হ্যারি ডব্লিউ ব্লেয়ার
১৯৭১ সালের আগস্টে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার, তাতে জোর দিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে মিলে একটি অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র করেছে, যাতে করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র থেকে পৃথক করে নেয়া যায়।
‘অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল অতি সতর্ক ও যথাযথভাবে- সবকিছুর আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকার আওয়ামী লীগের সদর দফতর থেকে একটি সিগন্যালের ওপর ভিত্তি করে, সশস্ত্র অভিযান শুরু করা যেতে পারে... শুক্রবার ভোরের (২৬ মার্চ) শুরুর কয়েক ঘণ্টাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল সশস্ত্র অভিযানের জিরো আওয়ার হিসেবে।’
শ্বেতপত্রে বলা হয়, এ ‘জিরো আওয়ারের’ মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের বিষয় এটি ছিল যে, আগাম অভিযান চালিয়ে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়া, বিদ্রোহ থামিয়ে দেয়া এবং বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিহত করে দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীকে অ্যাকশনে যাওয়ার আদেশ দেন।
কিন্তু দৃশ্যপট থেকে যেসব রিপোর্ট আসছে সেগুলো ভিন্ন বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়। যখন শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে সরকার গঠন ও সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের বিষয়ে আলোচনা চলছিল, তখন সেটি কাভার করার জন্য ঢাকায় বহুসংখ্যক বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের পাঠানো সংবাদগুলোর মধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য ছিল যে, আওয়ামী লীগ বিদ্রোহ বা বিচ্ছিন্নতার জন্য গুরুপূর্ণ কোনো পরিকল্পনা করতে পারে না।
২৫ মার্চ সন্ধ্যা নামতেই যখন হামলায় অংশ নেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ঢাকা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, শেখ মুজিব তখন নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন মার্চের শুরুর দিকে প্রশাসনিক অচলাবস্থার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাট রফতানি পুনরায় শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করার কাজে। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, সেনাবাহিনী শহরজুড়ে হামলা শুরু করেছে এবং খুঁজে খুঁজে আওয়ামী লীগের সদস্যদের পাকড়াও করছে, তখন তিনি গ্রেফতার হওয়ার জন্য নিজের বাড়িতে শান্তভাবে অপেক্ষা করেছিলেন।
বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ইয়াহিয়া বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে হয় না এবং মার্চ ও এপ্রিলের শুরুর দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিরোধ অবস্থা ছিল, তা-ও এখন আর তেমন অস্তিত্বমান নয়।
কেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সম্ভাব্য সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্য কিছু পরিকল্পনা করে রাখেননি? এ গবেষণা নিবন্ধের প্রতিপাদ্য হল, তারা তেমনটি করেননি, কারণ ১৯৭১ সালের মার্চে আনুক্রমিক যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো প্রায় একইভাবে একই পরম্পরায় ১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে বারবার ঘটে আসছিল।
এ উভয় বছরে প্রদেশজুড়ে নিয়মতান্ত্রিক আমলাতন্ত্র এবং এর কার্যক্রম পুরোপুরি আটকে ছিল এবং গ্রামীণ এলাকাজুড়ে কৃষকের বিদ্রোহের অনেক ঘটনা ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনা ছিল অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত। তখন সমান্তরাল কার্যত একটি সরকার ছিল আওয়ামী লীগের আওতায়, যেখানে আওয়ামী লীগভিত্তিক বিভিন্ন ছাত্র গ্রুপ বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করত, একইসঙ্গে শহরগুলোতে তারা কারফিউ ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সমাবেশ করত।
