সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের আঘাত যদিও এ উদযাপনে পড়েছে- রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো পিছিয়ে নেয়া হচ্ছে, নানা প্রতিষ্ঠানের নেয়া উদযাপন কর্মসূচিও মুলতবি অথবা কাটছাঁট করা হচ্ছে- কিন্তু তাতে উদযাপনের মূল ভাবনাটিতে কোনো প্রভাব পড়বে, এরকমটা আমরা ভাবতে পারি না, মূল ভাবনাটি যেহেতু সকল আনুষ্ঠানিকতার ওপরে এবং তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কাজ থেকে শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা নেয়া, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজ ও মানুষ নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং তাঁর দেশপ্রেমকে নতুন করে উপলব্ধি করে সেগুলোকে আমাদের চিন্তাচেতনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা এবং তাঁর মতোই, দেশের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা।
এ কাজটি দেশের সব নাগরিকই করবেন, তবে যারা এটি সবচেয়ে কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদে করবেন, তারা হচ্ছে এ দেশের তরুণরা। একটা সময় ছিল- এবং সময়টা ছিল দুই যুগেরও বেশি- যখন রাষ্ট্রশক্তি বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তাঁকে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলা হচ্ছিল।
তরুণদের একটা বড় অংশ ধরে নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কোনো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল না, এর পেছনে পাকিস্তানি শাসনের পুরো সময়জুড়ে বাঙালির কোনো বিনিয়োগ ছিল না এবং মুক্তিযুদ্ধ কোনো জনযুদ্ধ ছিল না। সেই বিভ্রম অবশ্য কেটেছে।
তরুণরা এখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনছে- শুধু একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণটি নয়, বরং এমন সব ভাষণও যেগুলো তিনি সামরিক বা পুলিশ বাহিনীর নানা অনুষ্ঠানে দিয়েছিলেন- তাঁর লেখা তিনটি বই পড়ছে।
তারা এক আপসহীন এবং আদর্শবাদী রাজনীতিককে জানছে, স্বাধীনতার স্থপতিকে আবিষ্কার করছে এবং তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামমুখর জীবনকে নানাভাবে পাঠ করছে। এদের কাছে রাজনৈতিক দলে বা দলের ছাত্রসংগঠনে নাম লেখায়নি।
এদের কাছে দল একটাই এবং তা হচ্ছে বাংলাদেশ। এরা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া ছাত্র সংগঠনের অনেক সদস্যের কার্যকলাপ দেখছে এবং তাঁর আদর্শ এবং দেখানো পথ থেকে অনেক দূরে, অনেক ক্ষেত্রে বিপরীতে- তাদের অবস্থান দেখে অবাক এবং বিচলিত হচ্ছে।
কিন্তু মনে মনে এই প্রত্যয় পোষণ করছে, বাংলাদেশকে তারা এগিয়ে নেবে, সত্যিকার সোনার বাংলার আদলে তাকে গড়বে। আজকের দিনে তাদের দিকেই আমাদের তাকাতে হবে।
পাশাপাশি এ দেশের শ্রমিক-কৃষকদের, যারা সোনার বাংলা গড়ায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে, তাদের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। আমার বিশ্বাস, মুজিববর্ষ উদযাপন এই তরুণদের, খেটে খাওয়া মানুষদের, তরুণ উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের আরও দৃপ্ত পায়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ায় উৎসাহ জোগাবে।
তবে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটি আবশ্যকীয় শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে স্বচ্ছ সম্মুখদৃষ্টি, যা দূরদৃষ্টির সমার্থক। একটা পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে, আমরা কোথায় যাব, কীভাবে যাব এবং যখন লক্ষ্যে পৌঁছব, লক্ষ্যটাকে পরিব্যাপ্ত করে আরও দূরে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পটি কীভাবে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেব।
অন্যান্য শর্তের মধ্যে আছে সকল কাজে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সুনীতি চর্চা এবং সামাজিক শক্তির সমাবেশ ঘটানো; সংস্কৃতি ও শিক্ষার শক্তিকে একত্র করে চিন্তার, মননের, সৃজনশীলতার এবং উদ্ভাবনী প্রতিভার বিকাশ ঘটানো; সকল বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং সকল অধিকারের সুরক্ষা। এক বছরে এসব অর্জন সম্ভব নয়, তবে শুরুটা যদি প্রবল ইচ্ছাশক্তি দিয়ে হয়, তাহলে লক্ষ্যটা দেয়াল পঞ্জিকার হিসাবেই ধরা দেবে। এ নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়।
আমাদের দূরদৃষ্টি গড়ে দেয়ার জন্য আমরা বঙ্গবন্ধুর শরণ নিতে পারি। ব্যক্তিগতভাবে আমি বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শুরু করি ১৯৬৬ সাল থেকে, একটি জনসভায় তাঁর অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়ী ভাষণ শুনে।
এরপর স্বাধীনতার সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ নেয়া পর্যন্ত তাঁকে অনুসরণ করেছি, পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরে আসার পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে পর্যবেক্ষণ ও পাঠ করে গেছি।
এরপর তাঁর দুটি এবং এ বছর বেরুনো তাঁর তৃতীয় বইটি পড়ে তাঁর সম্পর্কে আমার দীর্ঘদিনে মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ আরও শক্তি পেয়েছে। আমি দেখেছি তিনি কত দৃঢ়চিত্ত একজন মানুষ ছিলেন, কতটা নির্ভয় এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, নিজের আদর্শে কতটা অবিচল ছিলেন, দেশ ও মানুষের প্রশ্নে কতটা আশাবাদী ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবগুলো পৃষ্ঠাই এখন আমরা পড়তে পারি এবং বুঝি, তিনি সময়ের বিপরীতে সাঁতার কেটে কেটে সময়কে আয়ত্তে এনেছিলেন; সাম্প্রদায়িকতাকে শুধু ঘৃণাই করতেন না। একে প্রতিহতও করেছেন।
তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, বৈষম্যকে শত্রু ভাবতেন, রাজনীতিকদের নির্লোভ, নিবেদিতপ্রাণ এবং সৎ দেখতে পছন্দ করতেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে জরুরি মনে করতেন।
তিনি নারীর স্বাধীনতাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিতেন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসেবে বিবেচনা করতেন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ইনসাফকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। এ সবই তিনি নিজের কাজে কর্মে করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন।
সব ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছিলেন, এ কথা বলা যাবে না। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে এগুলোর প্রয়োগে তিনি যে সাড়ে তিন বছরের মতো সময় পেয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল।
দুই শক্তিশালী পরাশক্তি ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধ ছাউনিতে, দেশেও শত্রুরা ঘাপটি মেরে ছিল- যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এক নির্মম বর্বরতায় তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করেছিল।
তারপরও, একটি ভেঙে পড়া দেশকে তিনি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। পশ্চিমের অনেক দেশপণ্ডিত বাংলাদেশের টিকে থাকাটাই যখন অসম্ভব বলে রায় দিচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু তখন এর শরীরে শক্তির সঞ্চার করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষের শুভক্ষণে আমরা তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে ভাবব। ওপরে তাঁর চিন্তা-আদর্শ-কাজের যে একটা তালিকা দেয়া হল, তার পুনঃপ্রয়োগ ও চর্চা হতে পারে ওই উত্তরাধিকারের একটি ভিত্তি। তিনি তাঁর আত্মজীবনীর একটি অংশ লিখে যেতে পেরেছিলেন এবং এর নাম দেয়া হয়েছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
তাঁর অনেক কাজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে। দেশে এখন বৈষম্য প্রকট, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। বিচার ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের সংশয়, শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু মানে উন্নতি নেই। মত প্রকাশের পথে অনেক বাধা। এগুলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীত। বঙ্গবন্ধুর যারা উত্তরাধিকারী হবেন, তাদের এ সবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
তাঁর উত্তরাধিকার সবচেয়ে কার্যকরভাবে ধারণ ও চর্চা করতে পারত তাঁর নিজের দল। কিন্তু এ দলের এক বড় অংশ এখন ব্যস্ত ক্ষমতা ভোগে, নানা বিলাসে, নানা অনৈতিক কাণ্ডে। তবে আমি নিশ্চিত, যারা এখনও নীরবে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে যাচ্ছেন, তারা এই উত্তরাধিকারের প্রশ্নে প্রস্তুত।
শেষ পর্যন্ত আমাদের ভরসার জায়গাটা সেই তারুণ্য। আমি এই তারুণ্যকে প্রতিদিন সামনে থেকে দেখি, এর সংস্পর্শে এসে উজ্জীবিত হই। আমার বিশ্বাস এই তরুণরাই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত উত্তরাধিকারী হবে। হচ্ছেও।
বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার ধারণ ও বাস্তবায়ন কথায় নয়, কাজে হবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু করতে হবে। আমি আরও নিশ্চিত, এ ক্ষেত্রেও এ তরুণদের সাফল্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আরও কাছে নিয়ে যাবে।