মোনায়েম সরকার
কৈশোর থেকে তারুণ্য পর্যন্ত শেখ মুজিবের জীবনের উন্মেষকাল, তারুণ্যে তা বিকশিত হয়ে ওঠে, তারুণ্য উত্তরকালে সে জীবন পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন এক সংগ্রামীর জীবন, যোদ্ধার জীবন। তার সংগ্রামী, বিদ্রোহী সত্তার কোনো আকস্মিক বিকাশ ঘটেনি। সে সত্তার উন্মেষ, বিকাশ ও পরিপূর্ণতা পর্যায়ক্রমে এবং রাজনৈতিক তরঙ্গে ঘটেছে।
বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ‘দীর্ঘকাল পর ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বাংলার রাজনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটে, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃত্ব হিন্দু সম্প্রদায়ের হাত থেকে তাদের হাতে আসতে থাকে, বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে যার পরিণামে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হয়। শুধু তা-ই নয়, যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, বঞ্চিত পূর্ব বাংলা ইতিহাসে তার প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনীতির মূল স্রোতে চলে আসে। চিরকালের নির্যাতিত নিপীড়িত পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক প্রাণস্পন্দন, আশার সঞ্চার লক্ষ করা যায়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ দশকটি, প্রকৃতপক্ষে, এই উপমহাদেশে মুসলিম রাজনৈতিক গণজাগরণের কাল। অবশ্য, বাংলাদেশে মুসলিম রাজনীতির গোড়াপত্তন ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তখন থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত সেই মুসলিম রাজনীতি শহরবাসী উচ্চ এবং অভিজাত এক অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গ বিভক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলা ও আসামের জন্য একটি, পশ্চিমবঙ্গের জন্য আরেকটি মুসলিম লীগ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলা ও আসামের জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল তাতে ১৫ জনের মধ্যে সভাপতি ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ এবং সচিব ময়মনসিংহের খান বাহাদুর (পরে নবাব উপাধি পেয়েছিলেন) সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীসহ ১২ জনই ছিলেন অভিজাত জমিদার শ্রেণীর। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন অবাঙালি বংশোদ্ভূত এবং উর্দু ভাষাতেই কথাবার্তা বলতেন। মুসলিম জনসাধারণের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভিত্তি ছিল তাদের জমিদারির প্রজা এবং একই ধর্মের অনুসারী হিসেবে। সাধারণ মুসলমানগণ নিজেদের বাঙালি মুসলমান মনে করত, কিন্তু এই নেতারা ‘বাঙালি’ বলতে শুধু ‘বাঙালি হিন্দু’ মনে করতেন। মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ এবং আসামের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে তা ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় স্থাপনে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লীগও মুসলিম জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন সেই নবাব, জমিদার এবং উচ্চবিত্তবান শ্রেণী যাদের সাংস্কৃতিক ভাষা ছিল ফার্সি, কথ্য ভাষা উর্দু। তারা কলকাতার আদি বাসিন্দাও ছিলেন না। তারা ছিলেন বহিরাগত। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে তাদের একাত্মবোধ কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না, এক ধর্ম এবং হিন্দু আধিপত্য ভীতি ছাড়া। নবাব জমিদার উচ্চবিত্তবানদের এই মুসলিম রাজনৈতিক তথা মুসলিম লীগ নেতৃত্ব, আসলে ‘জেন্টলম্যানস পলিটিকস’—‘ভদ্রলোকের রাজনীতি’। নিপীড়িত মুসলিম জনসাধারণের আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তাদের রাজনীতি ছিল না, তারা কোনোরূপ ‘এজিটেশানেল পলিটিকস’, আন্দোলনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাদের রাজনীতি ব্রিটিশ শাসক সমীপে আবেদন-নিবেদন এবং প্রতিনিধি প্রেরণেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই নিরবচ্ছিন্ন মুসলিম নেতৃত্ব ১৯১১ সালে বাংলা বিভক্তি রদ মেনে নিয়েছিলেন। ‘নাইট’, ‘নবাব’ উপাধি দিয়েই তাদের শান্ত ও সন্তুষ্ট করা গিয়েছিল।
কিন্তু শান্ত ও সন্তুষ্ট করা যায়নি তৎকালীন বাংলার রাজনীতিতে গড়ে ওঠা ইয়ং মুসলিম গ্রুপকে। তখন থেকে বাংলার মুসলিম রাজনীতি তথা বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ তরুণ পেশাজীবী মধ্যবিত্ত নেতৃত্বাধীনে চলে যেতে শুরু করল। এই নতুন নেতৃত্ব আবেদন-নিবেদন রাজনীতির বদলে, ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে একটা স্বাধীন প্রতিবাদী রাজনীতির পথে গেলেন। এই রাজনীতির প্রধান বক্তা ছিলেন পূর্ব বাংলার সংগ্রামী সন্তান আইনজীবী আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেন, অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধিতা নয়, মুসলিম লীগ অন্যান্য অগ্রসরমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করে দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করে যাবে। বাংলার মুসলিম রাজনীতির নতুন ধারায় মুসলমান মধ্যবিত্ত পেশাজীবী পরিবার থেকে আরো অনেকে এলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেদিনীপুরের বিশিষ্ট শিক্ষিত পেশাজীবী পরিবারের, অক্সফোর্ড থেকে আইনে বিসিএস ডিগ্রি নেয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সাতচল্লিশ-পূর্ব অবিভক্ত বঙ্গের ওই রাজনীতির মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রস্তুতি চলেছে।
১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গীয় শাসন এদেশের জনপ্রতিনিধিত্বকারী রাজনীতিকদের বিশেষ করে মুসলিম নেতৃত্বাধীনে এসে পড়ে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় যে চারটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তার সবক’টিই ছিল মুসলিম নেতৃত্বে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের এবং মন্ত্রিসভা গঠনের পর বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ দেখা দেয়। যে সমাজ এতদিন সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল সে সমাজ সমস্যা-সচেতন হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলো। জওহরলাল নেহরুর নিম্নলিখিত বক্তব্যেও তা ফুটে উঠেছে:
‘পরিষদের সদস্যরা তাদেরই গাঁয়ের লোক, তাদের ভোটেই পরিষদের সদস্য, কেউ কেউ মন্ত্রী বা অন্য কিছু আর তাদের হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী যাকে সব জেলার লোক দেখেছে—জেলা জজের কোর্টে ফৌজদারি মামলা করতে—গল্প করতে—লোক হাসাতে...গাঁয়ের দরিদ্র অনার্য হিন্দু ও সাধারণ মুসলমান যেন স্বর্গ পেল ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার পর।’ শুধু মুসলমান নেতৃত্বে বা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন নয়, ১৯৩৫ সালের আইনে ভোটাধিকারও সম্প্রসারণ করা হয়। ১৯১৯ সালে যেখানে লোকসংখ্যার মাত্র শতকরা ৩ ভাগ ভোটার ছিল, ১৯৩৫ সালের আইনে তা শতকরা ১৪ ভাগে উন্নীত করা হয়। প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে মুসলিম ভোটার সংখ্যা শতকরা ৩ থেকে ১৪ ভাগে অর্থাৎ প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।
নবাব-জমিদার বৃত্তের বন্দিদশা থেকে বাংলার মুসলিম রাজনীতিকে মুক্ত করে লোকজ রাজনীতিতে পরিণত করা, গণমুখী করে তোলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে কয়জন ছাত্র-যুবক কর্মী ছাত্ররাজনীতিতে নেমেছিলেন, মুসলিম লীগ রাজনীতির যুবনেতা হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিব অন্যতম। প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিব ছাত্ররাজনীতি এবং বৃহত্তর রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন ১৯৪২ সালে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর। সেখান থেকেই রাজনীতির পরিমণ্ডলে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রবেশ এবং রাজনীতিতে তার শিক্ষানবিসকালের শুরু। কলকাতার মুসলিম ছাত্রাবাস বেকার হোস্টেলেই ছিল মুসলিম ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্র। তৎকালীন বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট এ দেশের খ্যাতনামা দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সাইদুর রহমান, তার রচিত ‘শতাব্দীর স্মৃতি’ গ্রন্থে এ সত্যটি স্বীকার করেছেন। ‘বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদের মধ্যে শেখ মুজিব ও শাহ আজিজ ছাড়া অন্যরা নুরুদ্দীন আহমদ, মাজহারুল কুদুস, শামসুদ্দিন মোল্লা ও সারওয়ারজান।...ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ড. আই এই জুবেরীকে অনেক বোঝানোর পর তিনি আমাকে হোস্টেলের ৪০ জন ছাত্রকে টেস্ট পরীক্ষা ছাড়াই ফাইনাল পরীক্ষায় পাঠাবার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করেন। ফলে ৪০ জন ছাত্র টেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই আইএ পরীক্ষা দিতে সমর্থ হয়। তারা রাজনীতি ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকত যে পড়াশুনার পর্যন্ত সময় পেত না। এসব ছাত্রকে এই সুবিধাটুকু দেওয়ার পেছনে প্রধান কারণ, তারা রাজনীতি বা যে কাজ করত তার পেছনে অধ্যক্ষ জুবেরী (ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ) ও আমার পুরো সমর্থন ছিল।...ছাত্রদের জীবিকার জন্য কোনো সময় দিতে হতো না বলে তাদের পক্ষে লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশের...স্বার্থে এগিয়ে আসার সুযোগ বেশি। তখনকার সেই পরিস্থিতিতে ছাত্রদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসা খুবই জরুরি ছিল।’
অবিভক্ত বাংলার মুসলিম রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতি মূলত কলকাতাকেন্দ্রিকই ছিল। শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি এবং বেকার হোস্টেলে আবাসিক হয়ে সরাসরি তৎকালীন বৃহত্তর মুসলিম রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতির মূল স্রোতে চলে আসার সুযোগ পেলেন। তার শিক্ষক অধ্যাপক সাইদুর রহমান তাকে দক্ষ সংগঠক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই দক্ষতাবলেই শেখ মুজিব অল্প সময়ের মধ্যে তৎকালীন মুসলিম ছাত্ররাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনি রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষা পেয়েছিলেন তৎকালীন তরুণ মুসলিম লীগ নেতা এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিক। নবাব, নাইট ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুসলিম লীগকে নিয়ে এসে গণমুখী করে তোলার লক্ষ্যেই তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৪৩ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি মুসলিম লীগ প্রাদেশিক কাউন্সিলের সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণে ঘোষণা করেন, ‘আমি বাংলার মুসলিম লীগকে আমার সাধ্যমতো একটি ব্যাপক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংগঠিত করব।’ আবুল হাশিম তার রাজনৈতিক জীবনচরিতে বলেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন এবং তার মোসাহেবদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি যে আমার বক্তৃতা ছিল খাজাদের পকেট মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন করার সংকেত।’
‘আবুল হোসেন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, কলকাতার জহিরুদ্দীন, ঢাকার কমরুদ্দীন আহমদ, কাজী বশির, আলমাস আলী, আবদুল আওয়াল, তাজউদ্দীন আহমদ, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, কুমিল্লার খন্দকার মোশতাক আহমদ, অলি আহাদ, নোয়াখালীর মোহাম্মদ তোয়াহা এবং নাজমুল করিম প্রমুখের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া ও রক্ষণশীল খাজা নাজিমুদ্দিন- আকরম খাঁ-ইস্পাহানী নেতৃত্বের সমর্থনকারী ছাত্র-যুব কর্মীও ছিলেন। তাদের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান এবং আবদুস সবুর খান।
‘প্রকৃতপক্ষে তরুণ শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুসলমান ছাত্র-যুব কর্মীদের প্রতিবাদ এবং গণমুখী রাজনীতির মানস-গঠনের কাজ শুরু হয় আবুল হাশিমের নেতৃত্বে। এই ছাত্র-যুবক কর্মীদের আবুল হাশিম যে রাজনৈতিক দীক্ষা দিতেন তা তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি বাংলার মুসলিম যুবকদের মুসলিম লীগ পতাকাতলে মুসলমানদের সংগঠিত করার কাজে আমাকে তাদের সাহায্য প্রদানের আবেদন জানালাম। এই আবেদন ছিল শিক্ষিত যুবকদের প্রতি, যারা ছাত্র শুধু তাদের প্রতি নয়। ধীরে ধীরে হাজার হাজার মুসলিম যুবক মুসলিম লীগের কর্মী দলে যোগদান করলো এবং তাদের অধিকাংশই ছিল ছাত্র।... প্রাদেশিক মুসলিম লীগ অফিস ও পার্টি হাউস বাংলার সেই মুসলিম যুব নেতৃবৃন্দের মিলনকেন্দ্র ছিল যারা আমার কর্মী হিসেবে যোগদান করেছিলেন। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ও কর্মী যারা আমার মুসলিম লীগের গণমুখী নীতিকে গ্রহণ করেছিলেন তারা বিভিন্ন জেলা থেকে কলকাতা এলে পার্টি হাউসে থাকতেন।”