শেখ মুজিবুর রহমান প্রচুর জনসমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন এবং দেশের পশ্চিম অংশের শাসন থেকে বাঙালি প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তারপরও কিছু দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন নেতা, যিনি নেতৃত্ব দেন, তার চেয়ে বেশি নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তি; ছাত্রদের পক্ষ থেকে তার ওপর চাপ ছিল ইসলামাবাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে তিনি যেমনটি পছন্দ করতেন তার চেয়ে আরও বেশি কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য।
পশ্চিম পাকিস্তানে মুজিবের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশকে জনপ্রিয় শাসনের আওতায় আনার প্রচেষ্টাগুলোকে বয়কটের মধ্য দিয়ে সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করেছেন। এ প্রেক্ষাপটের বিপরীতে সেনাবাহিনী ধীরতার সঙ্গে জরুরিভিত্তিতে বিমানপথ ও নৌপথে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা সংখ্যা ও হামলার শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করে।
উভয় বছরের ঠিক একই দিনে- ২৫ মার্চ অন্তিম পর্যায় উপস্থিত হয়। ১৯৬৯ সালের ঘটনা ছিল সামরিক আইন জারি ও সাময়িকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দেয়া; কিন্তু তার কিছু সময় পর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য নিজের আন্দোলন পুনরায় শুরু করার জন্য শেখ মুজিব সমর্থ হয়েছিলেন।
যখন একই ধরনের ঘটনাবলি পুনরায় দেখা গেল ১৯৭১ সালে, তিনি সম্ভবত ভালোভাবে ভেবেছিলেন যে, সবচেয়ে খারাপ পর্যায় হলেও আরেকবার সামরিক শাসন জারি হতে পারে, যার পরে নতুন করে শুরুর একটি মুহূর্ত আসবে। তার এ ভাবনা ভুল ছিল। সামরিক শাসন জারির পরিবর্তে এবার এলো লাখো মানুষের গলাকাটা, কয়েক লাখ মানুষকে দেশ থেকে বের করে দেয়া এবং প্রদেশকে লুটপাট করার ব্যবস্থা।
উভয় পরিস্থিতির পেছনের কারণগুলো ছিল প্রায় একই; কিন্তু তাৎক্ষণিক আকস্মিক বাস্তবতাগুলো ছিল কিছুটা ভিন্ন। এক দশক ধরে চালানো আইয়ুব খানের কঠোর সামরিক শাসনের চাপা ক্ষোভ রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্রদের টানা দাঙ্গায় শিথিল হয়ে আসে।
ক্যারিশমাটিক জুলফিকার আলী ভুট্টো সমর্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা সব জায়গায় ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ও যোগ দেয় এবং ভুট্টোকে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও বিদ্রোহ প্রদেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং প্রথমত ঢাকায় ও পরে রাজ্যজুড়ে কিছু সাধারণ ধর্মঘটের ঘটনা ঘটে।
ওই সময় আইয়ুব সরকারের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব জেলে ছিলেন; মামলাটি করা হয়েছিল শেখ মুজিব ও অন্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে যে, তারা ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় অংশকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব তার বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ওপর বর্তায়, যিনি অনেক সাধারণ ধর্মঘটের আয়োজন ও প্রচার করেন।
১৯৬৯ সাল শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের উভয় অংশের বিরোধীদলীয় নেতারা মধ্য ডানপন্থী ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন আইয়ুববিরোধী আরও সংঘবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার জন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র গ্রুপগুলো এক জোট হয় একই ধরনের একটি ছাত্র অ্যাকশন গ্রুপ গঠনের লক্ষ্যে।
রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ক্রমাগত চরম পরিস্থিতির দিকে যাওয়া ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে অংশগ্রহণ করে, যা রাজ্যকে কার্যত অচল করে দেয়। পশ্চিম অংশের কর্মকাণ্ডও কমবেশি একইভাবে অগ্রসর হচ্ছিল এবং প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও আইয়ুব খান ১ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন, তিনি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একটি গোলটেবিল আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক যাতে বর্তমান সংকট ও তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ভুট্টোকে ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয় এবং শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে (ওই সময় তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল!) আলোচনায় অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য আইয়ুব খান প্রস্তাব করেন।
ভুট্টো আলোচনায় অংশ নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং কিছুটা ইতস্তত করার পর শেখ মুজিবও তার বিরুদ্ধে চলা মামলা পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিনিয়ত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছিল এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ কারফিউ ভঙ্গ করে শহর প্রদক্ষিণ করে, পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন বড় ধরনের প্রতিরোধ এটিই ছিল প্রথম।
২১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব ঘোষণা করেন, তার চলমান প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ হলে তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াবেন এবং তার পরের দিন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন ও শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন। শেখ মুজিব তখন গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে রাজি হন (যদিও ভুট্টো তখনও রাজি হচ্ছিলেন না), ২৫ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ১০ মার্চ আবারও সেটি শুরু হবে বলে সমাপ্তি টানা হয়।
ঘটনাবলির দ্বিতীয় পরিক্রমায় শেখ মুজিব শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র বন্যার কারণে অক্টোবরে স্থগিত হওয়া জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের জন্য নতুন একটি সংবিধান তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়া পক্ষ জয় লাভ করে।
১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট চলার পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটাধিকার প্রয়োগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করে। দলটি মোট ভোটের ৭২ শতাংশ এবং পূর্ব পাকিস্তান সাধারণ পরিষদের নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্য ১৬৭টি আসন পায়, যা গোটা দেশের মোট ৩১৩ আসনের অর্ধেকেরও বেশি।
ফলাফল দাঁড়াল- জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, যার মধ্য দিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ একেবারে ওলটপালট হয়ে যায়। যখন ইয়াহিয়া জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে রাজি হন, তখন কেউই ভাবেনি যে দেশের পূর্বাংশের সব আসনে আওয়ামী লীগ কার্যত এককভাবে জয়লাভ করতে পারে।
যখনই এটি ঘটল তখন কেবল নিজের দল নিয়েই সরকার গঠন করার ও নিজের সংবিধান লেখার সুযোগ পেলেন শেখ মুজিব। ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৪৪ আসনের (পাঞ্জাবের জন্য বরাদ্দ করা দুই-তৃতীয়াংশসহ) মধ্যে ৮৪টি আসন পেয়ে যদিও পশ্চিম অংশের সবচেয়ে বড় দল, তারপরও দলটির সরকারের বাইরে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হল।
৩ মার্চ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসার তারিখ ঘনিয়ে আসার মাত্র কয়েকদিন আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো নোটিশ দিলেন যে, তার দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করবে।
এমন একটি সংবিধান পাস হবে যেখানে পাঞ্জাবের স্বার্থ উপেক্ষিত থাকতে পারে- এমন পরিস্থিতির মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন।
