১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন এবং গড়ে ওঠে প্রতিরোধ।
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন আন্দোলনে। ইতিহাসে বিধৃত হয়েছে সে অবদানের কথা। সে কথা ফুটে উঠেছে অন্য ভাষা সংগ্রামীদের আত্মকথায়। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও সে সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা সুন্দরভাবে উঠে এসেছে।
বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকবার রাজপথ থেকে বন্দি হন বঙ্গবন্ধু; সঙ্গে আরও অনেকে। দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, কারণ গণদাবিকে অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না। বন্দি অবস্থায় একটি ঘটনার বর্ণনা থেকে এ কথা আরও স্পষ্ট হওয়া যায়, ‘আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে সেøাগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’Ñ নানা ধরনের সেøাগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।’ ( আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৯৩)
দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, কারণ গণদাবিকে অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তোহাব, আবুল কাসেম, রণেশ দাশ গুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি দান করে। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ, তেমনি সুদূরপ্রসারী। এই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল) পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে সফল হরতাল বা সাধারণ ধর্মঘট। এই হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম গ্রেপ্তার।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহম্মদ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি ’৫২ আমরণ অনশন শুরু করেন। এ সময় ১৭ ফেব্রয়ারি ’৫২ ইত্তেফাকে এক প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গি কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে কারাবাস ও বন্দি দিনগুলোর নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উৎকণ্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলে প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সব কর্মী, বিশেষ করে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের আশুমুক্তির জন্য আবেদনপত্র পেশ করেছেন। আবেদনপত্রে মওলানা ভাসানী, বিশিষ্ট ছাত্রনেতাসহ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা সই করেন। মানবতার নামে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের মুক্তির আবেদন জানিয়ে মওলানা ভাসানী একটি পৃথক বিবৃতি দেন, যা ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রাজবন্দি মুক্তি কমিটির সভায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে প্রস্তাব নেওয়া হয় এবং পোস্টার দেওয়া হয়।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণপর্বে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগা রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক করণেই ’৫১ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, গাজীউল হক)। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু সে সময় কারাগারের দিনগুলোর কথা, বাইরে রাজপথের নানান কথা তার আত্মজীবনীতে তুলে এনেছেন, ঠিক ২১ ফেব্রুয়ারি দিনের কথা তিনি বলেছেন এভাবেÑ “২১ ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন সেøাগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরও অনেক সেøাগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ ফরিদপুর আমার জেলা, মহিউদ্দিনের নামে কোনো সেøাগান দিচ্ছে না কেন? শুধু ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, বললেই তো হতো।”
১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করেন। ২৭ এপ্রিল ১৯৫২ তারিখে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলনের সফলতাপর্বে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এ উপলক্ষে আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস জড়িত। ভাষার অধিকার অর্জন করার পরই জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন দেখে বাঙালি জাতি। ধ্রুব সত্য এই, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছিল আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা।