মুজিব শতবর্ষ, অনেক কিছু হতে পারে..

- আদিত্য শাহীন  

সবাই চেতনার শাণিত সজ্ঞান দিয়ে আবিষ্কার করছেন না। বেশিরভাগই আবেগের সীমানা ছুঁইছেন। দেখার ভঙ্গিমাটি দেখাতে চাইছেন অন্যকে। অন্যরা জানুক তিনি বঙ্গবন্ধুকে গভীরভাবেই দেখছেন।

আমি বিশ্বাস করি, এই আবেগেরও অনেক দাম। ভুল বানানে ভুল বয়ানে প্রচ্ছদ সর্বস্ব অজস্র বই বেরুচ্ছে। প্রচলিত সুরগুলোর ভাঙা ভাঙা অংশের ফিউশন নিয়ে অসংখ্য গান বানানো হয়েছে। কেউ কেউ স্বার্থে করছেন। অসংখ্য আছেন, তাদের কোনো স্বার্থ নেই। চাইছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকতে। বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখতে।

বঙ্গবন্ধু কারো একার নয়। কোনো ব্যক্তি বা গোত্র বিশেষের নয়। তিনি এক আদর্শ। রাজনৈতিক, সামাজিক, দার্শনিক এক স্তম্ভ। বাঙালির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আছেন, এই সত্যটিই জেগে উঠছে আজ। তবে বলা যাবে না তিনি পুরোপুরি আবিষ্কৃত হয়ে গেছেন। তিনি আবিষ্কৃত হচ্ছেন। খণ্ড খণ্ডভাবে বর্ণিত হচ্ছেন একেক রকমের বিবেচনায়। জোয়ারবিহীন শান্ত অধ্যায়নে, পর্যবেক্ষণে, বীক্ষণে, বিশ্লেষণে তার সঠিক উচ্চতা বিশ্ববাসী একদিন জানবেন- এ বিশ্বাস করার সময় আজ।

আমার প্রত্যাশা একটি সঠিক তালিকা হোক। বঙ্গবন্ধু নিয়ে যত কাজ তার একটি হিসেব থাক কোথাও। থাকুক অনলাইনেও। একটি গঠনমূলক সফটওয়্যার তৈরি হোক। যেখানে শব্দ লিখে অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে বঙ্গবন্ধুর সে বিষয়ক তথ্য ও হাজারো রেফারেন্স। রবীন্দ্র রচনাবলী নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফরম আছে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানতে বুঝতে পড়তে অনেক সুবিধা। বঙ্গবন্ধুর নিজের সকল লেখা ও তার সম্পর্কিত সকল গবেষণা ও লেখার নির্বাচিত অংশ সেখানে খুব গুছিয়ে সন্নিবেশিত করতে হবে। আমাদের ডিজিটাল উন্নয়নকর্মীদের বিষয়টি নিয়ে কাজে নেমে পড়া উচিৎ।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে অজস্র উদ্যোগ রয়েছে। সব কর্মসূচির কথা মানুষ জানেনও না। এটি মানুষের কাছে দরকারি তথ্য হিসেবে থাকা উচিৎ। মানুষ জানার দাবিও রাখেন। একটি ওয়েব সাইট করা হয়েছে। কিন্তু সখানে তথ্য বা কন্টেন্ট আছে খুবই সামান্য। সেটির পেছনে যে সবসময় কিছু মানুষ কাজ করছে এমন বলা যাবে না। কিছু দুর্লভ প্রামাণ্যচিত্র আছে। অল্প কিছু বিবরণ আছে। ওয়েব পোর্টালটি আরো সক্রিয় ও বহুমুখি করা প্রয়োজন। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত করা প্রয়োজন। আমার মনে হয় – পৃথিবীর প্রতিটি দেশের জন্য পৃথক চ্যাপটার থাকা উচিত, ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধু সম্পর্ক ও স্মৃতি। প্রয়োজনীয় ছবি পৃথক পৃথকভাবে যুক্ত করা উচিত। কাজগুলোর সঙ্গে ওই দেশগুলোকেও যুক্ত করা প্রয়োজন। যাতে তারা প্রশাসনিকভাবেই জানতে পারে ও যুক্ত থাকতে পারে বিষয়টির সঙ্গে।

