স্মৃতি সুধায় কাঞ্ছিরাম মালির বঙ্গবন্ধু


আবু বাসার আখন্দ :
চায়ের কাপেই কেটে গেলো কাঞ্ছিরাম মালির পঁয়ষট্টি বছর। আর এই দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অনোন্য প্রাপ্তি বঙ্গবন্ধুকে নিজের হাতে চা পরিবেশনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
মাগুরা শহরের টাউন হল ক্লাব, বড় বাজার আর মধুমতি সিনেমা হল ঘিরে গড়ে ওঠা কাঞ্ছিরামের চায়ের দোকানটি এখনো টিকে আছে শহরের বক্সি মার্কেটের পাশে। যার শুরু শহরের প্রথম চায়ের দোকান থেকেই।
কাঞ্ছিরাম মাগুরা শহরের পারলা গ্রামের ফটিক মালির ছেলে। স্বাধীনতা উত্তর কালে শহরের হরিষদত্ত সড়কের মাথায় নদীর ঘাটে ছিল মাড়োয়ারিদের গোডাউন। সেখানে কাজ করতেন বাবা ফটিক মালি। আর কাজের ফুসরতে তৃষ্ণা মেটাতে যাওয়া নিমাই সেনের চায়ের দোকানে।
মাগুরা শহরের মধুমতি সিনেমা হলের উলটো দিকে কাদের বিল্ডিংয়ের পাশেই নিমাই সেনের চায়ের দোকান। আঠারখাদা গ্রামের নিমাই সেনের এই দোকানটিই সম্ভবত এই শহরের প্রথম চায়ের দোকান। তো সেই দোকানে ফটিক মালি তার বারো বছরের ছেলে কাঞ্ছিরামকে রেখে দেন কাজের জন্যে।
৬৫’ সালের দিকের কথা। ছোটখাটো মানুষ কাঞ্ছিরাম। সারাদিন পরিশ্রম করেন। তার কর্তব্যনিষ্ঠায় খুশি মালিক নিমাই সেনও। দিন শেষে তাই বাড়ি ফেরার পথে কাঞ্ছিরামের হাতে একটি টাকা তুলে দিতে কার্পন্য করতেন না নিমাই সেন। 
এইভাবেই চলে গেছে কয়েকটা বছর। কিন্তু দেশ স্বাধীনের আগে একদিন নিমাই সেন তার পরিবার নিয়ে চলে যান ইন্ডিয়াতে। সে সময় তিনি তার প্রিয় দোকানটি একেবারে বিনে পয়সাতে দিয়ে যান কাঞ্ছিরামকে। মাগুরা শহরে গড়ে ওঠা সেই প্রথম চায়ের দোকানটি প্রায় পঁয়ষট্টিটি বছর ধরে আগলে রেখেছেন কাঞ্ছিরাম। কিন্তু দীর্ঘকালের পরিবর্তনে সরে গেছে কেবল কয়েক পা দূরে টাউন হল ক্লাবের পূর্বপাশে।
পঁচাত্তর বয়সি কাঞ্ছিরাম সেই বারো বছর বয়সে চায়ের কাপের সঙ্গে যে মিতালি জুড়েছিলেন সেটি রয়ে গেছে আজও। কিন্তু নেই তাঁরা; একসময় চায়ের কাপে যাঁরা ভিড় করেছেন, আড্ডা জমিয়েছেন হরহামেশা তার টেবিলে।
মাগুরা শহরের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের ভিতর এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যারা কাঞ্ছিরামের চায়ের পেয়ালার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেননি। যা নিয়ে রয়েছে তার গর্ব। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার হাত থেকে চা খাইয়েছেন-এমন গৌরবে, আজীবন ভালো লাগায় কাটিয়ে দিতে পারেন কাঞ্ছিরাম মালি।
