[প্রায় দুই বছর হয় স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, অথচ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি সৌদি আরব। তাই আলজিয়ার্সে পৌঁছেই বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করলেন বঙ্গবন্ধু। ব্যবস্থা করলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। এখানে রইল এম আর আখতার মুকুলের দেওয়া সেই বৈঠকের ভাষ্য।]
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী মুজিব এবং বাদশাহ ফয়সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোলাকুলি ও পারস্পরিক চুম্বন। এরপর দুজন পাশাপাশি সোফায় বসলেন। আরেকটা চেয়ারে বসলেন বাদশাহ ফয়সালের দোভাষী। উল্টো দিকের সোফায় উভয় দেশের অন্যান্য প্রতিনিধি।
প্রথমেই শারীরিক কুশলাদি বিনিময়। এরপর দোভাষীর মাধ্যমে দুই নেতার কথাবার্তা—
ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, আমি শুনেছি যে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য প্রত্যাশী। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান? দয়া করে বলুন, আপনারা কী চান? অবশ্য এসব সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে।
মুজিব : এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তো মনে হয় না, মিসকিনের মতো বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে?
ফয়সাল : তাহলে আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?
মুজিব : বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরিফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। এক্সিলেন্সি, আপনিই বলুন, সেখানে তো কোনো শর্ত থাকতে পারে না। আপনি মহান, প্রতিটি বাঙালি মুসলমান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনি হচ্ছেন পবিত্র কাবা শরিফের হেফাজতকারী। এখানে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। সেখানে আবার শর্ত কেন? এক্সিলেন্সি, আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করছি।
ফয়সাল : এসব তো আর রাজনৈতিক কথাবার্তা হলো না। এক্সিলেন্সি, বলুন, আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?
মুজিব : এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?
ফয়সাল : আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করি না। তবু আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি—সৌদি স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।
মুজিব : এই শর্তটা কিন্তু অন্তত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে। সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। তা ছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তো শুধু আল মুসলেমিন নন—তিনি হচ্ছেন রাব্বুল আলামিন। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশের নামও তো ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।
ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, এ ছাড়া আমার অন্য একটা শর্ত রয়েছে। অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে।
মুজিব : এক্সিলেন্সি, এটা তো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। দুটো দেশের মধ্যে এ ধরনের আরো অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ—এমন বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। এসবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই শুধু বিনা শর্তে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নটি পৃথকভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর এ জন্য সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন?
ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। তাহলে এক্সিলেন্সি, আর তো কথা থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুটো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা। আরেকটা বিনা শর্তে যুদ্ধবন্দির মুক্তি। আশা করি, বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোনো কমতি হবে না।
মুজিব : এক্সিলেন্সি, একটা বিষয় একটু বুঝিয়ে বললে খুশি হতাম।
ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, বলুন কী বিষয়?
মুজিব : প্রায় দুই বছর পর্যন্ত সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সেখানকার পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র হজ আদায় করতে পারছে না। এভাবে বাধা সৃষ্টি করা কি জায়েজ? পবিত্র কাবা শরিফে তো দুনিয়ার সমস্ত দেশের মুসলমানদের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। তাহলে কেন এই বাধা সৃষ্টি? কেন আজ হাজার হাজার বাঙালি পরহেজগার মুসলমানকে ভারতের পাসপোর্টে পবিত্র হজ করতে হচ্ছে?
আকস্মিকভাবে এখানেই আলোচনার পরিসমাপ্তি। কিন্তু বৈঠক শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর এককালীন নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উচ্চারিত একটা আরবি কথার পুনরুক্তি করলেন, ‘লাকুম দ্বিনুকুম অলিয়্যা দ্বিন (তোমার ধর্ম তোমার; আমার ধর্ম আমার)।’
মুসলিম জাহানের নেতা বাদশাহ ফয়সাল সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালে দুজনের মধ্যে বিদায় কোলাকুলি আর পারস্পরিক চুম্বন।