এম আর আখতার মুকুল


এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন

বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনা হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর এ দুটি সংগ্রামেই ছিল এম আর আখতার মুকুলের অবিস্মরণীয় ভূমিকা। বস্তুত ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সোপান।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু হয় পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের জাতিগত নিপীড়ন। প্রথমেই তারা আঘাত হানে এ দেশের মানুষের ভাষার ওপর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে বাংলার মানুষকে রক্ত দিতে হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ওই দিনকে আগেই ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু খুনি নূরুল আমিন সরকার ওইদিন ১৪৪ ধারা বলবৎ করে ২০ ফেব্রুয়ারি আদেশ জারি করে। ফুঁসে ওঠে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ঢাকা হলের পুকুরের পূর্ব পার্শ্বের সিঁড়িতে এক জরুরি গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এম আর আখতার মুকুলের ভূমিকা ঐতিহাসিক। ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি লাঠিচার্জ ও গুলিতে শহীদ হলেন ৬ জন ও আহত হন শত শত। নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুকুল গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন। প্রথমে ঢাকা থেকে যান রংপুরের এক গ্রামে মোহাম্মদ সুলতানের ভাই ডা. মোহাম্মদ সোলায়মানের বাসায়। তার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে ভারতের পথে পাড়ি জমান, প্রথমে দিনাজপুরের কাছে বিহারের কাটিহারে পরে কলকাতা। কলকাতায় কয়েক মাস কাটিয়ে নভেম্বর মাসে আবার ফিরে আসেন এবং ইকবাল হলে মোহাম্মদ সুলতানের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তখন তাদের দুজনেরই চলছিল চরম আর্থিক সংকট।

এম আর আখতার মুকুলের নিজের ভাষায়, ‘রমজানের ছুটিতে যখন সমস্ত ছাত্র গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, তখন আমি আর সুলতান ইকবাল হলের গোটা কয়েক চকি নয়াবাজারে বিক্রি করে খাওয়ার পয়সা জোগাড় করলাম।’ এরপর মোহাম্মদ সুলতান এবং মুকুল দুজনে মিলে মেডিকেল কলেজের পশ্চিম দিকে বর্তমান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পার্শ্বে ‘পুঁথিপত্র’ নামে একটি বইয়ের দোকান দেন।

এ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পুঁথিপত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি।

এম আর আখতার মুকুলের জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্রের লেখক ও পাঠক হিসেবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুরু করে ঘৃণ্য গণহত্যা। পরবর্তী ৯ মাসে তারা লাখ লাখ মানুষ হত্যা ছাড়াও ব্যাপক ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। শুরু হয় সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধ। এম আর আখতার মুকুল সীমান্ত অতিক্রম করে মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগে যোগদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। বস্তুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট।

বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে তিনি চরমপত্র লিখতেন ও বেতারে নিজে এক অনুকরণীয় কণ্ঠে পাঠ করতেন। এর ভাষ্য ছিল অত্যন্ত ধারালো ও ব্যঙ্গাত্মক।

এই চরমপত্র রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সৃষ্টি করত তীব্র রণোন্মাদনা। চরমপত্র শুনে পাকিস্তান অধিকৃত বাংলাদেশের বন্দি জীবনযাপন করা কোটি কোটি মানুষেরও হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার কিছু অংশ বাজানো হতো। বঙ্গবন্ধুর সেই কণ্ঠের পরেই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল এম আর আখতার মুকুলের কণ্ঠ। সে দিন যাদের জন্ম হয়নি বা যাদের বয়স বর্তমানে ৪৫ বছরের নিচে তারা চিন্তাও করতে পারবে না কি শক্তিশালী ছিল সেই কণ্ঠ।

১৯৭১ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধনের দিন থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান একটানা চলে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হতো না কে এই চরমপত্রের লেখক ও পাঠক। তাই কে এই ব্যক্তি তা নিয়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে চলত নানারকম কানাঘুষা।

অবশেষে সর্বশেষ চরমপত্র পাঠের শেষে মুকুল উল্লেখ করেন, ‘আইজ ১৬ ডিসেম্বর। চরমপত্রের শ্যাষের দিন আপনাগো বান্দার নামটা কইয়া যাই। বান্দার নাম এম আর আখতার মুকুল।’ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার ইতিহাসে এম আর আখতার মুকুলের নামটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক

SUMMARY

230-1.jpg