১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ নিউইয়র্ক টেলিভিশনে সম্প্রচারিত
ডেভিড ফ্রস্ট : সেই রাতের কথা আপনি বলুন! সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন।
সেই ২৫ মার্চ, রাত ৮টা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেফতার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অপর কোথাও গেলেন না এবং গ্রেফতার বরণ করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? তার কথা বলুন।
শেখ মুজিবর রহমান : হ্যা, সে এক কাহিনী। সেটা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনো, না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম।
আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম : আমি মরি, তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
ফ্রস্ট : আপনি হয়তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব : আমি ইচ্ছা করলে যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল : তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।
ফ্রস্ট : আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এ ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।
শেখ মুজিব : আমি তা বলিনে। কিন্তু একথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল।
আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন, গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল।
বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় রইল না। ওরা সবকিছুই জ্বালিয়ে দিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি।
আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম : প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।
ফ্রস্ট : আপনাকে ওরা ঠিক কীভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১-৩০ ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটল?
শেখ মুজিব : ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।
ফ্রস্ট : ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোন্?খানটাতে ছিলেন?
শেখ মুজিব : এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর। আমি এই শোবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপর এদিক-ওদিক, সবদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়।
ফ্রস্ট : এগুলো সব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছ’বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানি বাহিনী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল?
শেখ মুজিব : সব দিক দিয়ে। ওরা এবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।
ফ্রস্ট : আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?
শেখ মুজিব : না, কোনো শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় সম্বোধন জানিয়েছিলাম। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম : তোমরা গুলি বন্ধ করো। আমি তো এখানে দাঁড়িয়েছি। তোমরা গুলি করছো কেন? কী তোমরা চাও? তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একজন অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বলল : এই! ওকে মেরে ফেল না।
ফ্রস্ট : একটা অফিসারই ওদের থামিয়ে ছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়ে ছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে-পায়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে মারতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। আমি বললাম : তোমরা আমাকে টানছো কেন? আমি তো যাচ্ছি। আমি বললাম : আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা একটু থামল। আমি উপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুটি ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়-চোপড়সহ একটি ছোট সুটকেস দিলেন। তাই নিয়ে আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। আজ এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে ওরা আমায় নিয়ে গেল।
ফ্রস্ট : আপনার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি বাড়ি থেকে সেদিন যখন আপনি বেরিয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনোদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিব : না, আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। আমি ভেবেছি, এই-ই শেষ। কিন্তু আমার মনের কথা ছিল : আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না।
কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।
ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন : যে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পার না। কথাটি কি এমনই ছিল না?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।
আমি একজন মুসলমান এবং মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দু’বার নয়। আমি মানুষ। আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই।
তারা আমাকে ভালোবেসেছে। আমার জন্য তাদের সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সবকিছুকে তাদের জন্য দেয়ার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মজিব : হ্যাঁ, আমার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়-চোপড় সবকিছুই লুণ্ঠিত হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোনোকিছুই আজ নেই।
ফ্রস্ট : আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?
শেখ মুজিব : পাকিস্তানি ফৌজ আমার সবকিছু লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এ বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।
ফ্রস্ট : তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে : কেন ওরা সবকিছু লুণ্ঠন করল?
শেখ মুজিব : এর কী জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর, ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা কেউ রেহাই পেল না।
সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া বাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব, না-খাওয়া মানুষ বসবাস করত এই বস্তিতে। সেগুলোকে ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বস্তিতে আগুন দিয়েছে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে।
আর সেসব মানুষের ওপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হাজারে হাজারে হত্যা করা হয়েছে।
ফ্রস্ট : কী আশ্চর্য! আপনি বলছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বের করে, খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে!
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, এমনিভাবে গুলি করে তাদের হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : কোন্ মানুষকে মারল, তার কোনো পরোয়া করল না?
শেখ মুজিব : না, তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি।
ফ্রস্ট : কেবল হত্যার জন্য হত্যা। যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব : ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।
ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করেছে, তখন আপনার কী মনে হয়? আপনি মনে করেন, মানুষ আসলে ভালো কিংবা মনে করেন, মানুষ আসলেই খারাপ।
শেখ মুজিব : ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে, এমন মানুষও আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের এই ফৌজ : এগুলো মানুষ নয়। এগুলো পশুরও অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র না থাকতে পারে, তা নয়। কিন্তু যে মানুষ, সে পশুর অধম হয় কী প্রকারে?
