এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন
ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী (বর্তমান ফেনী) জেলার ছাগলনাইয়ার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাগলনাইয়া হাইস্কুলে অধ্যয়নকালে জীবনে প্রথম রাজনৈতিক মিছিলে অংশগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে এবং ওই মিছিল থেকেই তিনি ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের জন্য জীবনে প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে চার ঘণ্টা হাজতবাস করেছিলেন।
পরবর্তীকালে গাজীউল হকের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তার পিতা নোয়াখালী ছেড়ে বগুড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি বগুড়ায় নেতৃত্ব দেন। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও গাজীউল হক এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি বহুবার গ্রেপ্তার বরণ করেন এবং বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হন।
১৯৭১ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে বগুড়ার সর্বদলীয় হাইকমান্ড নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে তার কবিতার বই ‘জেলের কবিতা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেছিল। গাজীউল হক রচিত এগিয়ে চলো, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ইধহমষধফবংয টহপযধহমবফ, উচ্চতর আদালতে বাংলা প্রচলন, যে লেখার শেষ নেই, আমার দেখা আমার লেখা পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে আ ন ম গাজীউল হকের নামটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে আছে। ১৯৪৫ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত ধর্মঘটে তিনি বগুড়ায় নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ অধ্যায়ে গাজীউল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাক-প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মধ্যে গাজীউল হকের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই বক্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে যে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়, গাজীউল হক তাতে সভাপতিত্ব করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি করা হলে ওই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ছাত্ররা দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। গাজীউল হক সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এ লক্ষ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হল কেন্দ্রিক ছাত্রদের কয়েকটি সাংগঠনিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এসব বৈঠকে গাজীউল হক ছাত্রদের সংগঠিত করেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সমর্থন আদায় করেন। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে দীর্ঘ আলোচনা ও উত্তপ্ত বিতর্কের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারেনি। উল্লেখ্য, ৯৪ নওয়াবপুর রোডে অবস্থিত তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালেই ফজলুল হক হল ছাত্রসভা, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্রসভা ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এসব সভায় গাজীউল হক নেতৃত্ব প্রদান করেন। সর্বশেষ ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১১ জন ছাত্রনেতার এক গোপন বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সর্বসম্মতি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) ও ফজলুল হক হলের মধ্যবর্তী পুকুর পাড়ে অনুষ্ঠিত এই গোপন বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, পরের দিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক।
১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোতে গাজীউল হক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঐতিহাসিক আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক এবং সভাশেষে তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সভায় সমবেত ছাত্রছাত্রীরা ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনায় অস্থির হয়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন রকম স্লোগান দিতে থাকেন।
পরবর্তীকালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১০ জনের এক একটি গ্রুপ মিছিল সহকারে রাস্তায় নেমে আসে। তখনই শুরু হয় গ্রেপ্তার, পুলিশি নির্যাতন এবং পরে ছাত্র হত্যা।
এভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মধ্য দিয়েই একুশের রক্তাক্ত ঘটনার জন্ম হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি হলো বাঙালি জাতির গৌরবদীপ্ত আত্মত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত। এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রাণপুরুষ গাজীউল হক। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের যুগান্তকারী ঘোষণার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।
এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।