বাঙালিদের মনোভাব আনন্দ থেকে মুহূর্তের মধ্যে চরম ক্ষোভে রূপ নিল। শেখ মুজিব ধর্মঘটের ঘোষণা দিলেন, যাতে করে কয়েকদিনের জন্য গোটা প্রদেশ একেবারে অচল হয়ে গেল এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক অনেক ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটল।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয় নস্যাৎ করে দেয়া- উভয় ঘটনা একই মূল থেকে উদ্ভূত, সেটি হল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের, বিশেষত পাঞ্জাবের শোষণের বিষয়টি উপলব্ধি করে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ও হতাশা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রথম ২০ বছরজুড়ে বিনিয়োগ ও বাজেটের সম্পদের বিপুল পরিমাণ অংশ পশ্চিমাংশে চলে গেছে- এটি এমন একটি অসমতা যার প্রতিফলন ভিন্নধর্মী প্রবৃদ্ধির হারে দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৮ সালের গ্রীষ্মে প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা যায়, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ১৯৫৯-৬০ সালের ৩৬৬ রুপি থেকে বেড়ে ১৯৬৬-৬৭ সালে ৪৬৩ রুপিতে দাঁড়িয়েছে, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বেলায় সেটি একই সময়ে ২৭৮ রুপি থেকে বেড়ে মাত্র ৩১৩ রুপিতে পৌঁছেছে।
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাস্তবতা হল পশ্চিম অংশের এ বিপুল উন্নয়নের অর্থায়ন করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের পাট রফতানির মাধ্যমে আসা বিদেশি মুদ্রার জোগান থেকে। এরপরও তাদের শোষণের শিকার হওয়ার অনুভূতি হালকা করার জন্য কিছু করা হয়নি।
তার ওপর আমলাতন্ত্রে বাঙালি প্রতিনিধিত্ব খুবই কম থাকা তাদের হতাশার অনুভূতিকে আরও তীব্র করেছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশের দুই অংশের মধ্যে সমতা আনার সরকারি ঘোষণা বারবার দেয়া সত্ত্বেও এলিট সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ এবং আমলাতন্ত্রের অন্যান্য শাখায় একই ধরনের অসমতা বিরাজমান ছিল আর পশ্চিম পাকিস্তানি, বিশেষত পাঞ্জাবিদের দখলে ছিল বেশিরভাগ পদ-পজিশন।
এ প্রেক্ষাপটের বিপরীতে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আওয়ামী লীগের ছয় দফা পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র আবেদন তৈরি করেছিল এবং এ ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই উভয় সময়ে (’৬৯ ও ’৭১-এ) শেখ মুজিব তার প্রচারণার ভিত গড়ে তুলেছিলেন।
উভয় বছর যখন মার্চ মাস শুরু হয় তখন বিভিন্ন ঘটনাবলির ধরনও যেন একের পর একই ধরনের হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে সাধারণ ধর্মঘট গোটা প্রদেশকে একেবারে কর্তৃপক্ষশূন্য করে ফেলেছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, গভর্নর মোনেম খান মার্চ মাসজুড়ে তার অফিসের বাইরে পা ফেলতে পর্যন্ত রাজি হননি এবং তার কর্তৃত্ব অফিসের দরজা অতিক্রম করতে পারেনি।
পুলিশ ও বেসামরিক কর্মচারীরা নিজেদের পদবি থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। এটি ছিল কিছুটা ধর্মঘটের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে এবং কিছুটা আইয়ুব প্রশাসনের পদধারীদের অত্যধিক পীড়াপীড়ির প্রতি অবজ্ঞা ও নাগরিক সমাজের কাছ থেকে নিজেদের অর্থ-সম্পদ রক্ষায়। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ‘জনগণের আদালত’ কর্তৃক সবকিছু সংক্ষেপে বাস্তবায়নের বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
তবে শিগগির এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, গোটা প্রদেশ লাগামহীন জনগণের উন্মত্ত সহিংসতায় ভরে যায়নি। উত্তেজিত অবস্থা প্রকৃতপক্ষে প্রদেশের ৭৮টির বেশি সাবডিভিশনের মধ্যে মাত্র চারটিতে সীমাবদ্ধ ছিল।
বেশিরভাগ অংশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তোফায়েল আহমেদের নির্দেশনায় নিজেদের ৩ লাখসহ আরও অনেক অনুগামী নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম কমিটি শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়। অনেক বেশি প্রচারিত কয়েকটি ঘটনা ছাড়া ছাত্রদের ‘শান্তি কমিটিগুলো’ কৃষকের অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালের ঘটনা পরম্পরায় আমলাতান্ত্রিক কার্যক্রমে অস্থিরতা ছিল আরও বেশি পূর্ণাঙ্গ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিব সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। ধর্মঘটের ঘোষণাটি তিনি কয়েকবার নবায়ন করেন এবং শেষ পর্যায়ে ৭ মার্চ ঢাকায় এক গণসমাবেশে প্রদেশজুড়ে এক সপ্তাহের ধর্মঘটের আহ্বান জানান তিনি।
তার আহ্বানের পক্ষে সামগ্রিক সাড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় পরের দিনই- যখন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি (প্রদেশের সর্বোচ্চ বিচারিক কর্তৃপক্ষ) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ইয়াহিয়ার নিয়োগকৃত গভর্নর টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে অস্বীকৃতি জানান। মাসের বাদবাকি দিনগুলোর জন্য বেসামরিক কর্মচারীরা নিজেদের সরকারি পদবি পর্যন্ত ত্যাগ করেন।
প্রদেশ তখন পরিচালিত হয় আওয়ামী লীগ হেডকোয়ার্টার থেকে ইস্যু করা নির্দেশনার ভিত্তিতে। এ নির্দেশনাগুলো বিস্তৃত ছিল জনগণের স্বাভাবিক কার্যক্রম- স্কুল বন্ধ থেকে শুরু করে কোন কোন ব্যাংক পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ পরিচালনা করতে পারবে- তা পর্যন্ত।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর অভিযোগ করা হতো- বাঙালিরা উভয় নগর ও মফস্বল এলাকাজুড়ে এমন উন্মত্ত ছোটাছুটি করছে, যা ১৯৬৯-এর গণহত্যার স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, অবাঙালি এবং যারা আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অমান্য করেছে তাদের মারধর, লুটপাট ও হত্যা করা হতো লাগামহীন সহিংসতার মধ্যে।
বস্তুত, অবাঙালিদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সহিংসতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার মতো অপরাধ দেখা গেছে ২৫ মার্চের বিপর্যয়কর ঘটনার পর; কিন্তু তার আগে গোটা প্রদেশ ছিল মূলত আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে সমান্তরাল সরকারের আওতায়, যারা যৌক্তিক পর্যায়ে শান্তি বজায় রেখেছিল।
গণআকর্ষক হিসেবে সব জায়গায় শেখ মুজিবের সমান গ্রহণযোগ্যতা ছিল। উপমহাদেশে যেখানে এখনও প্রদীপ্ত রাজনৈতিক বাগ্মিতা বিস্তৃত পর্যায়ে চর্চা করা হয় ও সময় কাটানোর অবলম্বন ধরা হয়, সেখানে এক লাখ লোকের সমাগম অস্বাভাবিক নয়।
বিভিন্নরূপে অনুমান করা হিসাবে ধরা হয় মুজিবের সমাবেশে উপস্থিত লোকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি হতে পারে। এমনকি জনসমাগমের একটি অংশকেও যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতে হয় তার জনপ্রিয়তা ছিল বিশাল।
১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তির পর তিনি দেখলেন, ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কাছ থেকে যে বিপুল সমর্থন তিনি লাভ করেছেন তার মূল্য পরিশোধ করার জন্য আওয়ামী লীগের ছয় দফার সঙ্গে ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের এগারো দফা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
এসব দফার মধ্যে ব্যাংক ও বড় শিল্প জাতীয়করণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেন্টো ও সিয়াটো নিরাপত্তা চুক্তি থেকে সরে আসা ইত্যাদি মধ্যবিত্তবান্ধব শেখ মুজিবকে তাদের আরও কাছে নিয়ে যায়।
গোলটেবিল সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে তার দরকষাকষিতে মুজিব যেন নিজেকে খুঁজে পান অনুসারীদের দ্বারা তৈরি বৃত্তে অবস্থানকারী হিসেবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কেবল তার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে কিছুটা ছাড় দেয়ার শর্তে।
কিন্তু যদি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে হলে ছয় দফার ভিত্তিতে অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন (যেখানে ছয় দফায় কর আদায়ের ওপর প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক বাহিনীর কর রাজস্ব অন্তর্ভুক্ত ছিল) এবং জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সরাসরি নির্বাচিত আইনসভার বিষয়টি সমাধান করতে হতো। আইয়ুব খান এটি মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং শেখ মুজিবকে মধ্য মার্চে খালি হাতে ঢাকা ফিরে আসতে হয়।