পৃথিবীতে অসাধারণ লেখনীর যোগ্যতা সব মহান রাজনৈতিক নেতার নেই বা ছিল না। হয়তো অনেকেই লেখক, সাধক বা দার্শনিকের চেয়ে অনেক বেশি সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখেছেন, অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু লেখকসত্তা সবার ভেতরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি। বঙ্গবন্ধুর হাতে ধরা দিয়েছিল লেখকের প্রজ্ঞা, মননশীলতা, শব্দ ও বাক্যের যাদু। সত্যকে সত্যের মতো করে তুলে ধরার শক্তি তিনি রাখতেন। তিনি একেক কঠিন সময়ে যা লিখে গেছেন, যতটুকু লিখে গেছেন তা বাঙালির ইতিহাস রচনায় সবচেয়ে মূল্যবান আকর হিসেবে ধরা দিয়েছে। আজ স্বাধীনতা বিষয়ে যত সূত্র, গ্রন্থ, উদ্ধৃতি আমরা খুঁজি না কেন, শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ ছাড়া বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের পেছনের সত্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুর জীবন আজ শিক্ষিত সচেতন সাধারণ মানুষের কাছে নতুন করে ধরা দিয়েছে। যারা তাদের বয়সে দূর থেকে একবার বঙ্গবন্ধুকে দেখে নিজের চোখকে ধন্য করার সুযোগ পেয়েছেন তারা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে গভীরভাবে পেয়েছেন। একইভাবে কারাগারের রোজনামচাও জানিয়েছে ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য। এই দুই গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠা খুলে দিতে পারে সত্যসন্ধানী বাঙালির চোখ। দিতে পারে রাজনীতি ও সমাজনীতির গভীর দিক নির্দেশনা। এই গ্রন্থগুলির উপযুক্ত অনুবাদসহ অনলাইন সংস্ককরণ বের হওয়া প্রয়োজন। যে সংস্ককরণটি হবে অত্যাধুনিক। পাঠক ও গবেষকদের কথা চিন্তা করে এটি নির্মাণ করতে হবে। শব্দ ও বর্ণ দিয়ে অনুসন্ধানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একেকটি অধ্যায়কে পৃথক করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। গ্রন্থগুলি সম্পর্কে সুগভীর মন্তব্যগুলোও যাতে সহজে পাঠ করা যায় তারও লিংক থাকতে হবে। এই কাজগুলি এখন কঠিন কিছু নয়। যারা কাজগুলো করছেন তারা আরেকটু ব্যাপকভাবে ভেবে করলেই হয়। কর্মসূচিগুলো সুদুরপ্রসারি চিন্তা, সৃজনশীলতা ও জাতির জনককে যথাযথমূল্যায়নের মানসিকতা নিয়ে করা উচিৎ।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। যথোপযুক্ত উদ্যোগ নিলে এটি এরই মধ্যে শতাধিক ভাষায় অনুদিত হতে পারতো। পৃথিবীর দেশে দেশে শক্তি মর্যাদা ও গর্ব নিয়ে বাঙালি ছড়িয়ে আছে। শিক্ষিত সচেতন মানুষও আছেন। শতাধিক দেশে আমাদের কূটনৈতিক মিশন আছে। তাদের মাধ্যমেও আমাদের জাতির জনকের আত্মজীবনীধর্মী বিবরণ, বাংলাদেশের মুুক্তিসংগ্রাম বিষয়ক গ্রন্থগুলো অনুদিত হতে পারে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে এই উদ্যোগগুলো নেয়া যেত।

জাতির জনকের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ। আঠারো মিনিটের ওই ভাষণ একটি জাতির দিক নির্দেশনা। ইউনেস্কো স্বীকৃত প্রামাণ্য বিশ্বঐতিহ্য। আমার জানা মতে পৃথিবীর বহু ভাষায় এই ভাষণ অনুদিত হয়েছে। এই ভাষণ নিয়ে বহুমাত্রিক কাজ হওয়া প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন প্রকাশনায় বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রমে এই ভাষণ ও এ সংক্রান্ত গবেষণার চিত্র, ভাষণটি সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের মন্তব্য ইত্যাদি এবার খুব ভালোভাবে উঠে আসা দরকার। বিষয়গুলো তেমন দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবীর মানুষের কাছে তা সহজে পৌঁছে দিতে পারছি না আমরা। আমরা যদি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে পৃথবীর প্রতিটি স্বাধীন ও বন্ধুপ্রতীম দেশের সঙ্গে অনলাইন পৃথক পৃথক পোর্টাল তৈরি করে একটি ভার্চুয়াল সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারতাম তাহলে একটি ভালো কাজ হত। আজ পৃথিবীর বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালি অধ্যাপক, শিক্ষার্থী রয়েছেন। যারা কৃতিত্বের মধ্য দিয়েই এক প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে যতসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে সর্বজনীন আবেদন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আলোয় তাকে আলোকিত করার অপরিহার্যতা রয়েছে। সমাবেশ, সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক আয়োজন, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি যেমন থাকতে হবে, এর স্থায়ীত্ব নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। যাতে এই এক বছরে বিশ্বের স্বাধীন, গণতন্ত্রকামী, রাজনীতিমনোষ্ক মানুষ অনন্য এক দৃষ্টান্ত হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে যান। সব জাতিগোষ্ঠীর জন্য এক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপত্র হয়ে উঠতে পারে তার সংগ্রামী জীবন।

জন্মদিনে মহান নেতার প্রতি অভিবাদন।

SUMMARY

2315-1.jpg