লেখক বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি


ড. আখতার হোসেন

বাংলা একাডেমি মুজিব শতবর্ষের প্রাক্কালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চীন ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। বঙ্গবন্ধু ভ্রমণকাহিনীটি কারাগারের অন্তরালে ১৯৫৪ সালে লিখেছিলেন।


এ গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আলোচনা করেছেন, তারপর আর কোনো আলোচনার অবকাশ থাকে না। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এদেশের পাঠককে আলোড়িত করেছে।

‘আমার দেখা নয়াচীন’ এক্ষেত্রে আরও একটি সংযোজন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও বাগ্মিতা সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। এ বিষয়ে তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। এ মহান পুরুষের তিনটি গ্রন্থ প্রকাশের ভেতর দিয়ে তার অসাধারণ লেখনীশক্তির পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গ্রেফতার ও মুক্তি লাভের পর ১৯৫২ সালের অক্টোবরে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে চীন ভ্রমণের সুযোগ পান বঙ্গবন্ধু।

মাত্র ১২ দিনের স্বল্পস্থায়ী ভ্রমণের ওপর তার লেখা চীন ভ্রমণের বর্ণনায় উপস্থাপিত হয়েছে এক অসাধারণ চিত্র, যা আমাদের সাহিত্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। শান্তি সম্মেলন আর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গেলেও তার ভ্রমণে ছিল চীনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ।

বঙ্গবন্ধু নয়াচীনকে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন, তাতে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সবকিছু গভীরভাবে অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ করেছেন। অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সে তথ্যকে পুনর্যাচাই বা সত্যানুসন্ধানের ভেতর উপস্থাপন করেছেন।

বিপ্লবোত্তর চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পর্কে যে তথ্য দোভাষীর মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন, সেসব শুধু পর্যবেক্ষণই করেননি, স্বচক্ষে যাচাই-বাছাইও করেছেন। যাচাই-বাছাইয়ের সূত্রও বর্ণনা করেছেন।

একজন গবেষক সমাজ-রাষ্ট্রকে জানতে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেন, বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের ওপর লিখিত গ্রন্থের উপস্থাপনায় এ পদ্ধতির অনুসরণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তথ্য সংগ্রহ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, একই সঙ্গে ভিন্ন সংস্কৃতিকে দেখার নিরপেক্ষ অবস্থানেরও পরিচয় পাওয়া যায় এ গ্রন্থে।

নয়াচীন ও পূর্ববর্তী চীনের তুলনামূলক আলোচনায় একই সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক আদর্শ এবং সর্বশেষে নিজের উপলব্ধি সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্য দিয়ে গ্রন্থটির উপসংহার টেনেছেন, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই।

তা না হলে মানুষের জীবনবোধ পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।’ (পৃ. ১১৯)। এ কথার ভেতর প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক আদর্শ; মানুষের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বাক্স্বাধীনতা একই সূত্রে গ্রথিত। এ আদর্শ বাস্তবায়নে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু নিজে কখনও কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার দলের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কমিউনিস্টবিরোধী আর মওলানা ভাসানী ইসলামের একজন ধর্মপ্রাণ খাদেম। তারপরও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে তিরস্কৃত হয়েছেন।

অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। চীন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বঙ্গবন্ধুর গভীর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একদিন চীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশে রূপান্তরিত হবে।

অন্যদিকে রাশিয়া কমিউনিস্ট নীতির নতুন পথ অবলম্বন করে ভুল পথে চালিত হয়ে আবার সংশোধন করে। (পৃ : ১১৬)। দুই দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ভিন্নতার ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিলেন মাত্র ৩২ বছরের তরুণ তৎকালীন শেখ মুজিব।

তার ফলাফল কী হয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে। অথচ বঙ্গবন্ধু আজ থেকে ৬৮ বছর আগেই তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সামগ্রিক রাষ্ট্র নির্মাণচিন্তার প্রতিফলনের উৎসরণ পাওয়া যায়।

এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গুণাবলি প্রকাশ পেয়েছে। দেশের সম্মান রক্ষা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও নিজের ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মানবোধ, কারও ব্যক্তিগত গুণ প্রকাশের সাহস এবং নির্ভয়ে সত্য কথা বলার সৎ সাহস, শিশুর প্রতি শুধু গভীর ভালোবাসাই নয়- শিশুসুলভ মন, সৌন্দর্য ও সৌজন্যবোধ, যা বঙ্গবন্ধুকে শুধু মহান নেতা নয়, একজন মহামানবে পরিণত করেছিল।

নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শের বৃত্তে নারী স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষক-শ্রমিকের ন্যায্য পাওনার কথা বলেছেন। আবার ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। মাত্র ১২ দিনের সফরে একটি রাষ্ট্রের তথা সমাজের খুঁটিনাটি বিষয় তার দৃষ্টির আড়াল হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুলপর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা, একই সঙ্গে কারিগরি, কৃষিশিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে এ গ্রন্থে। এমনকি জনগণের নেতা নয়াচীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের কঠোর নিরাপত্তায় বসবাসের বিষয়টিও তার দৃষ্টির আড়াল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ই ব্যাপক গবেষণার অপেক্ষা রাখে।

সম্মেলনে যাত্রার প্রাক্কালে পাকিস্তানি প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের আগেই বঙ্গবন্ধু সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো রাজনৈতিক নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ করা হবে না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের দেশের মুসলিম লীগের শাসনের কথা যদি বলি তবে দুনিয়া হাসবে।

কারণ মুসলিম লীগের গণতন্ত্রের যে রূপ, তা কোনো সভ্য সমাজে না বললেই ভালো হয়। তাতে পাকিস্তানের ইজ্জত যাবে।’ (পৃ. ৩৪)। এখানেই বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও আত্মসম্মানবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর মনের গহিনে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তার এ বোধের প্রেক্ষাপটে রয়েছে রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসুর চিন্তার প্রভাব। তিনি মনে করতেন বৃহৎ বাংলা হলে তা সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারত।

কিন্তু দিল্লি গিয়ে বিফল মর্মবেদনায় বৃহৎ বাংলার খণ্ডিত অংশ পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে এলেও অন্তরে ছিল বাঙালির মুক্তি (অন্নদাশংকর রায়, কাঁদো, প্রিয় দেশ, উদ্ধৃতি আবুল হাসান চৌধুরী, ২০২০ মার্চ, কালি ও কলম, পৃ. ১২৪)। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি চেতনার দৃঢ়প্রত্যয় স্পষ্ট হয় ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা’ স্বীকৃতির দাবির ভাষা আন্দোলনের ভেতর।

শুধু সচেতনতাই নয়, তার অন্তরে বিশ্বাস ছিল যথার্থ বাঙালি হওয়ার চর্চা বা অনুশীলনে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ভাইস চ্যান্সেলর চীনা ভাষায় বলছেন, দোভাষী ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলেন। দোভাষী যখন দু-এক জায়গায় ভালোভাবে বুঝতে পারছে না, সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই অনুবাদ করে দিচ্ছেন।

ভদ্রলোক ভালো ইংরেজি জেনেও ইংরেজি বলেন না। জাতীয় ভাষায় কথা বলেন। আমরা বাঙালি হয়ে ইংরেজি আর উর্দু বলার জন্য পাগল হয়ে যাই। বলতে না পারলে এদিক সেদিক করে বলি।’ (পৃ. ৬৮)। বঙ্গবন্ধু চীনা শান্তি সম্মেলনে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বাংলায় বক্তৃতা করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সহজ ও ন্যায় পথে। কোনো ধরনের ছলচাতুরী বা কূটকৌশলের রাজনীতিকে প্রশ্রয় বা আশ্রয় দেননি তিনি। তার সত্যবাদিতার এবং অন্যের গুণকে প্রশংসা করার দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধু মুসলিম হওয়ার জন্য গর্ব অনুভব করতেন (পৃ. ১১২)।

কিন্তু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্ম ব্যবসা বা ধর্মীয় কুসংস্কারকে অপছন্দ করতেন। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত জীবনযাপন বা আচরণের মধ্যে দেখতে চেয়েছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ, অত্যাচার, এমনকি নারী নির্যাতন তার অপছন্দনীয় ছিল। নয়াচীন সফরে এসে দেখেন ৪ বছরের মধ্যেই চীন ধর্মীয় কুসংস্কারমুক্ত হয়েছে।

পাকিস্তান কবে এ ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে? বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে জিন্নাহর ভূমিকাকে প্রশংসার চোখে দেখে বলেছেন, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বেঁচে থাকলে অন্ততপক্ষে এ কাজটা করতে পারতেন।’ (পৃ. ১১৪)। এ উক্তির ভেতর বঙ্গবন্ধুর ঔদার্য্য ও সৎসাহসের পরিচয় পাওয়া যায়।

জিন্নাহ বাংলা ভাষার ঘোর বিরোধী এবং বাঙালির শত্রু ছিলেন, তারপরও বঙ্গবন্ধু এখানে জিন্নাহর ভূমিকার শুধু প্রশংসাই করেননি, তার ওপর ভরসাও করেছিলেন। এমন বিরল চরিত্রের বৈশিষ্ট্য শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধুর যেমন বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল, তেমনি তিনি সত্য কথা বলতেও দ্বিধা করতেন না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজের কথা বলছেন, ‘আমি একটু মুখপোড়া মানুষ, মনে যা আসে এবং তা সত্য হলে মুখের ওপর বলেছি।’ (পৃ. ১০৬)। এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আসল চরিত্র।

ঘুষ-দুর্নীতি, নারীর অবমাননা, ধর্মকে নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার- এসব অনাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন তিনি।

দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকের মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, সে চেতনার বাস্তবায়ন চীন কীভাবে করেছে, তা সরেজমিনে বা মাঠপর্যায়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এখানে ধারণা করা যেতে পারে, এ অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।

বঙ্গবন্ধুর ভেতর আরেকটি শিশুমন লুকায়িত থাকত। সেই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় চীন ভ্রমণের কাহিনীতে। বঙ্গবন্ধু সব সময় শিশুদের সান্নিধ্যে হারিয়ে যেতেন শিশুস্বর্গে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা জানাতে শিশু-কিশোররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাত।

একবার বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে সবাই যখন বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন দেখা গেল বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আছে শিশু-কিশোররা। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কারণ আমি ওদের সাথে একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়া দিয়েছিলাম।

ওরা মনে করলো পেয়েছি মনের মতো লোক, তাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো।’ (পৃ. ৬৮)। বঙ্গবন্ধু ওদের সঙ্গে খেলা করে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহারও ছিল শিশুর মতো আবেগ আর ভালোবাসায় ভরপুর। বঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রেমের নিদর্শন হিসেবে সরকার তার জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধ ও সৌজন্যবোধ ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বারবার বলেছেন, ‘তিনি লেখক নন, তাই সেসব দৃশ্যের বর্ণনা দিতে পারছেন না। কারণ আমি লেখক নই, আমি অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার মতো ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেন নাই।’ (পৃ. ৬৬)।

চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের কঠোর নিরাপত্তায় জীবনযাপন বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন- ‘আপনাদের নেতাকে সকলেই ভালোবাসেন, তবে তিনি ওভাবে গার্ডের ভিতর বাস করেন কেন।’ (পৃ. ১০২)। জবাবে জানানো হয়, শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রের কথা।

সৎ লোকের শত্রুও বেশি। এ কথা বঙ্গবন্ধু মেনে নিলেও তার বিশ্বাস ছিল জনগণের প্রকৃত ভালোবাসাই বড় প্রাপ্তি। বঙ্গবন্ধু কোনো হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাস করতেন না। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কোনো কল্যাণ আসে না।

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো নাগরিক তাকে হত্যা করতে পারে- তা ছিল তার কল্পনার অতীত। বন্ধুরাষ্ট্রসহ দেশের সব সংস্থার সতর্কবাণীও বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি।

‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় একে একে উঠে এসেছে, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে লিখিত এ সম্পদকে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে বঙ্গবন্ধুকে জানার এক অবারিত দ্বার

উন্মোচন হল। প্রসঙ্গক্রমে একটি বক্তব্য এ গ্রন্থ পাঠে প্রতীয়মান হয়- বঙ্গবন্ধু উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামাজিক যৌথ অংশীদারিত্বের ভেতর দেখতে চেয়েছিলেন। তার চিন্তাচেতনার সুফল চীনে প্রত্যক্ষ করেছেন।

কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় যৌথ অংশীদারিত্বের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা জাতীয়করণের ব্যবস্থাপনা কী প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছিল, তার অনুসন্ধানে ভবিষ্যতে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ববাসী আজ বুঝতে পারছে কী অমূল্য সম্পদ অকালে হারিয়ে গেছে এবং কী দৃঢ়নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে বিশ্ব। এ মহামানবের জীবনদর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে অবারিত সম্পদ।

ড. আখতার হোসেন : গবেষক ও লেখক

SUMMARY

2291-1.jpg