অমিত রায় চৌধুরী
শতবর্ষ আগে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলার এক নিভৃত জনপদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে সময়ের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনচর্যা, অর্থনীতি, উৎপাদন, রাজনীতি, জলবায়ু, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বব্যবস্থা- কোনোকিছুই এ সময়ের সঙ্গে মেলে না।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে একদিকে যেমন চলছিল স্বাধীনতার লড়াই, অন্যদিকে সমাজের অভ্যন্তরেও নীরবে ঘটে চলেছিল বিভাজন, মেরুকরণের আয়োজন। নতুন নতুন তাত্ত্বিক ও ধারণাগত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থা অগ্রসর হচ্ছিল।
রাষ্ট্রের চরিত্র নিরূপণ অথবা শাসক ও নাগরিকের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক কাঠামোর স্বরূপ নির্ধারণেও চেতনাগত দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল ছিল। একদিকে উগ্র জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা ও আধিপত্যবাদের বিস্তার, অন্যদিকে ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বকে প্রায় বিভক্ত করে ফেলেছিল।
সামাজিক দ্বন্দ্ব ও বিভেদের ধারায় বিগত কয়েক শতকজুড়ে সমাজ পরিবর্তনের নানা পর্যায়, আন্দোলন-সংগ্রাম, এমনকি বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে বিশ্ব; যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়ও লক্ষণীয় রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলে। আর এ পরিবর্তন সূচিত হয় সমকালীন প্রেক্ষিত, বাস্তবতা ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে এমনই একটা বিপ্লব বলা চলে যা ৪৭-র দেশভাগ থেকে শুরু করে প্রায় ২৪ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।
এ বিপ্লবের মহানায়ক যে ইতিহাসের বরপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর এ বৈপ্লবিক রূপান্তরের মধ্য দিয়েই যে ঘটে যায় বাঙালি জাতিসত্তার বিস্ময়কর উদ্বোধন- তা আজ ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বঙ্গবন্ধু মুজিব। বাংলার মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে ওঠে তার নিবিড় সখ্য। ঠিক যেন বাংলার শ্যামল প্রকৃতি তার নিজ হাতে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক ও মানসিক গঠনকে তৈরি করেছে।
অনেক পশ্চিমা চিন্তাবিদ মনে করেন- মুজিবের চেহারার মধ্যেই একটা অকৃত্রিম শক্তি, স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ও শক্তির ছায়া ছিল। তার লম্বা ছিপছিপে গড়ন আর তীক্ষè দৃষ্টি তার চরিত্রের মৌলিক মুখবন্ধ রচনা করেছিল। খুব কাছ থেকে তিনি দরিদ্র মানুষের আটপৌরে জীবনের খুঁটিনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। প্রবৃত্তিগত সহমর্মিতায় তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছেন।
গ্রাম-শহর, নগর-বন্দর, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তার বিশাল হৃদয়ে আশ্রয়ের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে, তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে মুক্তির রূপালী আলোর ঝলক দেখতে পেয়েছে। অসম সাহস, আপসহীন দৃঢ়তা, প্রশ্নাতীত সততা, জাদুকরী নেতৃত্ব, সম্মোহনী বাগ্মিতা ও তীক্ষ্ণ মেধাকে অবলম্বন করে ইতিহাসের নানা বাঁক, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একসময় বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। তিনি পরিণত হন একটি আধুনিক, মানবিক জাতিরাষ্ট্রের জনক।
যুগ যুগ ধরে বাঙালির বঞ্চনা, শোষণ বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের রসদ জোগাতে বাংলা থেকে বিপুল সম্পদ পাচার এবং পরবর্তীকালে দুর্ভিক্ষের ফলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু-বিভীষিকা বাঙালিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। ৪৭-র পর পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলাকে কলোনি হিসেবে ব্যবহার করলে জনমনে বৈষম্য ও হতাশা বাড়তে শুরু করে।