অবশ্য কিছু বিষয় ইঙ্গিত দেয় যে, মুজিবের কারাগার থেকে পুরোপুরি মুক্তি ছিল তার কিছু বিষয় মেনে নেয়া বা ছাড় দেয়ার ফল। কিছু সূত্র রিপোর্ট করে যে, প্রথমে তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিলে অংশ নিতে ইচ্ছুক ছিলেন; কিন্তু তার একনিষ্ঠ অনুসারীরা সেটা চাননি।
তারা চেয়েছেন, একেবারে মুক্ত মানুষ হিসেবে তিনি অংশ নিতে পারেন। সে অনুযায়ী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার করা না হলে শেখ মুজিব রাওয়ালপিন্ডিতে যেতে অস্বীকার করেন।
১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন, তখন প্রবলভাবে ধারণা করা হয়েছিল, অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য শেখ মুজিবের অনুসারীরা তার ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন। ঢাকায় ৭ মার্চের পরিকল্পিত গণসমাবেশে স্মরণীয় কিছু ঘটতে যাচ্ছে- এমন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল।
৭ মার্চের সমাবেশের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে মুজিব দ্বিধান্বিত ছিলেন। বিপরীতে তিনি দাবি করেছিলেন, সাধারণ পরিষদ একটি সংবিধান রচনা করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে বরং নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়া নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবেন; নির্বাচন ও সাধারণ পরিষদের জন্য ইয়াহিয়ার উপস্থাপন করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারে এভাবেই সবকিছু নির্দিষ্ট করা ছিল।
পরবর্তী কয়েকদিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন কার্যত আওয়ামী লীগের অধীনে ছিল এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চ উদ্বোধন হতে পারে- শেখ মুজিবের সঙ্গে এমন পরামর্শ করে ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন।
আলোচনা ও সম্মেলনগুলো থেকে পাওয়া ফলাফল আসলে কী, তা নিয়ে দ্বিধা রয়ে গেল। ১৬ মার্চ শুরু হওয়া থেকে ২৫ মার্চ শেষ হওয়া পর্যন্ত আলোচনায় পরিস্থিতির উন্নয়নসংক্রান্ত পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন রিপোর্ট, যথার্থ চুক্তি ও অচলাবস্থা ইত্যাদির উদ্ভব হয়েছে ঢাকা থেকে। মনে হচ্ছিল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারে, তাকে বা তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে ছাড়া জাতীয় পরিষদ- এমন যে কোনো ধরনের প্রজেক্টে সমর্থন দিতে অস্বীকার করে আসছিলেন ভুট্টো।
বিপরীতে মুজিবের অবস্থান ছিল প্রথাগত সংসদীয় প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা বা না করার চেয়ে জাতীয় পরিষদে তার অধিকার আদায় করা, কারণ তিনি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিলেন। সম্ভবত সমঝোতার অংশ হিসেবে মুজিব একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন যা ইয়াহিয়া পরে বর্ণনা করেছেন।
বিষয়টি ছিল এমন যে, সামরিক শাসন তুলে নেয়া হবে, প্রাদেশিক সরকারগুলো গঠন করা হবে এবং প্রাথমিকভাবে জাতীয় পরিষদ দুটি কমিটি আকারে বসতে পারে- একটি গঠিত হবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে আর অন্যটি গঠিত হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে।
তারপর দুই প্রাদেশিক কমিটি যখন তাদের সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করবে, তখন তারা গোটা দেশের জন্য একটি সংবিধানের ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করার জন্য জাতীয় পরিষদ হিসেবে মিলিত হবে। দুজনই (মুজিব ও ইয়াহিয়া) সম্ভবত এক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে একমত হয়েছিলেন; কিন্তু ২১ মার্চ ঢাকায় পৌঁছানো ভুট্টো এতে তীব্র আপত্তি করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন যে, প্রস্তাবটি পরিবর্তন করতে হবে যাতে করে এটি নিশ্চিত করা যায়- কোনো আইন বা সংবিধান ততক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদে উত্থাপন করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা দুই কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে পাস হয়।
