ড. আতিউর রহমান
আমি আজ এমন এক ‘জ্যোতির্ময়’ ‘দিঘলপুরুষে’র কথা বলছি যিনি ‘গাধার চোখে স্বপ্ন বুনে দিলে/তারাও মানুষ হয়ে যেত।’ (বাবলু জোয়ারদার, ‘দিঘলপুরুষ’)। তিনি হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা বাঙালির স্বপ্নকে পরম মমতায় বুকে নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন স্বদেশের প্রান্তরে প্রান্তরে। এভাবেই দেশকে জেনেছেন, ভালোবেসেছেন। আমি আজ স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে মিশে থাকা সেই বীরপুরুষের কথা বলছি যার বজ্রকণ্ঠ বেজে উঠলে ‘ভূত-পেত্নীরা মুখ লুকাত/পালিয়ে যেত দিগন্তের ওপারে।’
দারুণ সাহসী ছিলেন তিনি। সেই সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সবখানে। আগুনের সেই পরশমণির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছিল তার প্রিয় স্বদেশ। আর তাই তিনি হতে পেরেছিলেন বাঙালির মুক্তির বাতিঘর। আমাদের স্বপ্নের ঠিকানা। তার আহ্বানেই তরুণরা দলে দলে যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। করেছে স্বাধীন স্বদেশকে। অথচ এক অন্ধকার রাতে মানুষের সেই ‘স্বপ্ন খুন হয়েছিল’। আর ‘স্বপ্নের (সেই) লাশ পড়েছিল উদোম আকাশের নিচে।’ (জোয়ারদার, ঐ)।
এর পর আমাদের এই দুর্ভাগা বাংলাদেশে নেমে এসেছিল গভীর অন্ধকার। ফের আমরা ‘আরশোলায়’ পরিণত হয়েছিলাম। যে ‘জাদুকর নীল আকাশের দরজা খুলে’ এসেছিলেন আমাদের জাগাতে, তাকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তখন বলা হতো ‘তুমি কেউ নও’। এর জবাবে অবশ্য আমাদের অন্যতম প্রবীণ কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন, ‘এই নাম স্বতোৎসারিত’। কবির ভাষায় :
‘... তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু বাংলাদেশের আড়াই শত নদী বলে,
তুমি এই বাংলার নদী, বাংলার সবুজ প্রান্তর
তুমি এই চর্যাপদের গান, তুমি এই বাংলা অক্ষর,
বলে ওরা, তুমি কেউ নও, কিন্তু তোমার পায়ের শব্দে
নেচে ওঠে পদ্মার ইলিশ;
তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
গান আর নজরুলের
বিদ্রোহী কবিতা বলে,
তুমি বাংলাদেশের হৃদয়।’
যিনি হাত বাড়ালেই অনায়াসে ধরে ফেলতেন ‘সপ্তর্ষীম-লী’, পৌঁছে যেতে পারতেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি কোনায়, আমাদের সেই আত্মার আত্মীয়কে হঠাৎ করেই চলে যেতে হলো তার প্রিয় দেশবাসীকে ছেড়ে। প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সেই ‘দিঘলপুরুষে’র আচমকা চলে যাবার দুঃখ ভুলি কী করে! রফিক আজাদের ভাষায়, ‘এই সিঁড়ি’ থেকে বয়ে যাওয়া রক্ত যে আরও বেশি ঋণী করে চলেছে আমাদের।
‘তার রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে
সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ
তার ছায়া দীর্ঘ হ’তে-হ’তে
মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে
তার রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে-
তার রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে।’
সেই উর্বর মাটিতেই আজ বাম্পার ফলন হচ্ছে। খাদ্যের প্রতিটি উপখাত আজ উদ্বৃত্ত। অথচ মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল দারিদ্র্য ও অনাহারের প্রতীক। প্রকৃতি ও কূটনীতি ছিল তখন দারুণ বৈরী। ঠুনকো অজুহাতে খাদ্য সাহায্য পি-এল ৪৮০ বন্ধ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রলম্বিত বন্যাকবলিত বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ সেই বাংলাদেশ আজ প্রায় সর্বক্ষেত্রেই উদ্বৃত্তের দেশ। প্রবৃদ্ধির গতিময়তা, নারী শিক্ষার অগ্রগতি এবং উঁচু স্তরের জীবনের আয়ুর সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আজ ঈর্ষণীয়।
শাসনব্যবস্থায় বিদ্যমান বেশ খানিকটা দুর্বলতা ও দুর্নীতির কালোছায়া সত্ত্বেও হালের বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর রূপান্তর এমনি এমনি ঘটেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একাত্তরেই আমাদের দেশের লড়াকু মানুষের মনে এক স্বপ্নের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যে ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু গেঁথে দিয়েছিলেন তরুণদের মনে তা নিয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওই স্বপ্নের সীমানায় পৌঁছানোর জন্য তারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু আরও জোরালোভাবে স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির মনে আশার বীজ বুনতে শুরু করেন। আমাদের সীমিত সম্পদ, ভগ্ন অবকাঠামো, নবীন প্রশাসন এবং বিপুল অভাব-অনটন সত্ত্বেও তিনি তার স্বপ্নের বাণীতে দেশবাসীকে নিরন্তর উদ্বুদ্ধ করছিলেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই (৯ মে ১৯৭২) তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বললেন :
‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে খাক।
আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক।
আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক।
আমি কী চাই? আমার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক।
আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’ (৯ মে ১৯৭২)।
দুঃসময়েও স্বপ্ন দেখানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা রাখতেন আমাদের এই শব্দের জাদুকর। তার নান্দনিক ব্যক্তিত্ব, উদাত্ত কণ্ঠ, মোহনীয় দেহভঙ্গি, সহজ-সরল ছন্দময় ভাষা এবং বিচক্ষণ উচ্চারণের কারণেই তিনি হতে পেরেছিলেন বাঙালির স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে দেওয়া তার অসাধারণ মহাকাব্যিক ভাষণটির কথা ভাবুন। টানটান উত্তেজনা, নাটকীয়তা, ক্ষোভ, শ্লেষ, প্রত্যাখ্যান, প্রত্যাশা, নমনীয়তা, কঠোরতা, ভাষার বৈচিত্র্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা, মুক্তির বার্তা, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, স্বপ্নের বিস্তার, ছোটগল্পের মতোই সব বলে না বলার মতো এক মহাকাব্য উপস্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক এই দিনে। তাই এ ভাষণটি আজ ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বের অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ। এ ভাষণের মাধ্যমেই তিনি রয়ে গেছেন সারাবিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে। সেদিন তিনি যে আকর্ষণীয় এক নান্দনিক ব্যক্তিত্বের দ্যুতি ছড়িয়ে ছিলেন লাখ লাখ মানুষের মনে তা আজও অমলীন হয়ে আছে।
অনেক পর্যবেক্ষকের চোখে তাই তিনি রয়ে গেছেন এক বিস্ময়কর প্রেরণাদায়ক শক্তির উৎস হিসেবে। একাত্তরের গণহত্যার দিনগুলোর সাক্ষী মার্কিন কূটনীতিক আর্চার কে. ব্লাড খুব কাছে থেকেই দেখেছেন এই মোহনীয় ব্যক্তিত্বকে। তাই ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘মুজিবের পুরো অবয়বেই ছিল শক্তির দ্যুতি। এই শক্তির উৎস তার দেশের সাধারণ মানুষ এবং তার নিজের ব্যক্তিত্ব। গড় বাঙালিদের চেয়ে তিনি দীর্ঘকায় এবং স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তিনি ছিলেন সুপুরুষ এবং তার ছিল গভীর দৃষ্টি। গোঁফ আর কালো মোটা ফ্রেমের চশমা তার ব্যক্তিত্বকে দিয়েছিল আলাদা মাত্রা। তাকে কখনই পশ্চিমা ঢঙের পোশাক পরতে দেখিনি, সব সময়ই একজন দেশীয় রাজনীতিকের বেশভূষা নিয়ে চলতেন।’
-আর্চার কে. ব্লাড (‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’)
ইতিহাসের ঘূর্ণিপাকে বাংলাদেশের এই বিশাল হৃদয় এবং বাঙালির স্বপ্নের সম্রাটের লাশ পড়েছিল অবহেলায় ৩২ নম্বর সড়কের তার প্রিয় বাড়ির সিঁড়িতে। এর পর পদ্মা-মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। আমাদের সবার সংগ্রামে, আত্মত্যাগে এবং ভালোবাসায় তিনি ফিরে এসেছেন বিপুলভাবে বাঙালির মানসলোকে। দিন দিনই তিনি আরও বড় হচ্ছেন, আরও প্রবল হচ্ছেন। এবং আরও ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ হয়ে উঠছেন স্বদেশে ও বিদেশে। আর কোনো জাতির পিতা কি ২২ বার জেলে গেছেন, একাধিকবার ফাঁসির মঞ্চের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছেন, নিজের জীবন ছাড়া আর সবকিছুকেই মহামূল্যবান ভাবতেন? আর তাই চরম দুঃসময়েও তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং দেশবাসীকে তা দেখাতেন, উৎসাহ জোগাতেন এভাবে :
‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’
-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৬ মার্চ ১৯৭২।
এই ‘দিঘলপুরুষে’র জন্মশতবার্ষিকীতে প্রতি সপ্তাহে আমি হাজির হবো পাঠকদের সামনে। ‘বাংলাদেশের আরেক নাম’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের নানা-বাঁকের, নানা-অধ্যায়ের গল্প বলব আপনাদের সবাইকে। বিশেষ করে তরুণদের শোনাতে চাই তার বেড়ে ওঠার কাহিনি; বলব তার অসাধারণ সাহস, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, সাধারণ মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং মানুষের জন্য কিছু একটা করার তার অফুরন্ত ভাবনা ও কর্মের নানা টুকরো-টুকরো গল্প। জানাব পাঠকদের তার বিপুল প্রাণশক্তির কথা। গভীর দেশপ্রেমের কথা। আর গরিব-দুঃখী মানুষের প্রতি তার দরদি মন ও মানবিক অনুভবের কথা। আশা করি মুজিববর্ষজুড়েই প্রতি সপ্তাহে উৎসাহী পাঠকদের পাশে পাব আমাদের স্বপ্নের সম্রাটের জীবনের নানা বাঁকের নানা উপাখ্যানের উপস্থাপনার সময়।
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর