মিল্টন বিশ্বাস
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর তত্কালীন পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপন নথি নিয়ে ১৪ খণ্ডের বইয়ের মধ্যে প্রকাশিত প্রথম থেকে চতুর্থ খণ্ড পর্যন্ত পাঠকের হাতে এসেছে। ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের সময় ১৯৪৮-৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ১৯৫১-৫২ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকে গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন শেখ মুজিব আর ১৯৪৮-৫২ ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার কাল।
এ দুই খণ্ডের গ্রন্থ ছাড়াও ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি অংশগ্রহণের প্রমাণ রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থদ্বয়ে। আরো আছে বিশিষ্টজনের লেখায় বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্নের কথা। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখায় বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ার প্রসঙ্গ আছে এভাবে—“শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটি প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ ‘শুনবেন?’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বললেন, সেই ১৯৪৭ সালে।”
আমি সুহরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের দলে। তিনি ও শরত্চন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ।...দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে।...তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই, কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা।...হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে।
ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে, যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, ‘জয়বাংলা’।...‘জয় বাংলা’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় বা সাম্প্রদায়িতকার ঊর্ধ্বে।’
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, কিন্তু পূর্ব বাংলা নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। যার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণপরিষদে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উদযাপনে যে কর্মসূচি নেয়া হয় তার সঙ্গেও শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা ছিল নিবিড়। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদক। ওইদিন সকাল থেকে তিনি সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহরে টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব ভাষণ দেন। তার অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা গান ‘ভুলবো না’ পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য স্লোগানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, গণপরিষদ ভেঙ্গে দাও, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ সচকিত করে তোলে।
ইতিহাসের এই অর্জন একদিনে সম্ভব হয়নি। আমরা জানি, ভারত বিভাগের পর এই ভূখণ্ডের ছাত্রনেতারা অনুমান করেছিলেন ১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব’ অনুসারে মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এক রাষ্ট্র পাকিস্তান হওয়ায় বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে।
এজন্য দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের আগস্টে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র ২১ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহম্মদ, আবদুল ওদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠা হয়।
এ সংগঠনের কর্মীসম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’
অন্যদিকে বাঙালির ভাষা ও কৃষ্টির প্রতি সম্ভাব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক সভায় ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ সংগঠনটি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে পুনর্গঠিত হয়। সে সময় ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম।
১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে।’ (ভলিউম-১, পৃ. ৭) ৩ মার্চ গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য নেতারা ছাত্রদের সম্মেলনে বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে কথা বলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এ ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রথম খণ্ডের পৃ. ৭-এ সেই তথ্য আছে। অন্যদিকে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শাসমুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেফতার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেফতার হয়।’(পৃ.-২০৬)
উল্লেখ্য, ভারতভাগের আগেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে লাহোরের হায়দরাবাদে উর্দু সম্মেলনে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ঘোষণা ছিল ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।’ (দৈনিক আজাদ, ১৮ মে ১৯৪৭)। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে রয়েছে, করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ।
উপরন্তু কায়েদে আযমকে দেয়া জমিয়ত প্রতিনিধিদের স্মারকলিপিতে ‘পূর্ববঙ্গের জনগণ উর্দুর সমর্থক বলে দাবি করা হয়।’ (দৈনিক আজাদ, ২৬ মার্চ ১৯৪৮) ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাঙালি প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নির্দেশে ১৯৪৮ সালে তত্কালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একটি পত্র লেখেন। তাতে বলা হয়, ‘সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা বাংলা ভাষায় উর্দু অক্ষর প্রবর্তন করতে চান এবং এর জন্য তাঁর সাহায্য পেলে তাঁরা উপকৃত হবেন।’
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই চিঠির জবাব দেননি বরং ভিন্নমত পোষণ করেন, যা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত। এছাড়া তত্কালীন প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার প্রাদেশিক পরিষদে ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ব বাংলায় সরকারি অফিস ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা চালুর বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বাংলা আরবি হরফে লেখার পক্ষে জোর প্রস্তাব রাখেন।
১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বানে সম্মিলিত এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিব, নইমুদ্দিন আহম্মদ, আবদুর রহমান চৌধুরী। ওইদিন পিকেটিং করেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ এবং সে সময় তারা বন্দি হন।
কিন্তু প্রতিবাদ মিছিল বের হয় বেলা ২টার দিকে। ১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমন উপলক্ষে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ১৫ মার্চ ১৯৪৮। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি মেনে নেন, কিন্তু এসব ছিল খাজা নাজিমুদ্দিনের রাজনৈতিক চাল। কারণ তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করেছিলেন।
জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এসে রেসকোর্স ময়দানে সদম্ভে ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছেন, ‘জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ আমরা প্রায় চার-পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না।’ (পৃ. ৯৯) জিন্নাহ সাহেব একই কথার প্রতিধ্বনি করেন ২৪ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন উৎসবে।
জিন্নাহ সাহেবের সে উক্তির যথাযথ প্রতিবাদ করেন সমবেত ছাত্র-জনতা। তিনি ঢাকা ত্যাগ করে যাওয়ার পর সেদিনকার ঘটনা স্মরণ করে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষা শতকরা ছাপান্নজন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি। সাধারণ ছাত্ররা আমাকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। ’(পৃ. ৯৯-১০০) তবে তার আগে খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় শেখ মুজিব প্রমুখ মুক্তি পান।
পরদিন ১৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা হয়। সভায় তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। ভাষার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে আর সুশীল সমাজ তথা সাহিত্যিকদের যৌক্তিক বয়ানও উপস্থাপিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী দিবসে সভাপতির ভাষণে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু না মুসলমান এ কথা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য আমরা বাঙালী।’
এটা কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন, তা মালা-তিলক-টিকি কিংবা লুঙ্গি-টুপি-দাড়িতে ঢাকার জো নেই।’ এই সত্যকে সামনে রেখে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল তা ছিল সর্বধর্ম-বর্ণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে।
১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি ধর্মঘটের মাধ্যমে সমগ্র পূর্ববঙ্গে জুলুম প্রতিরোধ হিসেবে পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান সভায় নইমুদ্দিন আহম্মদ সভাপতিত্ব করেন এবং বক্তব্য রাখেন শেখ মুজিব, আ. রহমান চৌধুরী প্রমুখ। পরে ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেফতার হন।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দানের সময় শেখ মুজিব বন্দি হন এবং মুক্ত হন ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। তার আগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটকে সমর্থন করায় শেখ মুজিবসহ ২৭ শিক্ষার্থীর ওপর বহিষ্কারাদেশসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি তখন আইনের ছাত্র। তার শাস্তি হয় মুচলেকা এবং ১৫ টাকা জরিমানা, না হয় চূড়ান্ত বহিষ্কার। তিনি মুচলেকা দেননি, তাই বহিষ্কার এবং ছাত্রজীবন পরিসমাপ্ত হয়।
তবে ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি গোপন দলিলের ২৭ নম্বর ভুক্তিতে ভাষা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কার্যক্রমের কয়েকটি বিষয় লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে তিনি তার একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জেলে। তবে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি মুহূর্তেও।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বন্দিদশার ভেতর থেকেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা (খাজা নাজিমুদ্দীনের ঘোষণার পর), ‘দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হল। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সকলেই এর তীব্র প্রতিবাদ করে।
আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরো বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না।
পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে।
নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। আরো বললাম, খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি।
তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরো দু-একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।’ (পৃ. ১৯৬-৯৭) ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ইতিহাস আমাদের সবারই জানা।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গতিপথ বেয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তব হয়েছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যথেষ্ট রক্ত দিয়েছি। আর আমরা শহীদ হওয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করব না এবার আমরা গাজী হব। সাত কোটি মানুষের অধিকার আন্দোলনের শহীদানদের নামে শপথ করছি যে আমি নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করব।’
এ প্রতিজ্ঞা ফলপ্রসূ করতে গিয়ে তথা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে ৪৬৮২ দিন জেল খেটেছেন। তবু তিনি মাথা নত করেননি অন্যায়ের কাছে। একুশের চেতনায় মাথা নত না করার প্রত্যয় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া।
মিল্টন বিশ্বাস: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ ও পরিচালক জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়