হুমায়ুন কবীর
দীর্ঘ নয় মাস মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে নিজেকে তুলে ধরার প্রয়াস পাই। বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়াটি এমন একটি আন্তর্জাতিক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে আবদ্ধ ছিল, যেখান থেকে বের হয়ে আসাটাই ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য কোনদিকে যাবে। আমরা যদি লক্ষ করি, এর মধ্যে দু-তিনটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হচ্ছে, আমরা একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য এবং জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশের সব মানুষের যে আর্তি সে আর্তিকে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে তুলে ধরা। যেটাকে Driver of our
foreign policy formulation বলা যায়। দ্বিতীয়টি হল, ওই সময়টিতে দক্ষিণ এশিয়া একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধটি অনেকটা ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে গিয়ে মিশে গিয়েছিল। আর এ কারণে ভারতীয়রা তখন আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধটিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মনে করে। পাকিস্তানিরাও এটিকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মনে করে এবং তারা এটিও মনে করে, ভারতের ষড়যন্ত্রের কারণেই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে; কিন্তু কেউই তখনকার বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য যে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব পেশা-শ্রেণি- বর্ণের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ এবং আত্মোৎসর্গ করার মাধ্যমে একটি জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর মতো প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল- সেই ন্যারেটিভটি খুব একটা প্রকাশিত হয়নি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহলে স্বাধীন জাতি হিসেবে একটি স্বপ্ন, একটি প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য আমরা যে সংগ্রাম করছি এ ন্যারেটিভটি বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করাটা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ওই সময় ভারত-পাকিস্তান ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে আমাদের স্বকীয়তা প্রমাণ করাটা ছিল চ্যালেঞ্জ। এটিও একটি ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমরা সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছি, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি, রাজনৈতিক অবস্থাও যে খুব শক্তিশালী তা-ও নয়, স্বাধীনতার উষালগ্নে এমন একটি পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান ন্যারেটিভের বাইরে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে নিজেকে বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করার পথটি বেশ কঠিনই ছিল।
তৃতীয় বিষয়টি ছিল, ৭০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের মতামতকে রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা কী চাই। আমাদের এ চাওয়াটাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করার তেমন কোনো সুযোগ আমরা পাইনি; কারণ তখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার যে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল সেই খাদের মধ্যেই আমরা আটকে গিয়েছিলাম। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত, অন্যদিকে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান। ফলে বিশ্ব ছিল দুই ভাগে বিভাজিত। এ বিভাজিত বিশ্বে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কাজ করাটা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একপক্ষ মনে করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীতিতে থাকা বাঞ্ছনীয়, অন্যপক্ষ মনে করেছে, ভারত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছে এটি মেনে নেওয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে আমরা যে স্বাধীন জাতি হিসেবে নিজেকে বিশ্বে তুলে ধরতে চাই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। ওইসময় এ সমর্থনটি আমাদের নিজেদের পথ খুঁজে পাওয়ার আরেকটি বড় ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি আমাদের সামনে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। প্রথম পররাষ্ট্রনীতি ছিল, স্বাধীন জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের কূটনীতিক স্বীকৃতি আদায়।
৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, ২ লাখ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে, কোটি কোটি মানুষ তাদের ভিটেমাটি হারিয়েছে- এ বাস্তবতাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। কূটনৈতিক স্বীকৃতির মাধ্যমেই আমরা সেটি অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এ কাজটি করা। অনেক বন্ধু রাষ্ট্র আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে; কিন্তু আমি যে সত্যি সত্যি স্বাধীন সেটি প্রমাণ করা এবং যারা আমাদের স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছিল না, তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করাটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। কারণ বাংলাদেশবিরোধী অনেক রাষ্ট্রই তখন প্রশ্ন তুলেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রেখে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় কীভাবে? এ স্বাধীনতা আমরা মানি না। সুতরাং দেশে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশ যে স্বাধীন বাস্তব অর্থে সেটি প্রমাণ করা যাচ্ছিল না। ভারত আমাদের মিত্রশক্তি। স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করেছে, রক্ত দিয়েছে। আমাদের দিক থেকে তো সেটি ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবে। তারপরও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বলাটা একটি বলিষ্ঠতা। বন্ধুর সঙ্গেও যে কূটনীতির প্রয়োজন আছে, বন্ধুর সঙ্গেও যে আত্মসম্মান প্রদর্শনের একটি জায়গা আছে, বঙ্গবন্ধু সেটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তখন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করাটা ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। এটি ছিল অসাধারণ একটি পররাষ্ট্রনীতির কাজ। তিনি সফলভাবে বলিষ্ঠতার সঙ্গে নিজের দেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী প্রত্যাহারের কাজটি করে দেখিয়েছেন। ১৯৭২ সালে মার্চ মাস আসার আগেই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তার আগেই ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের এখান থেকে চলে যায়। কাজেই বন্ধুর সঙ্গেও আত্মসম্মানকে উঁচু জায়গায় রেখে বন্ধুত্ব রক্ষা করা যায় এবং সম্মানজনকভাবে সম্পর্ক রাখা যায়, নিজের অবস্থানটাকে শক্তিশালীভাবে ধরে রাখা যায়, বঙ্গবন্ধু সেটি করে দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এ বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশকে একটা স্বকীয়তা দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন চালিয়ে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যার ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ আমাদের সমর্থন দিয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থার সদস্য পদও লাভ করেছি; কিন্তু তারপরও একটি অপূর্ণতা আমাদের থেকেই গেল। আর সেটি হচ্ছে বিশ্ব কূটনীতির পাদপীঠ জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জন করা। কারণ জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে চীন ভেটো দিয়েছে যেন আমরা সদস্যপদ লাভ করতে না পারি। চীনের বক্তব্য ছিল, তোমরা এখনও স্বাধীন হওনি, তোমরা এখনও ভারতের নিয়ন্ত্রণে আছো বা সোভিয়েত বলয়ের আবর্তে আছো। তাই তোমাদের যথেষ্ট স্বাধীন বলে মনে হয় না; তাই তোমরা জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারনি। তাদের এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেক বন্ধুরাও ছিল, বিশেষ করে আরব অঞ্চলের কিছু রাষ্ট্র ছিল যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভেটো দিয়েছে। সেসময় এটাই ছিল আমাদের বড় স্ট্রাগল। আমরা জাতিসংঘের সদস্যপদ কীভাবে পাব তার জন্য বঙ্গবন্ধু বিভিন্নভাবে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলেন। যেহেতু সে সময়টিতে বিশ্ব ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। এ বিভাজিত পৃথিবীতে নিজের জন্য একটি স্পেস তৈরি করা এবং সেই স্পেস একটি সম্মানজনক স্থানে দাঁড় করানোর কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হয়েছি, কেউ আমাদের স্বাধীন করে দেয়নি। তাই আমাদের আত্মসম্মানের একটি বড় জায়গা রয়েছে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা সে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হই। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গিয়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জন করে। এ অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বে অন্য যারা নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী জাতি রয়েছে তাদের আমরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানালাম। একদিকে নির্যাতিত সমগ্র সংগ্রামী স্বাধীনতাকামী মানুষের সমর্থন জানালাম, অপরদিকে আমরা কোনো পক্ষ অবলম্বন করব না, সেটিও বিশ্বের কাছে তুলে ধরলাম। যার মাধ্যমে আমরা পরবর্র্তী সময়ে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের ছত্রছায়ায় নিজেকে যুক্ত করার প্রয়াস পেলাম।
সবই তো হল; কিন্তু আমাদের বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে একটি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণতার সঙ্গে সে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে সে কর্ম প্রয়াসটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রেক্ষাপটেই বঙ্গবন্ধু এ পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন। তখন ভারতের সঙ্গে সবেমাত্র আমরা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছি এবং সেটি একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আছে। তাছাড়া ভারত যে পাকিস্তানের কাছে যাওয়াটা পছন্দ করে না এটি জানার পরও বঙ্গবন্ধু সে বলিষ্ঠতা দেখিয়েছেন। বন্ধুর সঙ্গেও আমার আত্মসম্মানের জায়গাটা ধরে রাখার একটি বিষয় আছে। বন্ধুর সঙ্গেও আমার একটি স্পেস রাখতে হবে নিজের স্বকীয়তাকে ধরে রাখার জন্য- বঙ্গবন্ধু সেটি করে দেখিয়েছেন। যার ফলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া আমরা সফলভাবে করতে পেরেছিলাম। একদিকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, অপরদিকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের দিকে বঙ্গবন্ধু ঝুঁকে ছিলেন এ কারণেই। তখন বাংলাদেশ ৮৫ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। পাকিস্তান আমার সঙ্গে অপকর্ম করেছে বলে সারা বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্র খারাপ তা