এম আর মাহবুব
ভাষা আন্দোলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। আজন্ম মাতৃভাষাপ্রেমী এ মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব এবং পরবর্তী সময়ে আইনসভার সদস্য হিসেবে ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে গেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের দাবির কথা বলে গেছেন। অদ্যাবধি ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বইপত্রে অনেক তথ্যকে বাদ দেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে দেখা হয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে আলোচ্য প্রবন্ধে সংক্ষিপ্ত আকারে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যথাযথ ভূমিকা উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের সত্যতা প্রমাণিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হলেন। এ সময় নবগঠিত দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তত্কালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করলেন। ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক বলেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল। (সূত্র: ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গাজীউল হক, ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে তত্কালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনসংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম জীবনীকার অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান এই মজলিসকে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বহু কাজে সাহায্য ও সমর্থন করেন’ (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, কৃত মযহারুল ইসলাম: ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩: পৃ. ১০৪)। তিনি ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্বদান করেন।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ঐতিহাসিক এ ইশতেহার একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এ ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার মাসের মধ্যেই পুস্তিকাটির প্রকাশনা ও প্রচার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামের স্বপ্ন সম্পৃক্ত মোহভঙ্গের সূচনার প্রমাণ বহন করে। পুস্তিকাটি যাদের নামে প্রচারিত হয়েছিল, তারা সবাই অতীতে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। উল্লেখ্য, এদেরই একজন ছিলেন ফরিদপুরের (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) শেখ মুজিবুর রহমান; পরবর্তীকালে যিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন (বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন: রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার ঐতিহাসিক দলিল, শায়খুল বারী, পুনঃপ্রকাশ জানয়ারি ২০০২)।
১৫০ নং মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলন কেন্দ্র। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিক জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষের কর্মী বাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়েত হতো এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা এখানেই নেয়া হতো। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতারা ছিলেন এ ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। বাহাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলীবিরোধী রাজনীতির সূতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলীতেই জমায়েত হন।’ (সূত্র: ১৫০ মোগলটুলী—বাহাউদ্দীন চৌধুরী, জনকণ্ঠ ঈদসংখ্যা-২০০৮)। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিসপ্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। ২৬ ফেরুয়ারি ধর্মঘটে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে ড. মযহারুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন।’ (সূত্র: ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯-২০) সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সঙ্গেও আন্দোলনে শরিক হন এবং যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এ দেশের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলের এ সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদের প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠানের দুজন করে প্রতিনিধি দান করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এ সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এ হরতালে শেখ সাহেব নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। ভাষাসৈনিক অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার নিমিত্তে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ হতে ১০ মার্চ ঢাকায় আসেন।’ ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচিতে যুবক শেখ মুজিব এতটাই উৎসাহিত হয়েছিলেন যে এ হরতাল ও কর্মসূচি তার জীবনের গতিধারা নতুনভাবে প্রবাহিত করে। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তার প্রথম গ্রেপ্তার।’
১১ মার্চের হরতাল সফল করতে ১ মার্চ ১৯৪৮-এ প্রচারমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম (তমদ্দুন মজলিস সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য), নঈমুদ্দীন আহমদ (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক) ও আবদুর রহমান চৌধুরী (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা) জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিবৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। ১১ মার্চের গ্রেফতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ১১ মার্চের গুরুত্ব এবং গ্রেফতার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।’ ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেয়া হয়, অনুমোদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ সাহেবও চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এ ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ সাহবেসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এ ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতাকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করে। এতে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় বেশকিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘এমএলএদের বিরুদ্ধে মোটামুটিভাবে বিক্ষোভ হয়। তাদের গালাগালি ও অনেকক্ষেত্রে মারধর করা হয়। মোয়াজ্জেম ডাক্তার নামে বাগেরহাটের এক এমএলএকে ধরে নিয়ে মুসলিম হলে ছাত্ররা আটক করেছি। সেখানে গিয়ে আমি তাঁকে ছাড়াই। শওকত সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বেশ আঘাত পায় পুলিশের হাতে” (সূত্র: ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ—কতিপয় দলিল, ২য় খণ্ড, কৃত বদরুদ্দীন উমর: ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫: পৃ. ৩২৫)
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। (দেখুন: জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫ অলি আহাদ)। “১৭ তারিখ এ দেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ঐ দিনের ধর্মঘট অপভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয়সম্পন্ন এবং অসম সাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্র সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ার বেলায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।” (সূত্র: ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, পূর্বোক্ত. পৃ. ৩) শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেফতার হন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে শেখ সাহেব জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন (সূত্র: একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক—ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃ. ৫৩)। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।” (গাজীউল হক, আমার দেখা আমার লেখা, পৃষ্ঠা-৪০)। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন যেমন—আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন। ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন: ‘শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।’ (তথ্যসূত্র: ভালোবাসি মাতৃভাষা—পৃষ্ঠা: ৬২)
জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বিপক্ষে অবদান নিয়েছিলেন। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এ অবস্থানে দৃঢ় থাকলে ভাষা আন্দোলন অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারত (সূত্র: একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক—ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃ. ৫৩)। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর এ মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তার সমর্থন আদায় করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।’ (তথ্যসূত্র: পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি—৩য় খণ্ড, বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা-৩৯৬)। বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ১৯৫২ সালের ২৯ জুন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়—আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।’ বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এ অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২৭ এপ্রিল ১৯৫২তে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ওই সভায় সভাপতিত্ব করার সময় অসুস্থতাবশত এক পর্যায়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে সভাপতির লেখা ভাষণ পাঠ করেন কমরুদ্দীন আহমদ। ওই প্রতিনিধিত্ব সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালের পরও বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে ছেড়ে যাননি। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইনসভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল ও নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের পর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে শেখ সাহেব সমকালীন রাজনীতি ও বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন। পরবর্তীকালেও শেখ সাহেব বাংলা ভাষা ও তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলো আরো বর্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমৃত্যু বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন বিকাশে ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের সফল, সার্থক ও যোগ্য নেতা ছিলেন বলেই ভাষা সমস্যার ভার তার ওপর অর্পিত হয়েছিল। এ মহান নেতা বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ।
১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। একই সালের ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষাসংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহূত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক। ১৬ ফেরুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশননেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।’ (সূত্র: ভালোবাসি মাতৃভাষা-ভাষা-আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মার্চ ২০০২, পৃ. ১৮২-১৯১)।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারি করা এক আদেশে বলা হয়, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তাঁর ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।’ (সূত্র: রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, গণভবন, ঢাকা, পত্রসংখ্যা—৩০/১২/৭৫-সাধারণ-৭২৯/৯(৪০০) তারিখ: ১২ মার্চ ১৯৭৫)
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমিতে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু হবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’ (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১)
১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফলশ্রুতি’ (দৈনিক সংবাদ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫)। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার এ ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। এ মহান আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্থপতির ভূমিকা পালন করে আমাদের একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। ‘বাংলাদেশ’ নামের এ ভূখণ্ডের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই স্বীকার করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকৃতি বা অবমূল্যায়ন মানেই আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সর্বোপরি আমাদের জাতিসত্তা ও অস্তিত্বকেই অস্বীকৃতি।
এম আর মাহবুব: শিক্ষক ও ভাষা আন্দোলন গবেষক