কে জি মুস্তাফা
কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে দেখা। কথা হলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে। আমরা এক সময় ইকবাল হলের ব্যারাকে বাস করেছি। হলে যাদের সঙ্গে হূদ্যতা ছিল, তাদের মধ্যে আবদুস সামাদ (তখন নামের সঙ্গে ‘আজাদ’ যোগ হয়নি), কামরুজ্জামান ও মোহাম্মদ সুলতানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আবদুস সামাদ ও মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন যুবলীগের নেতা, কামরুজ্জামান প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তখনকার দিনে আমরা বিভিন্ন ইস্যুতে যৌথ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিতাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠন করতে আমাদের ঝগড়াঝাঁটি করতে হয়নি। বিভিন্ন হলের নির্বাচনেও আমরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছি। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্রার্থী আবদুর রহমান চৌধুরী তখনকার ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থন পান এবং সহসভাপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি মুসলিম লীগের প্রতি আকৃষ্ট হন। কর্মজীবনে ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যৌথ সমর্থনে নির্বাচিত হন। কিন্তু আবদুস সামাদকে যৌথ প্রার্থী করার পরও নির্বাচনে আমরা পরাজিত হই ’৫১-৫২ সালে। সেবার জয়লাভ করেন মুজিবুল হক, কর্মজীবনে সিএসপি ও অত্যন্ত সফল আমলা। ’৫২-৫৩ সালে আমরা আবার জয়লাভ করি যৌথ প্রার্থী দিয়ে। প্রার্থী ছিলেন ঢাকার শামসুল হক, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার সদস্য। ওই বছর আমি কামরুজ্জামানকে এসএম হলের নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু তিনি সম্মত হননি এ কারণে যে তিনি তখন প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সভাপতি। সম্প্রতি সামাদ আজাদের সঙ্গে আলোচনার সময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি হলের নির্বাচন নিয়েও কথা উঠল। তিনি বললেন, ফেব্রুয়ারি এলেই আপনার লেখা পড়ি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে। এবারো নিশ্চয়ই কিছু লিখবেন। আমি বললাম, লিখতে তো হবেই যতদিন বেঁচে আছি এবং লেখার ক্ষমতা আছে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবেন না বলে জানালেন সামাদ আজাদ। তাদের হয় প্রেস কনফারেন্স, নয় তো ওয়ার্কিং কমিটির সভা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বায়ান্নর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তার ছিল বিশেষ অবদান। তিনি বললেন, গত বছর থেকে শহীদ দিবসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কাজকর্ম। আমি বললাম, আর এই সময়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ-সংক্রান্ত কনভেনশন, মহান একুশের লেখালেখি ইত্যাদি নিয়ে ডুবে থাকার পরিবর্তে ঘরছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। ফোন না থাকা যে কত বড় সমস্যা, এখন টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। পুরনো বাসার ফোনটা স্থানান্তর করার আবেদনের পূর্ব শর্তাবলি পূরণে ব্যস্ত আমি।
সামাদ আজাদ প্রশ্ন তুললেন ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীনের জনসভার কথা। ওইদিন নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর পরই সমবেত জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে মুসলিম লীগবিরোধী স্লোগানে এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে। শুধু প্রতিবাদের ভাষা নয়, তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলার দৃঢ়প্রত্যয় দেখা গেল সেদিন ছাত্র-জনতার চোখে-মুখে। ৩০ জানুয়ারি বার কাউন্সিল হলের সভায় সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটি গঠিত হলো মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে। সংগ্রামের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় সভায়। সিদ্ধান্ত হলো ৪ ফেব্রুয়ারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-জনতার সভা। এরপর ৮ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস। ওইদিন আন্দোলনের কর্মসূচি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাখ্যা করবেন স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। পাশাপাশি পতাকা বিক্রি করে আন্দোলনের তহবিল গড়া হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ, শোভাযাত্রা ও ছাত্র-জনতার সভা।
৩০ জানুয়ারির সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, খেলাফতে রব্বানী পার্টির সভাপতি আবুল হাশিম, অধ্যাপক আবুল কাশেম, নুরুল হক, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান, অ্যাডভোকেট কমরুদ্দিন আহমদ, যুবলীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ তোয়াহা, সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ, কোষাধ্যক্ষ ও সাংবাদিক তাসাদ্দুক আহমদ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, যুবলীগ নেতা আবদুস সামাদ (আজাদ), গাজীউল হক, মোহাম্মদ সুলতান, কে জি মুস্তাফা (বর্তমান নিবন্ধের লেখক), মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, জিল্লুর রহমান, আবদুল মমিন, সাদেক খান, মোহাম্মদ ইলিয়াস, এমআর আখতার মুকুল, মাহবুব জামান জাহেদী এবং আরো অনেকে।
আন্দোলনের কর্মসূচি সফল করার জন্য আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ, খোকা রায়, শহীদুল্লাহ (কায়সার), মোহাম্মদ তকীউল্লাহ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও অন্যান্য নেতা-কর্মী প্রকাশ্য প্রচারণায় নামেন। নারীদের মধ্যে প্রচারকার্যে অগ্রণী ছিলেন নাদেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন (প্রয়াত), সোফিয়া খান, হালিমা খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, সুফিয়া করিম, রওশন আরা বাচ্চু প্রমুখ।
আন্দোলনের এ বিশাল আয়োজনে ব্যক্তিগতভাবে অনুপস্থিত থাকলেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫০ সালে কারারুদ্ধ হওয়ার পর থেকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বায়ান্নর আন্দোলনকালেও তিনি ছিলেন রাজবন্দি। আন্দোলনে শরিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি ও মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারে ধর্মঘট শুরু করেন। এ সময়েও তিনি ছাত্র জননেতাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। একপর্যায়ে অনশনকারী হিসেবে তাকে ও মহিউদ্দিন আহমদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিকিউরিটি ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালে ছাত্রদের সঙ্গে শেখ মুজিবের যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে তাকে ও মহীউদ্দিনকে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বদলি করা হয়। পথে নারায়ণগঞ্জের তরুণ ছাত্রলীগ কর্মী মুস্তাফা সারওয়ার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের আন্দোলনে অবিচল থাকার জন্য নির্দেশ দেন। তিনি অনশন চালিয়ে যাবেন বলেও মুস্তাফা সারওয়ারকে জানান। এরই মধ্যে ঢাকা ও সারা প্রদেশ আন্দোলনের কর্মসূচি পালনে তত্পর হয়ে ওঠে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা বন্ধ করে দেয় প্রাদেশিক সরকার। অভিযোগ, পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে তৃতীয় খলিফা হযরত ওমরের বিরুদ্ধে অসৌজন্যমূলক অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগটির কোনোই ভিত্তি ছিল না। আসলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন পোষণ করার কারণই পত্রিকাটি বন্ধ করা হয় এবং সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেফতার করা হয়। সামনে ছিল একুশ তারিখে প্রদেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচি। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে চারের বেশি লোকের সভা, মিছিল ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই রাতেই সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচনের সম্ভাবনা মাথায় রেখে কমিটির অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু ছাত্রদের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই আন্দোলন এগিয়ে নেয়া হবে। সভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক বক্তৃতা করবেন। তার পরও যদি ছাত্র-ছাত্রীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে চায়, তাহলে অ্যাকশন কমিটি আপনা-আপনি ভেঙে যাবে। ছাত্ররা শামসুল হকের কথা মান্য করেননি। তারা ১০ জনের স্কোয়াডে ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথম স্কোয়াড ছিল নারীদের। তাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে পরবর্তী ১০ জনের স্কোয়াডেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে অশালীন আচরণ করা হয় এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। একপর্যায়ে ছাত্ররা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ এরই মধ্যে গুলি করতে শুরু