এম এ ওয়াদুদ

এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন

ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদের জন্ম চাঁদপুর জেলার রাঢ়ির চর গ্রামে। ‘পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী সৈনিক। এম এ ওয়াদুদ ১৯৫৩-৫৪ সালে প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

দুইবার নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও একবার প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সহসম্পাদকের দায়িত্বও তিনি নিষ্ঠা ও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৯৪৮ সালে একবার এবং ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন।

১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার পর ছাত্র আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্য পুনরায় এম এ ওয়াদুদকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তৎকালীন শাসকদের রুদ্ররোষের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করতে তিনি বাধ্য হন।

১৯৪৯ সালে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুসহ ওয়াদুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৭৮ সালে সামরিক সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য তিনবার বিভিন্ন মেয়াদে এম এ ওয়াদুদ কারাবরণ করেন। সামরিক শাসনের সময়ে তার বিরুদ্ধে বারবার মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে আন্দোলন আবারো চাঙ্গা হয়ে যায়। ওই ঘোষণার প্রতিবাদে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তীব্র সমালোচনা করে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও রিপোর্ট প্রকাশ করে।

২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ জানুয়ারি ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট এবং ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করে।

এ সময় ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখালেখিসহ ভাষা আন্দোলনের নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন ওয়াদুদ। বিভিন্ন হল ও সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মনোনীত হন এম এ ওয়াদুদ।

তখনকার সময়ে ভাষা আন্দোলনের একজন নিবেদিত প্রাণ এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবেই তাকে সংগ্রাম পরিষদের সদস্য করা হয়। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট এবং ২১ ফেব্রুয়ারি হরতালকে সমর্থন করে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের ব্যাপকতার মুখে সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙার পর দৃঢ় অবস্থান নেয়। অবশেষে ২১ ফেব্রুয়ারি আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ চত্বরে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশি নির্যাতন। তিনটা বা সাড়ে তিনটার মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ করে গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই কয়েকজন শহীদ হন, আহত হন অগণিত ছাত্র-জনতা। একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পর একুশের ছাত্রহত্যা পর্যন্ত সব আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে ওয়াদুদ ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মী। একুশের হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের চরম দমননীতি ও নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের ওপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডের আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে, ১৫০ মোগলটুলিস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মশিবির অফিসে যুবলীগের অফিসে এবং এম এ ওয়াদুদের বাসায় পুলিশ হানা দিয়ে তছনছ করে দেয়। এ সময়ের ছাত্র যুবনেতা ওয়াদুদ ১০৪ ডিগ্রি জ্বরে আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তার ৫৫ নম্বর কলুটোলার বাসা থেকে সে রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

একুশের আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়েও এম এ ওয়াদুদ সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন ও একুশের চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবস উদযাপনে ছিলেন বেশ সক্রিয়। প্রথম শহীদ দিবসে অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সর্বস্তরের জনতা বিশেষ করে মহিলারা নগ্নপদে ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত দীর্ঘ শোভাযাত্রা সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করেন।

শোভাযাত্রা শেষে আরমানিটোলা ময়দানে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় যেসব নেতা বক্তব্য রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, মাহমুদ আলী, হালিমা খাতুনসহ অনেকে। এম এ ওয়াদুদও এই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ভাষা আন্দোলন ও জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।

SUMMARY

232-1.jpg