একজন পাকিস্তানি বিশ্লেষক মনে করেন- রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চনা পূর্ববাংলার অধিবাসীদের নিরাপত্তাহীন ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ৪৮ থেকে বৈষম্য ও উপেক্ষা শুরু হলেও ভাষার ওপর আঘাত বাঙালিকে রাজপথে নামিয়ে আনে।
প্রবৃত্তিগতভাবে রাজনীতির বিশুদ্ধ ব্যাকরণে সিদ্ধ বঙ্গবন্ধু বাঙালির আকাঙ্ক্ষা, আবেগ ও আত্মাকে ধারণ করে মুক্তির পথে জাতিকে এগিয়ে নিতে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হন। জনমোহিনী সাংগঠনিক সক্ষমতা, সর্বস্ব ত্যাগের প্রস্তুতি ও বারবার কারাবরণ তাকে জনপ্রিয়তার উত্তাল সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মন্ত্রিত্বকে অবলীলায় ছুড়ে ফেলে জনতার কাতারে মিশে যান বঙ্গবন্ধু।
জনতা তার প্রকৃত বন্ধুকে চিনতে শুরু করে। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব কিংবা ভোগ কোনোকিছুই তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ও সংগঠন এতটাই একাত্ম ও সমার্থক হয়ে ওঠে যে, তার অনুপস্থিতিতে তার নামে অত্যন্ত সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিরল নজির সৃষ্টি হয়।
রাজনীতি পাঠে যখন বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ি ঘটছিল, যখন তার মানসিক গড়নে দেশপ্রেমের অনুজীব প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছিল, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দিনবদলের আকাঙ্ক্ষায় একটি আদর্শিক গন্তব্যের খোঁজে তিনি ক্রমেই চঞ্চল হয়ে উঠছিলেন, ঠিক সেসময়েই বিশ্বব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের দাপট সমকালীন যুগমানসকে প্লাবিত করে রেখেছিল।
বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বিশেষ করে অবহেলিত কৃষক সমাজের ভাগ্যবদলের স্বপ্ন কিংবা কোনো বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন। ধর্মীয় বিভাজনের ধারায় দেশভাগ হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে পাঞ্জাবি ধনিক শ্রেণির শোষণ, ভোগ ও অবহেলার শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে- তা বুঝতে বঙ্গবন্ধুকে এতটুকু সময় নিতে হয়নি।
অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তিনি ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ণয় করে ফেলেন এবং পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন থেকে সর্বাত্মক জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সম্ভব করে তোলেন। লক্ষণীয় যে, সাংস্কৃতিক মৌলিকত্ব, শ্রেণিগত অবস্থান ও বহুমতের মিলিত স্রোতকে তিনি সহিষ্ণুতা, সাম্য ও শক্তির প্রতীকে পরিণত করেছিলেন। এভাবেই তিনি পাশ্চাত্য গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র- কোনো ধারণাকেই একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগ না দিয়ে শোষিত মানুষের জন্য বাংলার আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই একটি আধুনিক ও মানবিক জীবনব্যবস্থার পথনকশা তৈরি করেছিলেন।
সামাজিক ন্যায়ের যে দর্শনে তিনি নতুন একটি জাতিসত্তার জন্ম দিয়েছিলেন, প্রথাগত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার অনেক মিল ছিল; কিন্তু সে আদর্শ একান্তই বঙ্গবন্ধুর ভাবনার স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয় জীবনবোধের মৌলিকত্বের প্রমাণ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার মধ্যে যাতে সম্প্রীতি, আস্থা, ঐক্য ও নিরাপত্তা বজায় থাকে সেজন্য দেশবাসীকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান। ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞাও তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য বা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সর্বত্রই ধর্মনিরপেক্ষবোধের মধ্যে ধর্মকে অনেকাংশেই নিষ্ক্রিয় রাখার ধারণা নিহিত; কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধুর দর্শনে যে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নতুনভাবে চিত্রিত হয়েছে তা ধর্মকে বিযুক্ত করে নয়, বরং সংযুক্ত করে, বহিরাঙ্গে নয়, অনেকটাই অন্তরঙ্গে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মচর্চার আবহমান ধারাকে তিনি মান্যতা দিয়েছেন মনে-প্রাণে। এখানেই তার চিন্তার উৎকর্ষ, আদর্শিক সৌন্দর্য ও আচরণগত সততা। বঙ্গবন্ধু উদার ছিলেন, আপসকামী ছিলেন না। বিজ্ঞানবিরোধী প্রগতিবিমুখ অপশক্তির সঙ্গে তিনি কখনোই সমঝোতা করেননি।
প্রবল আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু অনেক প্রতিকূলতাকে জয় করেছিলেন অকল্পনীয় ক্যারিশমা দিয়ে। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বস্ততা ও মহান প্রেক্ষাপটের প্রতি আনুগত্য ছিল তার ভূষণ। বঙ্গবন্ধু নিজেকে অতিমানবীয় সত্তা ভাবেননি, বরং আলোকিত পরম্পরার উত্তরাধিকার ভেবেছেন। সুভাস বোস, সি আর দাশ, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা প্রমুখের পথকে, দর্শনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি স্মরণ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাকে কালজয়ী দার্শনিক রাজায় পরিণত করেছিল। তার দেহের ভাষা, বাগ্মিতা, যুক্তি প্রক্ষেপণ আর শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার অবিস্মরণীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি কার্যত পাকিস্তান শাসনযন্ত্রকে ভেঙে খান খান করে ফেলেন। পূর্ব বাংলার সমাজ বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলতে থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা নজিরবিহীন।
উনিশ মিনিটের এ ভাষণই এখন মানবসভ্যতার অমূল্য দলিল, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার। লিঙ্কন, ম্যানডেলা, চার্চিল, মাওসেতুং-র মতো কালজয়ী বাগ্মীরা একে একে বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বলতার পাশে ম্লান হয়ে গেছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে এভাবেই তার ভাষণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত। ধারাবাহিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নানা বাঁক, সংগ্রামের ন্যায্যতা, আইনসিদ্ধতা ব্যাখ্যা করে স্বাধীনতার পরোক্ষ ঘোষণা দিয়ে তাৎক্ষণিক এ বাগ্মিতায় তিনি কোটি জনতাকে জয় করেছিলেন অপার মুগ্ধতায়। নিরস্ত্র, নিরীহ, শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে তিনি মাতৃভূমির মুক্তির শপথে সশস্ত্র যোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন।
এ ভাষণ ছিল কার্যত একটি বিপ্লব যা ৩০ লক্ষ নর-নারীকে মহান আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল; রীতিমতো যা এক বিস্ময়। তার বক্তব্যে কোনো ঘৃণা ছিল না, ছিল যুক্তির শৃঙ্খল, বহুদর্শিতার লক্ষণ, ন্যায্যতার পক্ষে জোরালো পক্ষপাত। এভাবেই সেদিন তিনি তার নিজের গড়া সাফল্য ফলকগুলোকে একে একে পরাভূত করে পৌঁছে যান এক বিস্ময়কর নেতৃত্বের স্বপ্নসৌধে। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘাতকরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল, অতর্কিতে, রাতের আঁধারে অরক্ষিত সাদামাটা বাসগৃহে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় তার নশ্বর দেহকে বিষাক্ত বুলেটে নিষ্প্রাণ করে দেয়া ছাড়া তার জাগতিক অস্তিত্বকে নিঃশেষ করা সম্ভব নয়।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ এক জঘন্যতম কলঙ্কতিলক। কিন্তু এ নরপিশাচরা বুঝতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর অন্তর্গত শক্তির বিপুলতা ও বিশালতাকে; যা ভষ্ম থেকে আরও প্রবল শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। আর ক্রমেই তা বিস্তৃত হতে থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে।
পাকিস্তান কারাগারে বঙ্গবন্ধু চরিত্রের আরও একটি দুর্লভ অধ্যায় উন্মোচিত হয়। অকল্পনীয় মানসিক শক্তি ও আদর্শিক ঋজুতা একজন মানুষকে সম্পূর্ণ দুর্যোগপ্রতিরোধী করে তোলে, দিনের পর দিন মানসিক ও শারীরিক পীড়নের পাশাপাশি নিরন্তর মৃত্যুভয় তাকে আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত করতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে গোটা বিশ্বে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল- ধূর্ত পাকিস্তানি শাসকরা পাছে কনফেডারেশনের মতো আপসরফার টেবিলে তাকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে হিথরো বিমানবন্দরে তিনি প্রমাণ করে দেন- তিনি আর কেউ নন, টুঙ্গিপাড়ার ক্ষণজন্মা সেই বাঙালি যিনি মৃত্যুকে জয় করেন বারে বারে, অবলীলায়। তিনি সর্বত্যাগী মহামানব, তিনি মৃত্যুর মুখেও অবিচল, স্বাভাবিক, দৃঢ়। তিনি বলেছিলেন, বাঙালির সঙ্গে তিনি বেঈমানি করতে পারেন না। তিনি একজন মানুষ, একজন মুসলমান, একজন বাঙালি।
১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা বঙ্গবন্ধু চরিত্রের আরও একটি বিরল দিকচিহ্নের সন্ধান পাই। প্রচণ্ড আবেগে বাষ্পরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু সে দিনের ভাষণেই সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি কী হবে সে সম্পর্কে একটি সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন যা কেবলই বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব।
জনউচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত বিমানবন্দরে একজন চিরকালীন বাঙালির চিরচেনা আবেগমাখা কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন- কবিগুরু তুমি আজ এসে দেখে যাও, আমার বাঙালিরা তোমায় আজ ভুল প্রমাণ করেছে। তারা সত্যিই আজ মানুষ হয়েছে। নিয়তির নির্মম পরিহাস সেই বাঙালির হাতে ইতিহাসের মহানায়কের রক্ত ঝরেছিল, সে রক্তসে াত গড়িয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলার ভৌগোলিক মানচিত্রের সর্বত্র। আর তাইতো আজ বাঙালি হৃদয়ের সবজুড়ে শুধুই বঙ্গবন্ধুর অধিষ্ঠান।
বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল। তিনি সাবলীলভাবে বলতে পেরেছিলেন, এ দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ দুর্নীতি করে না, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ দুর্নীতি করে। গরিবের সম্পদ লুণ্ঠনকারী দুর্র্বৃত্তদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবেন বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন; কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে বাঁচতে দেয়নি।
আজ বঙ্গবন্ধুর বাংলায় আবার ঋণখেলাপি, নদীদখলকারী, বনখেকোদের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। ভোগ, কর্তৃত্ব ও প্রদর্শনবাদী মনস্তত্ত্ব নেতাকর্মীদের মনোজগৎ আচ্ছন্ন করছে কিনা তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ততাকে অটুট রাখতে গেলে, লোভ ও ক্ষমতার মোহ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করা আরও জরুরি।
বঙ্গবন্ধুর নামে আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলে আমরা রাজনীতির জায়গাকে পোক্ত করি। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশুদ্ধতার, কপটতার বিরুদ্ধে সত্যের, অহমিকার বিপরীতে সৌজন্যের আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যে রাজনীতি বঙ্গবন্ধু সূত্রপাত করেন সে পরিসর আজ অনেক সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি যারা বিশ্বাস করে না- তারাও আজ বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। আর যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি অনুশীলন করেছিলেন- তাদেরও আজ ঠিক চেনা যায় না।
বিত্ত, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের হাতছানি তাদের ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুর চিরচেনা ঘরানার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ পরে আজকের বাংলাদেশ বৈষয়িক সমৃদ্ধি, সম্ভাবনা ও বিকাশের সূচকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু আদর্শিকভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশটিকে সঠিক কক্ষপথে সংযুক্ত রাখতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আবার দেশকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, দেশাত্মবোধের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে।
সহিষ্ণুতা, বহুত্ব ও অন্তর্ভুক্তির দর্শনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন যদি সত্য হয়, তবেই তা মুজিববর্ষের এ পুণ্যতিথিতে পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ জাতির অবিরত শ্রদ্ধার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হবে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