বঙ্গবন্ধু মানে একটি নতুন দেশের জন্ম


অরিত্র দাস
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন- আমি যদি কখনও পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযোগ পাই; তবে এ প্রদেশের নামকরণ করব বাংলাদেশ।


এ দেশের বুক থেকে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই জনগণের পক্ষ হতে আমি ঘোষণা করতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।

সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা উল্লসিত কণ্ঠে রণধ্বনি তুলে বলে উঠল- বাংলাদেশ; বাঙালির বাংলাদেশ। এ নিয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার পরবর্তী সময়ে গান লিখেছেন- শোন একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে বাতাসে ওঠে রণী/ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। ’৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-র সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ছয় দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ- প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গণতন্ত্রের অতন্দ্রসৈনিক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাস।

বাঙালি বঞ্চনা-শাসন ও দাসত্বের শেকলে নিজেকে বন্দি করে রেখেছে হাজার হাজার বছর; মননশীলতার গভীরতম প্রদেশে ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা, আতঙ্ক যেন একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল।

অপরদিকে মুক্তচিন্তা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ক্রমশ বিলীয়মান হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর এককথায় সব ভয় ও সংকীর্ণতা তাড়িয়ে বাঙালি আবদ্ধ শেকল থেকে মুক্ত হয়ে লিখেছে মুক্তির কবিতা, মুক্তির ছড়া, মুক্তির গান- মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি; কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট, রক্ত-জমাট, শিকল পূজার পাষাণ-বেদী ইত্যাদি।

এতে উদ্বেলিত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। টগবগ করে ফুটে উঠেছিল বহু বছরের জমে থাকা অব্যক্ত ক্ষোভ। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নারী, পুরুষ, ছাত্র, যুবক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, ডাক্তার এবং সর্বস্তরের মানুষকে দিয়েছেন গৌরবান্বিত ইতিহাস রচনার নতুন অধ্যায়ে।

বাঙালিকে স্বাধীনতার পথে হেঁটে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন সেতু- ছয় দফা। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে উন্নীত হওয়ার জন্য। ফরাসি বিপ্লবের ভিত্তি যেমন সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব; ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাস যেমন ম্যাগনাকার্টা আর বাঙালি জাতির ভিত্তি হচ্ছে ছয় দফা। অথচ তৎকালীন তথাকথিত একশ্রেণির রাজনীতিক বললেন, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী পাকিস্তান সরকার দমনপীড়ন শুরু করল এই বলে যে, এতে নিহিত রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সর্বনাশ; পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু দমে যাননি। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতায় পিছু হটেননি। ছয় দফা উত্থাপনের পর সারা দেশ সফর করে মাত্র ৩৫ দিনে মোট ৩৩টি জনসভায় তিনি অত্যন্ত সন্তর্পণে আপামরসাধারণকে একটি সুতোয় গাঁথতে বক্তৃতা করেছেন। এজন্য পদে পদে গ্রেফতার হতে হয়েছে তাকে। তথাপি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে স্বাধীনতার বীজ তথা স্বপ্ন বপন করে গেছেন বাংলার মানুষের মুক্তির দিশারি এ মানুষটি।

অবশেষে উঠল নতুন সূর্য, এলো বহু প্রতীক্ষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাঙালি সমাজব্যবস্থায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ বসু, একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখের অবদান অবিস্মরণীয় বটে।

কিন্তু তারা কেউ বাঙালির পাতে স্বাধীনতা তুলে দিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ, স্বাধীনতার স্বাদ, মাথা উঁচু করে চলার সাহস। বঙ্গবন্ধু মানে একটি নতুন দেশের জন্ম, নতুন করে পথচলা। একটি রাষ্ট্রের জন্ম তথা তার সৃষ্টির পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পটভূমি আছে, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ আছে, প্রবহমান ঘটনা আছে, ঘটনার পৃষ্ঠায় আছে মিছিল মিটিং, সংগ্রাম-আন্দোলন, এক সাগর তাজা রক্ত; আর তাতে স্পষ্টভাবে মুদ্রিত রয়েছে সেই ধ্রুব সত্যটি- বাংলাদেশ নামক এ মহাকাব্যের রচিয়তা রাজনৈতিক কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

SUMMARY

2310-1.jpg