ড. সুলতানা আক্তার
ভারত উপমহাদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন মহাত্মা গান্ধী। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সঙ্গত ও ন্যায্য বিবেচনা লাভ করার সব আশা যখন তিরোহিত, তখন মহাত্মা গান্ধী শাসন কর্তৃপক্ষের প্রতি ভারতীয়দের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রত্যাহার করে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলার যে সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন, সেটাই হচ্ছে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন।
১. ১৯২০ সালের ১ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সহিংসতার রূপ নিলে মহাত্মা গান্ধী এ আন্দোলন পরিহার করেন। সেসব বিস্তারিত আলোচনার এখানে প্রয়োজন নেই; কিন্তু গান্ধীজির জীবনে যা বহুলাংশে সম্ভব হয়নি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং তাজউদ্দীন আহমদের সাংগঠনিক দক্ষতায় তা সম্ভব হয়েছিল।
তাদের দ্বারা একটি সফল অসহযোগ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অকস্মাৎ দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে পাকিস্তান বেতারে পঠিত এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকবে। ২. বেতারে প্রেসিডেন্টের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ছাত্রসহ সব শ্রেণির মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং তারা রাস্তায় নেমে আসে।
ঢাকা সঙ্গে সঙ্গে একটি বিক্ষুব্ধ মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ বিকালে হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি ২ মার্চ ঢাকা শহরে হরতাল এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা সমাবেশের কথা ঘোষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে ১ মার্চ থেকেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে Defecto প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তার যাবতীয় বিষয় পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের অধীনে রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও আমলাদের কয়েকটি বলয় গড়ে ওঠে। এতে শীর্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী স্তরে ছিল তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও অন্যদের সমন্বয়ে একটি হাইকমান্ড। বুদ্ধিজীবীদের বলয়ে ছিলেন রেহমান সোবহান, ড. কামাল হোসেন, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
দলীয় নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর সংবাদ সম্মেলনে বিবৃতিদান পর্যন্ত সব বিষয়েই তাজউদ্দীন আহমদ সম্পৃক্ত ছিলেন। জেগে ওঠা একটি বিক্ষুব্ধ জাতিকে সফল নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে অসহযোগের দিনগুলোয় মুজিব-তাজউদ্দীনের মধ্যকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতম অবস্থায় উপনীত হয়। ৩. এ সময়ে তাদের কর্মব্যস্ততা সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি লিখেছেন :
‘৭ মার্চের আগের তিন দিন কোনো কোনো দিন দুই বেলাতেই আব্বু আর মুজিব কাকুকে দেখতাম ঝড়ের গতিতে বাসায় ঢুকছেন, বসার ঘরে দুজন নিভৃতে আলোচনা করছেন। কখনও দেখতাম দুজনেই ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর কথা বলছেন।
৪. অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৌশল ও নীতিনির্ধারণের জন্য মুজিব ও তাজউদ্দীন একান্তে পরামর্শ করতেন। এ সময় বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি তৈরির ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।’ সাংবাদিক আতিকুর রহমানের পর্যবেক্ষণেও এ দুই নেতার পরিপূরক সম্পর্ক আর কর্মব্যস্ততার চিত্র ফুটে ওঠে :
‘তাজউদ্দীন আহমদ বোধহয় বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। তাকে নিয়ে সেসময়ের একটি স্মৃতি না বললেই নয়। ৫ বা ৬ মার্চে সঠিক দিন মনে করতে পারছি না; ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বিকালে পৌঁছেই শুনি একটি বিবৃতি দেবেন বঙ্গবন্ধু। দেখলাম তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানের চিফ রিপোর্টার আতাউস সামাদ অপেক্ষা করছেন সেজন্য।
টাইপিস্ট আসেনি বলে দেরি হচ্ছে। সন্ধ্যার পর আতাউস সামাদ প্রস্তাব করলেন তিনি নিজেই টাইপ করে দেবেন। তাজউদ্দীন আহমদ রাজি নন। নিজেই বসলেন টাইপ করতে। ধীরগতি দেখে আমরা জোর করে তাকে তুলে দিলাম। আতাউস সামাদ টাইপ করলেন, আমি পড়ে দিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ অনেক ধন্যবাদ জানালেন। এভাবেই কাজ করতেন তিনি। নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকত না।’
৫. বঙ্গবন্ধু তার সুযোগ্য সহনেতাদের নিয়ে অসহযোগের দিনগুলোতে মৌলনীতির রূপরেখা স্থির করেন। আর দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অন্যান্য সংগঠক ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে সেসব মৌলনীতি নির্দেশের আলোকে প্রতিদিনই প্রশাসনিক নির্দেশ ও ব্যাখ্যা দিতেন। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো একটি পরিচ্ছন্ন সরকারই দাঁড় করে ফেলেছিলেন অসহযোগের দিনগুলোয়।
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে বোঝাপড়া এমন ছিল যে, দলের পক্ষ থেকে দেয়া যে কোনো বিবৃতিই সংশোধন ও সম্প্রচারের ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের হাতে দিয়েছিলেন।
ওই সময়ে দেয়া তার প্রশাসনিক নির্দেশাবলি ও বিবৃতির দিকে নজর দিলেই বোঝা যায় তিনি কী নিপুণভাবে অসহযোগের সেই দিনগুলোয় একটি জাতিকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। ৬. অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের পরিপূরক নেতৃত্বের চমৎকার প্রায়োগিক সাফল্য লক্ষ করা যায়।
একজনের গগনস্পর্শী ক্যারিশমা, অপরজনের মাটিসংলগ্ন রূপায়ণ দক্ষতা। একজনের অতুলনীয় রাজনৈতিক গ্লামার, অপরজনের প্রবাদতুল্য সাংগঠনিক দক্ষতা। উভয়ের মধ্যে গভীর বোঝাপড়া। একজন জনগণকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্দীপ্ত করে রেখেছেন, অপরজন চুলচেরা বিশ্লেষণ সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় জরুরি নির্দেশ জারি করছেন।
৭. ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ দিনগুলো বাঙালির ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটা নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্ববর্তী সময় ছিল এটি। অসংখ্য রাষ্ট্রীয় ঘটনার সঙ্গে বাঙালিদের সম্পৃক্ততা এ সময় সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ সময়কালকে বাঙালির স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্ব বলা যায়। একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলে জাতি হিসেবে তারা কতটা শৃঙ্খলার পরিচয় দেবে, রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক দায়িত্ব কীভাবে পালন করবে ও আইনের প্রতি জনগণ কতটুকু শ্রদ্ধাশীল থাকবে, তা পরীক্ষার সময় ছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাস।
এ পরীক্ষা জনগণের জন্য ছিল যেমন, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালকদের জন্যও ছিল তেমনই। ৮. একটি গণআন্দোলনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা কর্মসূচির দরকার, তা অসহযোগ আন্দোলনে আমরা দেখতে পাই এবং তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদের নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত এ সময়েই মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং বাঙালি স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিমুখে পৌঁছে যায়।
ড. সুলতানা আক্তার : সহযোগী অধ্যাপক : ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়