শেখ হাসিনা
আমি আমার বক্তব্যের প্রথমেই শ্রদ্ধা জানাই মহান ভাষা আন্দোলনে সেসব শহীদ, যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের মা বলে ডাকার অধিকার দিয়ে গেছে। শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকসহ আমাদের শহীদ, যাদের মহাত্যাগের বিনিময়ে আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। আমি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি; যিনি বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং যার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, আমাদের জাতীয় চার নেতা এবং ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনকে।
জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর ১২টা ১ মিনিটে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে তিনি তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের আন্দোলন কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ আন্দোলন ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।’ জাতির পিতার এই মহামূল্যবান বক্তব্য থেকে এসে যায় যে আমাদের ভাষা আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছিল আমাদের জাতিসত্তা প্রকাশের সংগ্রামের এবং যখন পাকিস্তান নামে রাষ্ট্রটা সৃষ্টি হয় এবং যখন ব্রিটিশরা ভারতে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করে গেল, একটা পাকিস্তান, একটা ভারতবর্ষ। ঠিক সেই সময় নানা আলোচনা শুরু হয়। আর তখন থেকেই ভাষার বিষয়টা উঠে আসে।
আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও আলোচকদের কাছে আপনারা শুনেছেন যে কীভাবে কী করে এই ভাষার জন্য অনেকেই তার লেখনীর মাধ্যমে বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার কথা বলে গেছেন। কিন্তু যখন ’৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচিতে একটা সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল, সেই সাহিত্য সম্মেলনে ঘোষণা দেয়া হলো যে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। তখনই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, কয়েকজন ছাত্র মিলে মিছিল করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে তারা গিয়েছিল এটার প্রতিবাদ জানাতে। সেখানেও কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র এবং সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একটি সভা ডাকলেন। তমদ্দুন মজলিসসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বা ছাত্র সংগঠন তারা মিলে সিদ্ধান্ত নিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের এবং ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে ১১ মার্চ ঘোষণা দেয়া হলো। ১১ মার্চ এ ঘোষণা দিয়ে সেদিন ধর্মঘট ডাকা হয়। এবং তারই আগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি (বঙ্গবন্ধু) ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠনও গঠন করেছিলেন। সেই ছাত্রলীগকে দিয়েই কিন্তু সংগঠন, মানে ভাষা আন্দোলনের যাত্রা হয় এবং এই ১১ মার্চ ধর্মঘট করতে গিয়ে আমাদের তখন অনেক নেতা গ্রেফতার হন, সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। এমনকি আমাদের এখানে দীপু মনির বাবা ওদুদ সাহেবসহ আমাদের আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, প্রায় ৭০ জনের মতো তখন গ্রেফতার হন অথবা পুলিশের লাঠির বাড়িতে আহত হয়।
এরপর নাজিমুদ্দিন সাহেব একটা যোগাযোগ করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা হয় এবং তিনি ওয়াদা দিয়েছিলেন যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটা তিনি পার্লামেন্টে তুলবেন এবং মেনে নেবেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলো মেনে নেয়ার ফলে সবাই আবার ১৫ তারিখে সন্ধ্যায় মুক্তি পান।
১৬ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা, এই আমতলা এখন আমাদের যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ তার যে আউটডোর, এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর সেখানেই ছিল আমতলা এবং সেখানে একটা সভা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং সেখানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণ দেয়া হয়।
আর এই সংগ্রাম করতে গিয়ে বারবার কিন্তু তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, মুক্তিও পেয়েছেন। কারণ সংগ্রাম পরিষদ তখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে যায়। এই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে জনমত সৃষ্টি করা এবং সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য এবং এরই এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ফরিদপুরে গিয়েও গ্রেফতার হন, আবার মুক্তি পান। বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, মুক্তি পেয়েছেন। ’৪৯ সালের অক্টোবরে ঢাকায় একটি ভুখা মিছিল হয়। তখন লিয়াকত আলী খান পূর্ববঙ্গে আসার কথা, সেই সময় এই আন্দোলনে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তারপর কিন্তু অনেকে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তি পাননি। কারাগারে থেকেও তিনি যখনি কোর্টে অথবা চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসতেন, তখনই কিন্তু তিনি ছাত্রনেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। এই সাক্ষাত্কারের একটা পর্যায়ে তিনি ছাত্রলীগের তখন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নইমুদ্দীন সাহেব এবং খালেক নেওয়াজ, তাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে এবং ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি যখন প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট সেশন বসবে, তখন পার্লামেন্ট বসত জগন্নাথ হলের যে হলটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল, আপনাদের মনে আছে ১৫ অক্টোবর, ওটাই ছিল মূলত তখন প্রাদেশিক পরিষদের মানে সংসদ ভবন, ওখানেই তখন বৈঠক হতো। যেহেতু ওখানে বৈঠক হবে, ছাত্রদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, সেই ধরনের নির্দেশনা দেন এবং সেই সাথে সাথেই একটা সংগ্রাম পরিষদ আবার গঠন করা হয় ’৫২ সালে এবং সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে যেন সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়, সে নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন।
কাজেই এভাবেই তিনি ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তার দাবি আদায়ের জন্য অনশনে যাবেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অনশন শুরু করেন, তার সঙ্গে আমাদের ন্যাপের মহিউদ্দিন সাহেব (তিনিও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের) অনশন করেন। অনশনরত অবস্থায় তাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। যখন তাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যায়, ওই সময় স্টিমার এখানে ওয়াইজঘাট থেকে স্টিমার ছাড়ত, নারায়ণগঞ্জে স্টিমার থামত, তিনি আগেই খবর দিয়েছিলেন যে নারায়ণগঞ্জের নেতারা যেভাবে হোক ওনার সঙ্গে যেন দেখা করে। সেখানেও তিনি বসে তাদের চিরকুট পাঠান এবং অনেকের সাথে সাক্ষাৎ হয়, সেখানেও নির্দেশ দিয়ে যান যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
ভাষার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে, সেই নির্দেশনাও তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন। কাজেই এভাবেই তিনি এই আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কারাগারে বসেও কিন্তু এ আন্দোলন সম্পর্কে সবসময় সচেতন ছিলেন।
’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যখন মিছিল বের হয়, সেখানে গুলি চলে এবং আমাদের শহীদরা রক্ত দিয়ে এই ভাষা আন্দোলনকে একটা জায়গায় নিয়ে যান। অথচ সেই ’৪৮ সাল থেকে আন্দোলন শুরু, ’৫২ সালে এসে বুকের রক্ত দিয়ে রক্তাক্ষরে ভাষার অধিকারের কথা আমাদের শহীদরা লিখে গিয়েছেন।
এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে তখন যুক্তফ্রন্ট একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী তারা সবাই মিলে যুক্তফ্রন্ট করেন। সেই যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও সেই সরকার বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কারণ পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে নানা রকম চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র করে এবং সেই সরকার বাতিল করিয়ে ৯২/ক ধারা দিয়ে সেখানে এমারজেন্সি ডিক্লেয়ার করে, আবার সবাইকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার গ্রেফতার হন।
এরপর ’৫৬ সালে এসে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। সেখানে অনেক শর্ত মেনেই তাকে হতে হয়েছিল। যা-ই হোক, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের জন্য প্রথম সংবিধান রচনা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর কিন্তু আর এর আগে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হয়নি। এ সংবিধানে তখন উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রাভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় এবং সেটা আপনারা শুনেছেন যে শর্তসাপেক্ষে। সেটা আমরা জানি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ আসার পরই কিন্তু যে শাসনতন্ত্র পাকিস্তানে রচিত হয়েছিল, সেখানেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। আর সেই সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়, ছুটি ঘোষণা করা হয়, সরকারি ছুটি পালন করার জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে, প্রকল্প নিয়ে কাজও শুরু করে।
’৫৮ সালে আইয়ুব খান তখন মার্শাল ল জারি করেন। আইয়ুব খান ছিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান, তিনি একাধারে সেনাপ্রধান আবার সেই সাথে নিজেকে রাষ্ট্রপতিও ঘোষণা দেন, ক্ষমতা দখল করেন। আবার আমাদের ভাগ্যে নেমে আসে সেই অমানিশার অন্ধকার এবং বাংলাকে আবারো মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সে সময় আপনারা শুনেছেন, এর আগে আমি নিজেও বলেছি যে বাংলা ভাষা চর্চা করা যাবে না, বাংলায় কথা বলা যাবে না। আবার কবিতাগুলোও, আপনারা কিছুক্ষণ আগেই শুনলেন যে কবিতাগুলোকেও কি মুসলমানি ভাষা দিতে হবে; মানে সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। সেটাকে করা হয়েছিল, ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি, সারা দিন আমি যেন আচ্ছা হয়ে চলি। এমনকি কবি নজরুলের সেই কবিতা, সজীব করিব মহাশ্মশান, এই মহাশ্মশান থাকতে পারবে না, সেখানে বসানো হলো গোরস্থান। আর রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না, রবীন্দ্রনাথ বন্ধ করে দেয়া হলো। রবীন্দ্রসংগীত শোনা যাবে না, রবীন্দ্রনাথ পড়া যাবে না। আমার মনে আছে, আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা, রফিক স্যার এখানে উপস্থিত আছেন, তখন কিন্তু সমস্ত শিক্ষক এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই সময় আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের যিনি হেড ছিলেন হাই স্যার, তাকে ডেকে নিয়ে মোনায়েম খান, মোনায়েম খান খুব বিরক্ত, কারণ এখানে আন্দোলন কেন চলবে? রবীন্দ্রনাথ তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, তাতে কি আছে? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কি চলে না ভাষা? কাজেই সেদিন থেকে নজরুলের কবিতাকে মুসলমানি শব্দ দেয়া হচ্ছে, আর রবীন্দ্রনাথ একেবারে বাতিল। এই হলো তাদের মানসিকতা। তো সেখানে দেখা গেল যে যখন হাই স্যারকে ডেকে মোনায়েম খান সাহেব বলল, কি মিয়ারা আপনারা বসে খালি রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত করেন দুই-চারখান রবীন্দ্রসংগীত নিজে লিখে ফেলতে পারেন না। উনি (হাই সাহেব) খুব ভদ্র লোক ছিলেন, নেহাতই ভদ্র মানুষ। আমি যখন ভর্তি হই, তখন উনি বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। উনি খুব বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, স্যার, আমরা তো লিখতে পারি, কিন্তু সেটা তো রবীন্দ্রসংগীত হবে না, আমি লিখলে ওটা তো হাই সংগীত হয়ে যাবে। এভাবে আমাদের ভাষার ওপর বারবার আঘাত এসেছে।
এ আঘাতটা কিন্তু সেই আমাদের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, বারবারই আমরা দেখেছি। কখনো রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে, কখনো আরবি হরফে বাংলা লিখতে হবে। এভাবে বারবার একেকটা সমন জারি হয়েছে আর আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু সবসময় আন্দোলন করেই গেছে এর বিরুদ্ধে। কারণ প্রত্যেকটা অর্জনই কিন্তু সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা অর্জনের পেছনে আমাদের কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে।
জাতির পিতা যে কথাটা বলেছিলেন, যে আমাদের ভাষা আন্দোলন এটা শুধু যে ভাষার জন্যই তা নয়; এখানে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ আন্দোলন ছিল। এ ধারাবাহিকতায় কিন্তু জাতির পিতা একটা জাতিকে ধীরে ধীরে আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি যে ছয় দফা দিয়েছিলেন, সেই ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সোপান। এটা পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল, যে কারণে ছয় দফা দেয়ার সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু এখানে আমাদের ছাত্রসমাজ, দেশের জনগণ ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটিয়েছিল এবং বাধ্য করেছিল এ মামলা প্রত্যাহার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। মুক্তিটা তখন তিনি পেয়েছিলেন ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।
আমি জানি না, ওনার জীবনীটা পড়লে খুব অদ্ভুত লাগে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের যে সংগ্রাম তিনি ’৪৮ সালে শুরু করলেন এবং একের পর এক গ্রেফতার হলেন। এরপর যখন ’৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন, তারপর কিন্তু আর মুক্তি পাননি। ’৪৯, ’৫০, ’৫১ এরপর ’৫২ সালে গিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি অনশনরত অবস্থায় মৃতপ্রায়, তখন তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান।
আবার ’৬৯ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হলো, তারপর তিনি মুক্তি পেলেন ২২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ সালে। ’৬৬ সালে গ্রেফতার করা হয়, ’৬৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দেয়া হলো এবং অনেক সাজাও দেয়া হলো। তারপর ’৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ১৮ জানুয়ারি যখন নিয়ে যাওয়া হয়, আমরা পরিবারের কেউ জানি না কোথায় নিয়ে গেছে, কেমন আছেন, বেঁচে আছেন কিনা? কোনো খবরই আমরা পাইনি। যখন আগরতলা মামলা শুরু হয়, ওই কোর্টে প্রথম দেখা। কাজেই এভাবে বারবার যে আঘাত এসেছে, তার পরও তিনি কিন্তু একটা নীতি নিয়ে, আদর্শ নিয়ে, বাঙালি জাতির স্বাধিকার আদায়, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কিন্তু সংগ্রাম করে গেছেন। আর সেই সংগ্রামের পথ বেয়েই আজকে আমরা এই বাংলাদেশে, স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি।
তার যে ঐতিহাসিক ভাষণ ৭ মার্চের, যে ভাষণ আজকে বিশ্ব ঐতিহ্য প্রামাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে, সেটা বাঙালি জাতি আজকে মর্যাদা পেয়েছে। বাঙালি জাতির জন্য এটা গৌরবের। কাজেই যা কিছু অর্জন আমাদের করতে হয়েছে, সংগ্রামের পথ বেয়েই করতে হয়েছে।
(২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভাষণটি মুদ্রিত হলো)
শেখ হাসিনা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা