদের প্রতিটি ভারতবাসী কেঁদেছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের বিগত দিনগুলোতে যে অকথ্য নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা তাদের বাড়িতে ফিরে এসেছেন। এতে তারা সুখী হয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া বাংলাদেশকে এদেশের মানুষ সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার মৈত্রীভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের বন্ধুত্ব। এ কারণে নয় যে আমরা আপনাদের সাহায্য করেছি। এগুলো মহান বন্ধুদের সাহায্য করার নীতি। আপনাদের জন্য রয়েছে আমাদের আন্তরিক ভালোবাসা আর দরদ। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তার বিদেশ সফর উল্লেখ করে যেসব সরকারের নিকট তিনি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তা বর্ণনা করেন। এদের মধ্যে কোনও কোনও সরকার বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করতেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ন্যায়বিচার ও শান্তির নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
  
বাংলাদেশ টিকে থাকবে

ইন্দিরা গান্ধী তার ব্কৃতায় বলেন, বাংলাদেশ যে বাস্তব সত্য তা প্রত্যক্ষ করে তিনি আজ সত্যিই সুখী। ভারতের ন্যায় বাংলাদেশও চিরকাল সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে। সাম্রাজ্যবাদী দুরভিসন্ধির বিষয় উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের দেশসমূহের ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা করছে সেসব দেশ তাদের নিজেদের জনগণের কল্যাণ সাধনে মনোনিবেশ করাই উত্তম। তিনি বলেন, আত্মনির্ভরশীলতার হল সর্বোত্তম। কোনও সমস্যা সমাধানের জন্য বাইরের সাহায্যের ওপর নির্ভর করা যায় না। তবে এটা সত্য, বাইরে থেকে কিছু সাহায্য আবার কখনও কখনও নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য জনগণকে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে।

যখন এলেন ময়দানে

তুমুল করতালি আর গগনবিদারী স্লোগান এর মধ্য দিয়ে শ্রীমতি গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুপুরে বিশাল জনসমুদ্রে সামনে পৌঁছান। তখন দুপুর ৩টা ৩০ মিনিট। বঙ্গভবন থেকে রেসকোর্সের পথের দু'ধারে উদ্দীপক জনতা নারী-পুরুষ-শিশু স্লোগান নিয়ে মুখর করে তুলেছিল। পথের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুই মহান নেতা। ইন্দিরা গান্ধী বিকেল চারটায় ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন এবং ৪টা ৩৩ মিনিটে  শেষ করেন। সভায় তিনটি সংগীত পরিবেশন করা হয়। বেগম মুজিব প্রথম সরকারি অনুষ্ঠানে ঘরের বাইরে আসেন এইদিনে। এই জনসভায় উদ্বোধন হয় ‘ইন্দিরা মঞ্চ’।

মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক

দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে তিন দফা আলোচনা হয়। বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তিন দফা আলোচনায় মিলিত হন। এর মধ্যে প্রথম দফা আলোচনায় কোনও সাহায্যকারী ছিলনা। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে দুইজন মুখপাত্র আলোচনাকে দুই দেশের মধ্যে প্রাথমিক মতবিনিময় বলে অভিহিত করেন। তারা জানান, শ্রীমতি গান্ধীর সফল আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে যুক্তিযুক্ত ঘটনা প্রকাশ করা হবে। পরবর্তীতে দুই প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন।

SUMMARY

2321-1.jpg