এই বাহিনী তো পশুরও অধম। কারণ একটা পশু আক্রান্ত হলেই মাত্র আক্রমণ করে। তা নইলে নয়। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসীকে কেবল হত্যা করেনি, দিনের পর দিন বন্দি মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন নির্মম অত্যাচার করেছে, আর হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ মুজিব : ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক অফিসার। বাকি কয়েকজন বেসামরিক অফিসার।
ফ্রস্ট : আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল ওরা?
শেখ মুজিব : অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, পাকিস্তানের সশস্ত্র ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যড়যন্ত্র, আরও কত কী! বারো দফার অভিযোগ। এর ছ’টাতে একেবারে ঝুলিয়ে ফাঁসি!
ফ্রস্ট : আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো উপায় ছিল?
শেখ মুজিব : সরকারের তরফ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোনো দাম নেই, দেখলাম এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র, তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম : জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন।
আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল! ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমোদনের কর্তা তিনি। এই আদালত গঠন করেছেন তিনি।
ফ্রস্ট : তার মানে, তার হাতেই ছিল সব?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।
ফ্রস্ট : তার মানে, আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন?
শেখ মুজিব : তার তো কোনো উপায় ছিল না। আমি তো বন্দি।
ফ্রস্ট : হ্যাঁ, তা তো বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো উপায় ছিল না। ওরা কি বিচার শেষ করে সরকারিভাবে কোনো রায় তৈরি করেছিল?
শেখ মুজিব : ৪ ডিসেম্বর ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক যথা লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার- এদের সব রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠানো রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল আমায় ফাঁসি দেবে।
ফ্রস্ট : আর তাই সেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওরা ওখানেই আপনাকে কবর দেবে?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে।
ফ্রস্ট : আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে, আমি নিজের কাছে নিজে বললাম : ‘আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে! কোনো পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।’
ফ্রস্ট : ওরা কি আপনাকে বলেছিল, এটা তোমার কবর’?
শেখ মুজিব : না, ওরা তা বলেনি।
ফ্রস্ট : কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিব : ওরা বলল : ‘না, না। তোমার কবর নয়। ধরো যদি বম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে শেল্টার নিতে পারবে।’
ফ্রস্ট : সেই সময়ে আপনার মনের চিন্তা কী ছিল? আপনি কি এই সারাটা সময়, ন’মাস, নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন?
শেখ মুজিব : আমি জানতাম, যে কোনো দিন ওরা আমাকে শেষ করে দিতে পারে। কারণ, ওরা অসভ্য, বর্বর।
ফ্রস্ট : এমন অবস্থায় আপনার কেমন করে সময় কাটত? আপনি কি প্রার্থনা করতেন?
শেখ মুজিব : এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি, আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে : ভাইয়ের মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখলেন ওরা কবর খনন করছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা?
শেখ মুজিব : আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখছেন আমাকে তারা কী গভীরভাবে ভালোবাসে।
ফ্রস্ট : হ্যাঁ, একথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, আমার জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ, কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।
ফ্রস্ট : কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন আপনার ভবিতব্য থেকে?
শেখ মুজিব : আমার বিশ্বাস, সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ফ্রস্ট : আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এ কি যথার্থ?
শেখ মুজিব : ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল। মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমার তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার ওপর তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল।
হয়তো বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দু’দিন যাবৎ রক্ষা করল। এ-দু’দিন আমার ওপর কোনো সামরিক পাহারা ছিল না।
দু’দিন পরে এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার, পাঁচ কিংবা ছ’দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ফ্রস্ট : এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তাই ভাবছি!
শেখ মুজিব : আমিও জানিনে। ওদের ওপর কোনো আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থই আমার শুভ কামনা রয়েছে।
ফ্রস্ট : এমনকি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনও নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল: ‘মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেয়া।’
ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, ভুট্টো একথা আমায় বলে তারপরে বলেছিল : ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ফ্রস্ট : ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, বলেছিল।
ফ্রস্ট : কী বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিব : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল : না, আমি তা হতে দিতে পারিনে। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে।
মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সঙ্কটজনক, ভুট্টো একথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর কাছে আমি অবশ্যই এজন্য কৃতজ্ঞ।
ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে, আপনি তাহলে তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিব : ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দি করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কী করবে? আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিব : মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি জানেন আমার বাংলাদেশে কী ঘটেছে। শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সবাইকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। অন্ততপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তার সবকিছুকে ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলোকে ওরা ধ্বংস করেছে।
ফ্রস্ট : নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ, একথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?
শেখ মুজিব : আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনও আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি। সংখ্যা হয়তো একেও ছাড়িয়ে যাবে। ৩০ লাখের কম তো নয়ই।
ফ্রস্ট : কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তো নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে। যে গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়তো কিছু জানত না, সে গ্রামে পাকিস্তানি ফৌজ ঢুকে পাখি মারার মতো গুলি করে এই মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : আমার মনেরও প্রশ্ন : আহা! কেন এমন হল? কেন হল?