বামন নয়; তবুও একটু খর্বাকৃতি এবং সুঠামদেহের মানুষ এই কাঞ্ছিরাম মালি। অত্যন্ত প্রাণখোলা মানুষ কাঞ্ছিরাম জানান, মধুমতি সিনেমা হলে ছিল আওয়ামীলীগের মিটিং। সেই মিটিংয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। তখন একটা চিনা মাটির কাপে বঙ্গবন্ধুর জন্যে চা দিয়েছিলাম। কত মানুষকে চা খাইয়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ানোর মধ্যে যে তৃপ্তি সেটি মনে পড়লেই ভালো লাগে। সেই মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী বয়স্কদের মধ্যে এখনো কেউ কেউ বেঁচে আছেন। তারাও আসে আমার দোকানে। তবে তারা যখন পুরণো সেই স্মৃতি উস্কে দেয় তখন মন ভালো হয়ে যায় বলে জানান কাঞ্ছিরাম মালি।
নতুন প্রজন্মের কবি সাগর জামান। এই শহরের অনেক আড্ডাতে যিনি শামিল থাকেন। তিনি বলেন, কাঞ্ছি কাকা নিজ হাতে বঙ্গবন্ধুকে চা খাওয়াতে পেরেছেন এটি অবশ্যই তার গর্বের যায়গা। আমাদের জন্যেও অনেক বড় পাওয়া যে বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশাতে তিনবার মাগুরাতে এসেছেন। ধন্য করেছেন এই মাটিকে।
মাগুরার ভাষা সৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়ার ছেলে কবি সাগর জামান। তিনি বলেন, বাবা এবং রাজনৈতিক বয়োজ্যেষ্ঠ দের কাছ থেকে জানা, বঙ্গবন্ধু প্রথম মাগুরাতে আসেন ৬২’ সনে সাংগঠনিক সফরে। এরপর ৬৬’তে ৬ দফা আন্দোলনের প্রচার কাজে। সর্বশেষ তিনি এসেছিলেন ৭০’ এর নির্বাচনে। সে সময় বৃহত্তর যশোরের মহকুমা মাগুরা এবং নড়াইল নিয়ে ছিল একটি নির্বাচনী আসন। এ আসনে আওয়ামীলীগের প্রার্থি সোহরাব হোসেনের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। 
মাগুরা জেলা আওয়ামীলীগের বর্তমান সহ-সভাপতি মুন্সি রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, মাগুরার রাজনৈতিক কর্মীসভা কিংবা মিটিং তার অধিকাংশই হতো শহরের মধুমতি হলে। যে কারণে বঙ্গবন্ধু মাগুরাতে আসলে প্রথমে কলেজের সামনে সোহরাব ভাইয়ের সেরেস্তাতেই বসতেন। তারপর মধুমতি হলের মিটিংয়ে।
তবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু আমাদের একমাত্র গর্বের জায়গা। আমাদের আবেগের সবকিছুই তাকে ঘিরে। সেই বঙ্গবন্ধু আর সারা বাংলার মানুষের ভালোবাসা একাকার হতে পেরেছে বলেই তার জন্মশত বার্ষিকীতে সারা দেশের মানুষ নতুনভাবে সেজে উঠতে পারে। সেই ভালোলাগা থেকে কাঞ্ছিরাম পিছিয়ে থাকবে কীভাবে-এমন উক্তি বর্ষিয়ান এই রাজনৈতিক নেতার।
বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ এক সূত্রে গাঁথা। আজকের প্রবীন রাজনৈতিক নেতা মুন্সি রেজাউল ইসলাম, সাগর জামানের মতো বঙ্গবন্ধুপ্রেমি আর কাঞ্ছিরামের মতো সাদা মনের সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ভালোবাসায় গ্রন্থিত মালা হয়ে বঙ্গবন্ধু আরো হাজার বছর বেঁচে থাকবেন সতত স্মৃতি সুধায় ভালো লাগায় প্রিয় মানুষ হিসেবে।

সাংবাদিক: যুগান্তর, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন।

SUMMARY

2320-1.jpg