করে। গুলিবর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকতসহ চারজনের মৃত্যু হয়। ক্যাম্পাস ছেড়ে ছাত্ররা তখন মেডিকেল কলেজের দিকে ভিড় করেন। গুলিবর্ষণের খবর শুনে পূর্ববঙ্গ আইনসভা থেকে সরকারদলীয় সদস্য ও আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বের হয়ে এসে ছাত্রদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। সম্পাদক শামসুদ্দিন মুসলিম লীগ ও আইনসভা থেকেও পদত্যাগ করেন। পরদিন হয় এক সুবিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ। সকালে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় বাঙালিবিদ্বেষী সংবাদ প্রকাশ করার প্রতিবাদে তাদের অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সারা দেশ সেদিন ছিল প্রতিবাদমুখর এবং মুসলিম লীগবিরোধী ধ্বনিতে প্রকম্পিত। ধীরে ধীরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামাঞ্চলে, যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়।
গত বছর শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর মহান একুশের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারাগারে থাকলে বাইরে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে না, এটা একটা অরাজনৈতিক অনুমান। দেশের বামপন্থীদের অধিকাংশই কারাগারে কাটিয়েছেন তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময়। তারা কি বাইরে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ না রেখেই আন্দোলন সম্পর্কে মতামত পাঠাতেন তাদের নেতাদের কাছে? একমাত্র যাদের আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল তারা ছাড়া অন্যদের অধিকাংশই যোগাযোগের কোনো-না কোনো চ্যানেল খোলা রাখার ব্যবস্থা করতেন। সেই রাজনীতিকে ‘চিরকুট রাজনীতি’ বলে উপহাস করেন এমন মানুষও দেখা যায়। রাজনীতিতে জড়িত সন্দেহে যাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তাদের মধ্যে যারা একটু প্রভাবশালী, তারা তাদের যোগাযোগের চ্যানেল খোলা রাখেন তাদের রাজনীতির স্বার্থেই। তা না হলে সারা দেশের কারাগারে একই ইস্যু নিয়ে রাজবন্দিরা আন্দোলন করতে পারতেন না। চলমান রাজনীতির ট্রেন্ড সম্পর্কেও তারা সজাগ থাকতে পারতেন না।
যা হোক, বঙ্গবন্ধুর কথায় আসি। ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমি তাকে বিটিভির পক্ষ থেকে ইন্টারভিউ করি। অনেক প্রশ্নের মধ্যে এ কথাও জানতে চাই, কারাগারে আটক থেকে কীভাবে তিনি বাইরের আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। তিনি জবাবে বললেন, জেল খাটলে কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে একটা সৌহার্দ্য গড়ে তোলা যায়, যা পরে কাজে আসে। তিনি আরো বললেন, ওইভাবেই কারাগারের সহানুভূতিসম্পন্ন কর্মচারীদের মাধ্যমেই তা করতে হয়, খুব সাবধানে। এটা তোমরাও (অর্থাৎ কমিউনিস্টরাও) করে থাকো।
আরো একটি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বায়ান্নর আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন তোলা হয়। সেটা হচ্ছে, শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদ নিজেদের মুক্তির দাবিতে অনশন করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নির্দেশনা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য নয়। তাই যদি করে থাকেন, তো মন্দ কি! অনশন করা জেলখানায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নিজেদের মুক্তির দাবিতে সেই আন্দোলন করলেও একটি নজির খাড়া করা যায়, নিজের মুক্তির দাবিতে বহু মনীষী কারাগারে অনশন করেছেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন যদি অনশন ধর্মঘট করে থাকেন তাদের মুক্তির দাবিতে, তাহলে একই সঙ্গে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সাফল্য কামনাও তারা অবশ্যই করতে পারেন। দীর্ঘদিন কারাবরণ করেও তারা এই পথটা আবিষ্কার করতে পারবেন না—এমন ধারণা করাও অবাস্তব। জেল কর্তৃপক্ষ যদি প্রচারও করে থাকে, শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন তাদের মুক্তির জন্য অনশন করেছেন, তাহলে তো বাইরের সাধারণ মানুষ জানবে, আসলে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যই অনশন করেছেন, অন্য যে কথাটা রটেছে সেটা কর্তৃপক্ষকে ধোঁকা দেয়ার জন্যই। সবচেয়ে বড় কথা, শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নিজের মুক্তির দাবিতে অনশন করবেন, এ কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। এত বড় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের মতো নেতা নিজের মুক্তির দাবিতেই শুধু অনশন ধর্মঘট করবেন, এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। একই সঙ্গে নিজেদের মুক্তি ও ভাষা আন্দোলনের সাফল্য কামনা করে অনশন করা সম্ভব।