শেখ মুজিব : না, আমি জানিনে। আমিও বুঝিনে। এরকমটা পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
ফ্রস্ট : আর এ তো ছিল মুসলমানের হাতেই মুসলমানের হত্যা?
শেখ মুজিব : ওরা নিজেরা নিজেদের মুসলমান বলে। অথচ ওরা হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনও অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পুত্রের সামনে মা-কে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন। আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রোধ করতে পারিনে। এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কীভাবে? এরা তো পশুরও অধম। মনে করুন, আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথমে তার এক হাত কেটেছে। তারপর তার আরেকটি হাত কেটেছে। তারপর তার কানকে কেটেছে।
তার পা কেটেছে। ২৪ দিনব্যাপী চলেছে এমন নির্যাতন (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন)। কিন্তু এ তো একটা কাহিনী। আমাদের কত নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে, জেলখানায় আটক করে সেখান থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ফ্রস্ট : ওরা কী চেয়েছিল?
শেখ মুজিব : ওরা চেয়েছিল আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তো জানেন মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালির পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র- সবাইকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, সারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৫০ জন। ৩০০ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর তারপর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এসব মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : তার মানে, কারফিউ জারি করে খবরাখবর বন্ধ করে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, তাই করেছে।
ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া খান দুর্বল চরিত্রের লোক, যাকে অন্য লোকে খারাপ করেছে, না সে নিজেই একটা দস্তর মতো খারাপ লোক?
শেখ মুজিব : আমি মনে করি ও নিজেই একটা নরাধম। ও একটা সাংঘাতিক লোক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন জনসাধারণের নেতা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময়েই আমি দেখেছি।
ফ্রস্ট : সে আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাই না?
শেখ মুজিব : সে আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে কী করতে যাচ্ছে। তবে আমি আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং আঘাত সে পেয়েছিল।
ফ্রস্ট : কীসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন?
শেখ মুজিব : পাল্টা আঘাত হানতে এবং সেই প্রত্যাঘাত সে পেয়েছিল, এদেশ ছেড়ে গিয়েছিল আমার মানুষজন।
ফ্রস্ট : বন্দি হওয়ার পর আপনি কি ওকে দেখেছিলেন?
শেখ মুজিব : না, না।
ফ্রস্ট : ওর প্রশ্নে ভুট্টোর এখন কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব : আমার মনে হয় ওর পুরো বিচার হওয়া উচিত- প্রকাশ্য বিচার।
ফ্রস্ট : আপনি কি মনে করেন ভুট্টো তা করবে?
শেখ মুজিব : তার করা উচিত।
ফ্রস্ট : ভুট্টো সম্পর্কে এখন আপনার ধারণা কী? আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখন একদিন তিনি মুক্ত ঢাকায় আসবেন? তিনি কি কখনও আলোচনার জন্য এখানে আসবেন?
শেখ মুজিব : আমি জানি না, আমি জানি না। তবে আগে তিনি বর্তমান বাস্তবতা অনুধাবন করুন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড বলে চেঁচিয়ে কোনো লাভ হবে না। এটা তা নয়।
ওরা যদি এক পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকে তবে এটা জানুক যে, আমি হচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আমি দাবি করতে পারতাম আমি হচ্ছি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসক এবং গোটা পাকিস্তান আমার এলাকা।
আমি জাতীয় সংসদের সভা ডেকে গোটা দেশের নাম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি এবং তাদের বলতে পারি পশ্চিম পাকিস্তান হচ্ছে আমার এলাকা। আমি ভুট্টোকে বিদায় নিতে বলতে পারি এবং তাকে জানাতে পারি যে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের গভর্নর আমি নিয়োগ করছি।
আমি তাকে বলত পারি, এটা আমার ভূখণ্ড এবং আপনি বিদায় হোন, নতুবা মিত্রবাহিনীসহ আমি আমার সৈন্য পাঠাব এবং পশ্চিম পাকিস্তান দখল করব। তবে আমি এই গণ্ডগোল চাই না। আমার কোনো ভূখণ্ডের অভিলাষ নেই। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে খুশি থাকুক।
যদি তারা পশ্চিম পাকিস্তান নাম ব্যবহার করতে চায় তারা সেটা করুক। আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। আমি বাংলাদেশে আমার জনগণকে নিয়ে সুখী হতে চাই। আর বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৗম রাষ্ট্র।
‘রুমির আম্মা ও অন্যান্য’ গ্রন্থ থেকে, সরদার ফজলুল করিম অনূদিত