শিপন হাবীব
বঙ্গবন্ধু যে বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, যে বাড়ি থেকে স্বাধিকারের সংগ্রামে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সে বাড়িটি আজও তার নানা স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে।
ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধু যে বাড়িতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, যে বাড়ি থেকে স্বাধিকারের সংগ্রামে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সে বাড়িটি আজও তার নানা স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে।
বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর। এই বাড়ির নতুন নম্বর হল ১০। সড়কের নামেই এখন বাড়িটির পরিচিতি। সড়কের নতুন নম্বর ১১।
তবে এই নম্বরটি বেশির ভাগ লোকই জানেন না। সবাই জানে ৩২ নম্বর। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন।
১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১-এর শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন- এই সবগুলোর সঙ্গে মিশে আছে বাড়িটি। দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই বাড়ি।
১৩ মার্চ ৩২ নম্বর বাড়িটিতে ঘুরে যা দেখা যায় সকাল থেকেই দর্শনার্থীরা বাড়িটিতে প্রবেশ করছিলেন। মিরপুর থেকে আসা সোনিয়া জামান তার পাঁচ বছর বয়সী কন্যাসন্তানকে নিয়ে এসেছেন।
গেটের বাইরে একটি গাছের নিচে বসে মা-মেয়ে বোতলের পানি দিয়ে ওজু করে বাড়িতে প্রবেশ করেন। সোনিয়া বলেন, ‘আমাদের পুরো পরিবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে। যখনই এ বাড়িতে আসি পবিত্র হয়ে প্রবেশ করি।’
তার কথার ফাঁকেই মেয়ে প্রশ্ন করে মা বঙ্গবন্ধুকে কেন মারা হল? এ প্রশ্ন শুনেই কেঁদে ওঠেন সোনিয়া।
বাড়িটির (জাদুঘর) নিচ তলায় একটি অফিস। প্রবেশ করতেই দেখা যায় অফিসজুড়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ছবি। একটি টেবিলে বসে কাজ করছিলেন জাদুঘরের সহকারী কিউরেটর কাজী আফরীন। তিনি বলেন, ‘যে টেবিলটিতে আমি কাজ করছি, সেটি ’৭১ সালের।
এখানে কাজ করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। মনে হয় এ বাড়িটিতে বঙ্গবন্ধু এখনও আছেন।’ তার সঙ্গে কথা বলে বাড়িটির নিচতলা ঘুরে দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে যেতেই কল্যাণেশ ও সবিতা আচার্য্য দম্পতির সঙ্গে কথা হয়। এসেছেন কলকাতা থেকে। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি মুছছিলেন। আর কী যেন বলছিলেন। এই সিঁড়িতেই বঙ্গবন্ধুর বুলেটবিদ্ধ প্রাণহীন দেহ পড়েছিল।
কল্যাণেশ বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল দু’জন একসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এ বাড়িটি দেখব। স্বপ্ন পূরণ হল। কিন্তু যা দেখালাম তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কষ্ট দেবে। যিনি দেশ দিলেন, তাকে কী করে হত্যা করল অসুরা-দানবরা?
ছয় বছরের শিশু আয়শা সিদ্দিকী বাবার সঙ্গে এসেছেন। হাতে নিজের আঁকা বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি। কেন এসেছ জিজ্ঞেস করতেই শিশুটি বলে, ‘কষ্ট হয় বঙ্গবন্ধুকে কিছু খারাপ মানুষ মেরে ফেলছে। শেখ রাসেলকে মেরে ফেলছে।’ এ সময় তার চোখে পানি টলমল করছিল।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হাবিবা বিনতে কাশেম ও মিনুয়ারা হুমাইরা এসেছে আজিমপুর থেকে। হাবিবা জানায়, সে বহুবার এসেছে। এখন বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে হাবিবা বলে, ‘বিশ্বাস করেন বঙ্গবন্ধু ছাড়া এ দেশ স্বাধীন হতো না। তিনিই বাংলাদেশ।’
ফরিদপুর থেকে আসা স্কুল শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম মজুমদার জানান, ঢাকায় চিকিৎসা করতে এসেছেন। ছেলে ধানমণ্ডি থাকেন। নাতনি ফারিয়াহকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখা বুক ফেটে কান্না আসছে।
বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতাকে কী করে ওরা হত্যা করল- ভাবতেই অবাক লাগে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে এ বাড়িটি দেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত।
বাড়িটি ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু, তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের শত শত স্মৃতি। ভবনটির নিচতলার করিডোরে বঙ্গবন্ধুসহ যারা ১৫ আগস্ট শহীদ হয়েছেন- তাদের ছবি টাঙানো। নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, ড্রয়িংরুম।
দেয়াল ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবি। ড্রয়িংরুমে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করতেন।
সে সময়ের সোফা, টেবিল ফ্যান আজও স্মৃতি হিসেবে ড্রয়িংরুমটিতে রাখা আছে। দুটি ফ্যান আজও সচল আছে। কক্ষটির পাশেই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। সেখানে বসে তিনি লেখালেখি করতেন। এখান থেকেই তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন। লাইব্রেরিটিতে ১৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ ছবি, আলমারিসহ গুলিবিদ্ধ বই রয়েছে।
দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষটি। যে কক্ষে বঙ্গবন্ধু ঘুমাতেন। পাশে আরেকটি কক্ষ রয়েছে-যে কক্ষটি তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানার। আরেকটি কক্ষে থাকতেন বড় মেয়ে শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যরা যে টেবিলটিতে খাওয়া-দাওয়া করতেন সেই টেবিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যবহৃত বাসন, গ্লাস, চামচসহ সবই আছে টেবিলটির ওপরে। পাশেই ৬টি চেয়ার ও একটি টি-টেবিল। রয়েছে তিনটি বসার মোড়া।
কর্নারে সাদা-কালো টিভি। বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যরা এখানে বসে টিভি দেখতেন। পাশেই রয়েছে শেখ রাসেলের দুটি সাইকেল। আছে তার বল, হকিস্টিক, ব্যাট আর হেলমেট।
শেখ রেহানার কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং পরিবারের শহীদ সদস্যদের রক্তমাখা জামা-কাপড় রাখা আছে। কক্ষটির মাঝখানে একটি টেবিলে গ্লাসের ভেতর রাখা আছে রক্তমাখা জামা-কাপড়।
শেখ রাসেলের রক্তমাখা শার্ট, তার পরিধেয় স্যুট, বঙ্গবন্ধুর চশমা, ঘাতকের গুলির আঘাতে বিদীর্ণ বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি, পরনের লুঙ্গি, ঘাতকের নিক্ষেপ করা বুলেট, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রক্তমাখা শাড়ি ও ব্লাউজ, রক্তমাখা রুমাল, শেখ নাসেরের রক্তমাখা পাঞ্জাবি ও টুপি। এ ছাড়া আছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিস।