এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামটি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার রামবাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর কলকাতায় রিপন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পারিবারিক কারণে তাকে ঢাকায় চলে আসতে হয়।
১৯০৬ সালে কুমিল্লা কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এই বছরই আবারো রিপন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯০৮ সালে বিএ পাস করেন। ১৯১০ সালে তিনি আইন পাস করে কিছুদিন কুমিল্লায় শিক্ষকতা করেন এবং ১৯১১ সালে আইন ব্যবসা শুরু করেন। রাজনীতি ও আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি আমৃত্যু দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।
১৯৭১ সালে নিজের এবং নিজ সন্তানের জীবনের বিনিময়ে তিনি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়ে গেছেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাজনৈতিক জীবন। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য এবং ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের পক্ষে বিরোধী দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ ও ১৯৫৮ সালে তিনি আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কয়েকবার জেল খেটেছেন; বহু অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন; আইনসভায় তুলে ধরেছেন দেশমাতৃকার কল্যাণে সাহসী ও নির্ভীক বক্তব্য।ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনের একটি উজ্জ্বল ও অন্যতম অধ্যায় বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ। তিনিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি দৃপ্তকণ্ঠে গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে সমান মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের সভায় প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। প্রস্তাব উত্থাপনকালে তিনি বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট স্যার, আমার সংশোধনী ২১নং বিধির ১নং উপবিধির ২নং লাইনে ‘ইংরেজি’ শব্দের পরে ‘অথবা বাংলা’ শব্দ দুটি যোগ করা হোক।
… স্যার, এ জন্যই আমি সমগ্র দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পক্ষে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাকে কিছুতেই একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গণ্য করা যাবে না। তাই বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করতে হবে। প্রস্তাবটির ওপর ২৫ ফেব্রুয়ারি আলোচনা হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও কয়েকজন প্রভাবশালী গণপরিষদ সদস্যদের বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে দেয়া হয় এবং তা বাতিল হয়ে যায়।
১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করার জন্য একটি প্রস্তাব আনেন। ৮ এপ্রিল প্রস্তাবটি সংশোধিত হয়ে গৃহীত হয়। সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৫২ সালে একুশের রক্তাক্ত ঘটনার পর পরই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে আসেন।
তখন ছাত্ররা পরিষদে বাংলা ভাষার সপক্ষে কথা বলার জন্য দাবি জানান। অধিবেশনের শুরুতে প্রথমে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও পরে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে তিনিসহ অন্য সদস্যরা অধিবেশন ত্যাগ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে আসেন। তিনি পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনসহ নানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ২৩ মার্চ থেকে তা কার্যকর হয়। সেখানে শর্তসাপেক্ষে বাংলাকে প্রথমে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। পরবর্তীকালে দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে উল্লেখ করেন ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।
সেই থেকে বাংলা ভাষা পেল বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রথম সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সার্থক হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তবে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আইনসভায় বাংলা ভাষার অধিকারের কথা বলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার স্বাপ্নিক পুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চিরঅমর চির অম্লান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকবাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।