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। বায়ান্ন সালে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের জন্মের তিন বছরের মধ্যে শেখ মুজিব যখন সারা প্রদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা, তখন কি তিনি স্বেচ্ছায় ব্যক্তিগত মুক্তি নিয়ে জেলখানা থেকে বের হতে উদগ্রীব হবেন? শেখ মুজিবকে যারা জানেন, তারা এ ধরনের কোনো কথাই বিশ্বাস করবেন না। বরং আন্দোলনের সময় তিনি আরো দৃঢ়তা দেখাবেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যাতে সফল হয়, তার জন্য সব কিছু করবেন। শেখ মুজিবের মতো নেতার এমন দৃঢ়চিত্ত হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজ ধ্বংস করার জন্য মাঠে-ময়দানে যারা মিথ্যাচার করে চলেছে, তারা এসব কথা প্রচার করতে বেশি আগ্রহী। বিশ্বের সব নেতাই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালোভাবে জানেন। তাদের কাছে এ মহান জননেতাকে খাটো করে দেখানো যাবে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনকালে তার মতো মাতৃভাষাপ্রেমী জননেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ একটা বিরল প্রাপ্তি, এটা বিদেশীরা বুঝতে পারবেন। যারা বুঝবে না, তারা আমাদের নিজের দেশের বাংলা ভাষাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ ও মৌলবাদী দলগুলোর নেতাকর্মী। মাতৃভাষা দিবস পালন নিয়ে তারা মোটেই মাথা ঘামায় না। তারা চায় মুজিবের ইমেজ নষ্ট করতে।
আরো একটি কথা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন, তাদের অন্যতম ছাত্রলীগ নেতা ইকবাল হলের কামরুজ্জামান, ফজলুল হক হলের ছাত্রনেতা জিল্লুর রহমান, আবদুল মমিন একবাক্যে স্বীকার করেন বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালে আন্দোলন সম্পর্কে নির্দেশ পাঠিয়েছেন তাদের কাছে। তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এবারো তারা তাদের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তাদের সম্পর্কে সাবধান থেকে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে সাফল্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত। আটচল্লিশের মুজিবকে যিনি জানেন, তিনি তার এ নির্দেশের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না বলে আমি বিশ্বাস করি। শেখ মুজিব কোনো পরিস্থিতিতেই আন্দোনের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি, বায়ান্ন্নর মহান একুশের আন্দোলন থেকেও তিনি দূরে ছিলেন না। তারই হাতে গড়া ছাত্রলীগের নেতারা একবাক্যে এ কথা স্বীকার করেন। পরবর্তী পর্যায়েও শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে থাকা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। ১৯৭২ সালে আমার টিভি ইন্টারভিউকালে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তার কারাজীবন সম্পর্কে, সেটাকে তো কেউ অসত্য বলে দাবি করেননি। এতকাল পরে তারা হঠাৎ কোথা থেকে জেগে উঠে বলতে শুরু করলেন, মুজিব ছিল না মাতৃভাষা আন্দোলনে। জেলে থাকাকালে আন্দোলনে কোনো ভূমিকা রাখা যায় না বলে যারা মনে করেন, তাদের বিচারে নেলসন ম্যান্ডেলা নিশ্চয়ই দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের নেতৃত্ব লাভের অযোগ্য ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাকে মহান নেতা হিসেবে বরণ করে ২৭ বছরের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন আমাদের বন্ধুদের বিচারে! মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এদের সম্পর্কেই বা কী বললেন আমাদের মুজিববিরোধীরা? কারাগারে কেউ তো স্বেচ্ছায় যান না, রাজনীতিবিদদের জনগণ থেকে দূরে রাখার জন্যই গ্রেফতার করা হয়। যারা জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, তারা সেই জনগণের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন সংগ্রামের প্রয়োজনে, তাগিদে। এটা কোনো ব্যঙ্গ করার বিষয় নয় বা কাউকে লোকচক্ষে হেয় করারও বিষয় নয়। জীবন বাজি রেখেই এ ধরনের জেলকোডবিরোধী কাজ নেতাদের করতে হয়। সে কাজ করতে পারেন বলেই তারা জনগণের কাছে প্রাণপ্রিয় নেতা বলে সমীহ লাভ করেন এবং শ্রদ্ধাভাজন হন।
(লেখাটি ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি’ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালোবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ থেকে সংকলিত।)
কে জি মুস্তাফা: সাংবাদিক