তো নয়। কাজেই আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশাটাকে ধারণ করে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ করতে সচেষ্ট হলাম। বঙ্গবন্ধু এ ক্ষেত্রে ভারতকে পাশে রেখে একটি সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন বলতেই হবে। এখন হয়তো মনে হতে পারে এটি সামান্য ব্যাপার; কিন্তু তখনকার সময়ে এটি ছিল একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। একটি শান্তিপূর্ণ জাতি হিসেবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি তিনি করে দেখিয়েছেন। এখন অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে অনেক চুক্তি করেছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি হয়েছিল; কিন্তু সামগ্রিক অর্থেই যদি বলি তাহলে বলতে হয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেটিকে কম্পেন্সেট করার জন্য যে পাল্টা উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন সেটি তিনি নিয়েছিলেন। চূড়ান্ত বিবেচনায় বলব, একটি আত্মসম্মানসম্পন্ন স্বাধীন চেতনা এবং আমাদের প্রয়োজনের নিরিখে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক যে পর্যায়ে রাখার দরকার ছিল তিনি সে পর্যায়েই রেখেছিলেন। তার সে পথ ধরেই আমরা মোটামুটি চলছি। সব দেশের সঙ্গেই আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছি। আমরা এমন একটি ভৌগোলিক অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমাদের নিরাপত্তা, কূটনীতি, উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ সবই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই সে ক্ষেত্রে সব বিষয়কে সমন্বিতভাবে মাথায় রেখেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে হবে এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
মার্কিন এবং সোভিয়েত বিভাজনে বঙ্গবন্ধু কোন দিকে ঝুঁকছিলেন এটি একটি প্রশ্ন এসে যায়। তো আমি একে ঝোঁকা বলব না, যেহেতু জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোভিয়েত এবং ইন্দো- সোভিয়েত লবি শক্ত-সমর্থন দিয়েছে, তাই তখনকার প্রয়োজনের নিরিখেই প্রাথমিকভাবে আমরা এ লবিরই অংশ হিসেবে ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে শান্তিচুক্তি যেটি হয়েছে, সেটি ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ের সঙ্গে ভারতের যে শান্তিচুক্তি হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে ধরতে পারি। কাজেই আমরা প্রাথমিক অবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে টিকে থাকার জন্য ইন্দো-সোভিয়েত এক্সিসের পক্ষেই ছিলাম। ইন্দো-সোভিয়েত এক্সিস আমাদের সমর্থন দিয়েছে এবং সহযোগিতা করেছে; যেমন- সোভিয়েত চট্টগ্রাম বন্দর চালু করার জন্য অনেক ডুবো জাহাজ সেখান থেকে সরিয়ে বন্দর চালু করে দেয় এবং আমাদের ইনফ্রাকচার সাপোর্ট করে। বিধ্বস্ত সেতু-রাস্তাঘাট-পুল স্থাপনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এগুলো হয়ে যাওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে আসল যে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় কে আমাদের সঙ্গী হবে। কারণ আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। এ জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাকে কার সঙ্গে যেতে হবে এবং কার সঙ্গে গেলে আমরা আমাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারব- সেটি মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। ভারত-সোভিয়েত এক্সিসের মধ্যে এ ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি সমর্থন পাচ্ছিলাম না, অর্থ সাহায্য পাচ্ছিলাম না। আর সেসময় একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করলেন। সেসময় এটি খুবই প্রয়োজন ছিল। পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে এবং তাদের যে সাহায্য-সহযোগিতা দরকার; যেমন- খাদ্য সাহায্য, প্রকল্প সাহায্য, আর্থিক সাহায্য যাই বলা হোক না কেন, সেটি সুনিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ফোর্ডের সঙ্গে মিটিং করেন। এর পরপরই আমরা সত্যি সত্যি একটি জোট নিরপেক্ষ ছত্রছায়ায় পৌঁছে গেছি। আমরা কোনো একপক্ষকে অন্যপক্ষের বিপক্ষে ব্যবহার করার নীতিতে বিশ্বাস করি না সেটি বিশ্বকে জানিয়ে দিলাম। সমদূরত্ব বজায় রেখে আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সেটিকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবার সঙ্গেই আমরা কাজ করে গেছি। একটি ব্যালেন্স করে চলেছি। কারণ আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, অর্থনৈতিক প্রয়োজনের কারণে এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। এ ছাড়া আমাদের খুব একটি অলটারনেটিভ ছিল না। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই বিষয়টি দেখিয়ে গেছেন, শিখিয়ে গেছেন। তিনি যে কৌশল নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে করেছেন সেটি মনে রেখে বর্তমান বাস্তবতার আলোকে সেগুলোকে প্রয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমান বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ শক্তি-সামর্থ্য আছে, মানবসম্পদ রয়েছে, অর্থনৈতিক বিকাশ আছে এবং আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে যেটুকু সুনাম অর্জন করেছি তাতে করে বঙ্গবন্ধুর এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে বাস্তবতার আলোকে যদি এগিয়ে যাই, আমার ধারণা আমরা আরও বেশি ইতিবাচকভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।
হুমায়ুন কবীর : সাবেক কূটনীতিক, বাংলাদেশ সরকার