মোনায়েম সরকার
মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই অত্যন্ত প্রিয়। মানুষমাত্রই মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। যে ভাষায় মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশিত হয়, আবেগ-অনুরাগ ব্যক্ত হয়, দ্রোহে-সংগ্রামে মানুষ যে ভাষার স্লোগান মুখে নিয়ে রাজপথের মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে ভাষা মানুষ ভালো না বেসে পারে না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষাও। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের মাতৃভাষা, একই সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা নয়, মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যারা পায় নিঃসন্দেহে সে জাতি ভাগ্যবান জাতি, সেই বিচারে বাঙালি সৌভাগ্যবান। কেননা বাঙালির ‘মাতৃভাষা’ আর ‘রাষ্ট্রভাষা’ দুটোই ‘বাংলা’।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিকে বুকের তাজা রক্ত দিতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে বাংলা ভূখণ্ড ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে নীলনকশা আঁকা হয়, তার রক্তাক্ত সমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন বাংলা মায়ের বেশ কয়েকজন ভাষাসৈনিক শহীদ হন।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে যারা সেদিন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে যার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ মুজিবুর রহমান একজন সংগ্রামী ভাষাসৈনিক ছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের আন্দোলনে শেখ মুজিবের অনন্য ভূমিকা ছিল। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটি পাঠ করি, তাহলে এ কথার সত্যতা দেখতে পাই। ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হয়েও জেলখানা থেকে কীভাবে শেখ মুজিব বাইরের নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থ লিখতে গিয়ে (বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত) আমি অনেক তথ্য পেয়েছি। সেসব তথ্য স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দেয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বাংলা ঠিকই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। তবে সেই স্বীকৃতি আদায় করতে বিভিন্ন বয়সের ও শ্রেণী-পেশার বেশ কয়েকজন ভাষাপ্রেমী মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। যা বাঙালির জন্য অত্যন্ত বেদনার আবার অহংকারের বিষয়ও।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলেও বাংলাকে অবহেলা করার মনোবৃত্তি পাকিস্তানিরা চিরদিনই লালন করেছে। ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবির মধ্য দিয়েই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী দিনের কার্যসূচি তখন তিনটি ভাষা যথা—বাংলা, উর্দু ও ইংরেজিতে মুদ্রিত হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তানিরা দিনের কর্মসূচি উর্দু আর ইংরেজিতে প্রকাশ করে। এটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু উচ্চকণ্ঠ হন এবং তিনি সংসদে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হন যে পাকিস্তানিরা ইচ্ছা করেই বাংলা ভাষার সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করার আগে বঙ্গবন্ধু যত ভাষণ-বিবৃতি প্রদান করেছেন, সেসব ভাষণ-বিবৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তার জোরালো অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও তিনি বাঙালির ‘সাংস্কৃতিক’ মুক্তির কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, শুধু রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক মুক্তি হলেই একটি দেশ উন্নত হতে পারে না, এজন্য প্রয়োজন ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি’। আর সাংস্কৃতিক মুক্তি তখনই ত্বরান্বিত হয়, যখন ‘ভাষা’ সগৌরবে সর্বস্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস হিসেবে ১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্টে দেয়া ভাষণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু বিচারকদের উদ্দেশ্যে সেদিন এ কথাই বলতে চেয়েছেন যে মাতৃভাষা বাংলায়ই বিচারকদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। হয়তো তাত্ক্ষণিকভাবে আমাদের কিছুটা সমস্যা হবে বাংলা ভাষায় বিচারকাজ পরিচালনা করা, কিন্তু নিয়মিত পরিচর্যা করলে বাংলা ভাষায়ই একদিন সুষ্ঠুভাবে বিচারিক কাজ সমাধা করা যাবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বঙ্গবন্ধু নিজে দাপ্তরিক নথিতে বাংলায় নোট লিখতেন এবং বাংলায় স্বাক্ষর করতেন।
ভাষার সমস্যা ও সে সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। তিনি জানতেন, ব্যবহারের মাধ্যমেই ভাষা ক্রমে ক্রমে সবল হয়ে ওঠে। কোনো ভাষাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, ব্যবহারের ফলেই ধীরে ধীরে ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষাও সর্বস্তরে প্রচলিত করতে হলে আমাদের সে পথেই এগিয়ে যেতে হবে।
আজকের বাংলাদেশে এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরই নিয়েছিলেন, সে পদক্ষেপ স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও কেন বাস্তবায়ন করা গেল না, এ ইতিহাস লিখতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে। এখানে সে বিষয়ে দৃষ্টিপাত না করে শুধু এটুকু বললেই বোধহয় কাজ হবে যে বঙ্গবন্ধু বাংলা ও বাঙালিকে যে উচ্চাসনে দেখতে চেয়েছিলেন, তার অবর্তমানে কেউই সেভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন করেনি।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি একদিনেই বঙ্গবন্ধুর মননে গেঁথে যায়নি। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যই তাকে এ কাজে প্রেরণা জুগিয়েছে। যে ভাষায় কবি গীতাঞ্জলি কাব্য লিখে ১৯১৩ সালেই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যে ভাষার কবির অমর পঙিক্তমালা বঙ্গবন্ধু সুযোগ পেলেই আবৃত্তি করতেন, ভাষণ-বিবৃতিতে ব্যবহার করেছেন, সে ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগ থাকা অসম্ভব কিছু নয়।
বিশ্ববাসীর সামনে তিনবার বাংলা ভাষা মর্যাদার আসনে আসীন হয়। প্রথমবার ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে, দ্বিতীয়বার ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণদানের মাধ্যমে, তৃতীয়বার ১৯৯৯ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রাপ্তির মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে উদ্বোধকের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেন, তাতেও বাংলা ভাষার মহিমা প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা ভাষার বিকাশে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে যাদের নাম বলতে হয় তারা হলেন উইলিয়াম কেরি, রাম রাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। উপরিউক্তদের পরেও আরো অনেকে বাংলা ভাষার উত্কর্ষ সাধনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ব্যক্তি উদ্যোগে ভাষার কখনই পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভব নয়, যদি সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকে। বঙ্গবন্ধুই বাংলা ভাষাকে প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ভাষা হোক, এজন্য যা কিছু করণীয় সেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বঙ্গবন্ধু কখনই পিছপা হননি। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। বাংলার মর্যাদা বৃদ্ধিতে তিনি শুধু আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি, দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণীর মানুষের কাছেই তিনি আবেদন করেছেন বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধিতে এগিয়ে আসতে। আজ বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের পাশাপাশি মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর অন্যতম সংগ্রামী রাজনৈতিক নেতা। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ শুধু স্বাধীনতাই অর্জন করেনি, বাংলা ভাষাও সম্মানিত হয়েছিল। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি তিনি যে মমত্ব ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন, তা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে প্রত্যেকটি বাঙালি সাধ্যমতো আত্মনিয়োগ করুক—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শুভ মুহূর্তে এটাই আমাদের অঙ্গীকার হোক।
মোনায়েম সরকার: রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