এর মধ্য দিয়ে মূলত তার জন্য, পাঞ্জাবের জন্য ও বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টে তীব্র সংকোচনের মুখে পড়তে যাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যয়ের অর্ধেক ভোগকারী সামরিক বাজেট রক্ষায় নিজ হাতে একটি ভেটো ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন ভুট্টো।
শেখ মুজিব দাবি ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং তার সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অবিলম্বে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য চাপাচাপি করছিলেন; কিন্তু তিনি সম্ভবত তাদের কাছে নতি স্বীকার করেননি। প্রতিদিনই ঢাকা ও প্রদেশজুড়ে লাখো ছাত্র ও শ্রমিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং ২৩ মার্চ বার্ষিক ‘পাকিস্তান দিবস’ উদযাপন অনুষ্ঠান পুরোপুরি বাংলাদেশ স্বাধীনতা দিবসে রূপ নেয়।
মুজিবের বাড়িসহ গোটা ঢাকা বাংলাদেশের পতাকায় ছেয়ে যায় এবং প্রতিবাদকারীরা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে ফেলে। অবশ্যই এটি কষ্টকর ছিল যে, এ পর্যায়ে এসে স্বায়ত্তশাসনের বাংলাদেশি প্রত্যাশাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভেটো ক্ষমতার কাছে সমর্পণ করা হবে।
দুই বছরেরই মার্চ মাসজুড়ে অটল পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়মিত দায়িত্বে থাকা ছোট সেনা কন্টিনজেন্টকে শক্তিশালী করার জন্য নৌ ও আকাশপথে নিয়মিত সেনা নিয়ে আসা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে সংকট শুরুর সময় কেবল সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশন সেনা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে; কিন্তু যতই মাস গড়াতে থাকে ততই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সি-১৮০ পরিবহন বিমান বাড়তি সেনা বয়ে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে।
বিভিন্ন খবরে জানা যায়, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স ভারতের আকাশপথ ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলোতে করে বেসামরিক পোশাকে সেনাদের পূর্ব পাকিস্তানে উড়িয়ে নিয়ে আসে। এর পাশাপাশি অনেক সামুদ্রিক জাহাজে সেনা ও সরঞ্জাম বোঝাই করে ভারতে পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ পথে নিয়ে আসা হয় পূর্বাংশের ইউনিটগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য।
১৯৭১ সালে আবারও পূর্ব পাকিস্তানে সংকট গাঢ় হতে শুরু করলে সেই ১৪তম ডিভিশন তৎপর হয়, যদিও এ পর্যায়ে এসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা এনে শক্তি বাড়ানো কঠিনই ছিল। ২০ জানুয়ারি কিছু অপহরণকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কর্পোরেশনের একটি প্লেন অপহরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং অবতরণের পর এটিকে ধ্বংস করে দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে পাকিস্তানের সব ফ্লাইটের জন্য ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেয় ভারত সরকার, যা মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকে।
ফলে পাকিস্তানকে তার সেনা পূর্বাংশে আনার জন্য ক্যাপ কমোরিন পাড়ি দিতে হয়। তারপরও বহু বিমান ও জাহাজ ভরে সেনা তারা নিয়ে এসেছে, এবারও বহুসংখ্যক সেনা আনা হয়েছে বেসামরিক ফ্লাইটে।
১৯৭১ সালের মার্চের শুরু ও মাঝের দিনগুলো পর্যন্ত সবকিছু প্রায় একই রকমের হয়ে ধরা দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে; যেমনটি ঘটেছিল দুই বছর আগে। তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের হিসেবে, সামরিক আইন জারি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা, এমনকি ছাত্র ও শ্রমিকদের প্রতিবাদ মিছিলের ওপর অল্প পরিমাণে গুলিবর্ষণ পূর্ব পাকিস্তানে চলমান রাজনীতির মানদণ্ড হয়ে পড়েছিল। সর্বোপরি সবকিছু সাময়িক সময়ের বিবেচনায় করা হচ্ছিল।
ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ার পর স্বায়ত্তশাসনের দাবির আন্দোলন চালিয়ে যেতে আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট সময় থাকতে পারে। যে কোনো বিবেচনায় নির্বাচন দেখিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ছিল বাঙালি জনগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আকাঙ্ক্ষা, এটি এমন একটি আকাঙ্ক্ষা যা অবশ্যই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। এসব কারণে স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে সেনাবাহিনী আরও বেশি কিছু করতে চাইলে কী করতে হবে, সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি।
কিন্তু পুনরায় মার্শাল ল’ বা সামরিক শাসন জারি না হয়ে বিপরীতে চলে এল এক মহাযুদ্ধ। কার্ল মার্কসের পর্যবেক্ষণ- হেগেল বলেন, যে কোনোভাবেই বিশ্ব ইতিহাসের সব সত্য ঘটনা ও মহাগুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তির আবির্ভাব দু’বার ঘটে। এমনটিই হয়ে আসছে।
তিনি বলতে ভুলে গেছেন যে, প্রথমবার ঘটে ট্র্যাজেডি হিসেবে, আর দ্বিতীয়বার ঘটে প্রহসন হিসেবে। মার্কসও সম্ভবত ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। সম্ভবত তার বলা উচিত ছিল- ‘প্রথমবার ট্র্যাজেডি হিসেবে, দ্বিতীয়বার বিপর্যয় হিসেবে’।
১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুম্বাই থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’তে বিশেষ নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম
হ্যারি ডব্লিউ ব্লেয়ার : মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
১৯৭১ সালের আগস্টে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার, তাতে জোর দিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে মিলে একটি অস্থিরতা তৈরির ষড়যন্ত্র করেছে যাতে করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র থেকে পৃথক করে নেয়া যায়; কিন্তু দৃশ্যপট থেকে যেসব রিপোর্ট আসছে সেগুলো ভিন্ন বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
বল প্রয়োগের মাধ্যমে ইয়াহিয়া বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি আকস্মিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে হয় না এবং মার্চ ও এপ্রিলের শুরুর দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিরোধ অবস্থা ছিল, তা-ও এখন আর তেমন অস্তিত্বমান নয়।
কেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সম্ভাব্য সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্য কিছু পরিকল্পনা করে রাখেনি? এ গবেষণা নিবন্ধের প্রতিপাদ্য হল, তারা তেমনটি করেননি; কারণ ১৯৭১ সালের মার্চে আনুক্রমিক যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো প্রায় একইভাবে একই পরম্পরায় ১৯৬৯ সালের মার্চ থেকে বারবার ঘটে আসছিল।
১৯৭১ সালের মার্চের শুরু ও মাঝের দিনগুলো পর্যন্ত সবকিছু প্রায় একই রকমের হয়ে ধরা দিয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে, যেমনটি ঘটেছিল দুই বছর আগে। নিকট-ভবিষ্যতের বিবেচনায় সামরিক আইন জারি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা, এমনকি ছাত্র ও শ্রমিকদের প্রতিবাদ মিছিলের ওপর অল্প পরিমাণে গুলিবর্ষণ পূর্ব পাকিস্তানে চলমান রাজনীতির মানদণ্ড হয়ে পড়েছিল। সর্বোপরি সবকিছু সাময়িক সময়ের বিবেচনায় করা হচ্ছিল।
ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ার পর স্বায়ত্তশাসনের দাবির আন্দোলন চালিয়ে যেতে আওয়ামী লীগের জন্য যথেষ্ট সময় থাকতে পারে। যে কোনো বিবেচনায় নির্বাচন দেখিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ছিল বাঙালি জনগণের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আকাঙ্ক্ষা, এটি এমন একটি আকাঙ্ক্ষা যা অবশ্যই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।
এসব কারণে স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে সেনাবাহিনী আরও বেশি কিছু করতে চাইলে কী করতে হবে, সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। কিন্তু পুনরায় মার্শাল ল’ জারি না হয়ে বিপরীতে চলে এল এক মহাযুদ্ধ।