সে পার্টি হাউস ছিল কলকাতার ৩ নম্বর ওয়েলেসলির প্রথম লেনে। সেখানেই আবুল হাশিম রাজনৈতিক কর্মীদের ক্লাস নিতেন। তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব সেই রাতের ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আবুল হাশিম মন্তব্য করেছেন, ‘তিনি কাজের লোক ছিলেন। “সকালে উঠে জিজ্ঞাসা করতেন কী করতে হবে” এবং “ঠিকমতো তার কর্তব্য করতেন”।’ পরবর্তী জীবনে নিছক তাত্ত্বিক নয়, এক সক্রিয় সংগ্রামী রাজনীতিক, সফল রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তার যে উত্তরণ ঘটেছে, তার লক্ষণ তার সাতচল্লিশ-পূর্ব কলকাতার ছাত্ররাজনৈতিক জীবনেই লক্ষ করা গিয়েছিল। তার এ অ্যাকটিভিস্ট (activist) রাজনীতির কথা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘চোঙ্গা মুখে দিয়ে রাজনীতি করেছি, রাস্তায় হেঁটেছি, পায়ে হেঁটেছি, ফুটপাতে ঘুমিয়েছি। বাংলাদেশে এমন কোনো মহকুমা নেই, এমন কোনো থানা নেই, যেখানে আমি যাইনি।’ কলকাতার তিন নম্বর ওয়েলেসলি প্রথম লেনের রাজনৈতিক ক্লাসে আবুল হাশিম ‘রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাকরণ’ শিক্ষা দিতেন। সেই রাজনৈতিক ক্লাসে সমবেত তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও ভাববিনিময় নিঃসন্দেহে শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এসবের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক মানস গঠন চলছিল। আবুল হাশিম তার নেতৃত্বাধীন প্রগতিবাদী ছাত্র-যুব রাজনৈতিক কর্মীদের শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাকরণ শেখাতেন না, বিভিন্ন জেলায় গিয়ে নবাব, নাইট, জমিদারদের পকেট থেকে মুসলিম লীগকে বের করে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাকে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিতেন। উত্তর ও পূর্ববঙ্গের প্রায় সব জেলায়ই তার কর্মীরা মুসলিম লীগকে গণতান্ত্রিক করে তোলার অভিযানে জনসমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। কুমিল্লা ও ফরিদপুর জেলায় এ অভিযান সফল করে তোলা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘ফরিদপুরে ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবদুস সালাম খান এবং ওয়াহিদুজ্জামান খাজাদের প্রতিক্রিয়াশীল দলের সক্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন। ফরিদপুরে মুসলিম লীগের মধ্যে একটি শক্তিশালী বামপন্থী গ্রুপ সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিবুর রহমানকে খুবই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। উল্লেখিত এমন তিন ব্যক্তির কঠিন বিপক্ষতার বিরুদ্ধে তাকে কাজ করতে হতো যাদের প্রতি বাংলার মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পূর্ণ সমর্থন ছিল।’ প্রকৃতপক্ষে, সরকার সমর্থিত এই নেতাদের মোকাবেলা করতে গিয়ে তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবকে সরকারবিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ফরিদপুর জেলায় প্রতিক্রিয়াশীল নেতা ইউসুফ আলী চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান ও আবদুস সালাম খানের প্রভাব-প্রতিপত্তির অবসান ঘটানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমন্ত্রিত হন। গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রতিপত্তিশালী আবদুস সালাম খান। আবুল হাশিম সে সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন। তৎকালীন প্রগতিশীল বিশিষ্ট যুবনেতা কমরুদ্দীন আহমদের মতে, “সে সভায় এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে আবদুস সালাম খানের চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জে বেশি শক্তিশালী।’ শেখ মুজিব তার সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই সাহসিকতার সঙ্গে তার মানসিক দৃঢ়তা, কর্ম, কর্তব্যনিষ্ঠা ও বলিষ্ঠ সক্রিয়তা দিয়ে সব বাধাকে মোকাবেলা ও অতিক্রম করেছেন, রাজনীতিতে নিজেকে নেতৃত্বের শীর্ষে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান অনুসারী কমরুদ্দীন আহমদ। তার রচিত ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মপ্রকাশ’ বইটির প্রথম খণ্ডে ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রবেশ করেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী বুঝেছিলেন যে কলকাতার ওপর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও তা তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করতে হবে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে ‘পূর্ব বাংলার অন্তস্তলে প্রবেশের পথ।’ এজন্য তার দরকার পূর্ব বাংলা থেকে আগত কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে এমন একজন যুবক যাকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন নিজের বলে এবং যার মধ্যে রাজনৈতিক নেশা আছে।’ ‘তিনি খুঁজছিলেন একজন সাহসী ছেলে—রাজনৈতিক দল সংগঠনে যার প্রতিভা আছে অথচ তার সঙ্গে কাজ করবে আমরণ।’ যে ঘটনার মাধ্যমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেই প্রতিভাবান সাহসী ছেলেটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন তার বিবরণ প্রত্যক্ষদর্শী কমরুদ্দীন আহমদের ভাষায়, ‘১৯৪৪ সনের নভেম্বর মাসে যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বাৎসরিক কাউন্সিল সভা ডাকা হলো এবং অত্যন্ত গোপনে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়...সকাল না হতেই এ খবর কাউন্সিলারদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলো, তখন আবুল হাশিম অনুরাগীদের মধ্যে একটা ভয়ানক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লো।...সন্ধ্যার দিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সম্মুখে ফজলুল কাদেরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন আরম্ভ হলো— বক্তৃতা করলো প্রথমে নূরুদ্দীন তারপর শেখ মুজিবুর রহমান (শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর থেকে মুসলিম লীগ কাউন্সিলর ছিলেন)। আবুল হাশিম ও হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেব তখন বাইরে পায়চারী করছিলেন। নূরুদ্দীনের বক্তৃতা প্রায় শেষ—শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা আরম্ভ করেছেন, তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে বর্ধমানের আজমিরী লাফিয়ে উঠলেন টেবিলের উপর। মুজিবের বক্তৃতার সময় শহীদ সাহেব নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হলো ফজলুল কাদের তার নেতৃত্ব কিছুক্ষণের জন্য মুজিবের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের বক্তৃতা জোরালো হয়েছিল এবং যুক্তিপূর্ণও। ফলে শহীদ সাহেব কাউন্সিলের উপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিতে রাজী হলেন। সেদিন সে মুহূর্তেই শহীদ সাহেব বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেদিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান আবুল হাশিমের বামপন্থীদের একজন হলেও শহীদ সাহেবের স্নেহ ও প্রীতিভাজন হলেন, এতোদিনে যেনো শহীদ সাহেব সন্ধান পেলেন তিনি যাকে খুঁজছিলেন তাঁকে।’
একদিকে আবুল হাশিমের গণমুখী, প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে, অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর লিবারেল ডেমোক্রেসি, উদার গণতান্ত্রিক ভাবধারার সংমিশ্রণে তরুণ সংগ্রামী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চরিত্র গঠিত হচ্ছিল। একদিকে যেমন কলকাতার তিন নম্বর ওয়েলেসলির প্রথম লেনের পার্টি হাউজে আবুল হাশিমের রাজনৈতিক ক্লাস থেকে তিনি দীক্ষা পেয়েছিলেন ‘গ্রামার অব পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার’-এ, রাজনৈতিক সংগ্রামের ব্যাকরণে, অন্যদিকে তেমন বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভাকে কেন্দ্র করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতি থেকে শিখেছিলেন পার্লামেন্টারি বা সংসদীয় রাজনীতি। একই সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতি এবং রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে রাজনীতিতে তিনি নিজেকে দীক্ষিত করে তুলছিলেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নতুন নেতৃত্বের (সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম) কাছে একজন অতি প্রয়োজনীয়, নির্ভরযোগ্য সাহসী, সংগ্রামী নিরলস রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আদৃত হতেন। সে সময়ের মুসলিম ছাত্ররাজনীতি এবং বৃহৎ মুসলিম রাজনীতির সব তত্পরতায়, কর্মকাণ্ডে তাকে বিশিষ্ট ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। কলকাতা যাওয়ার আগেই স্কুল ছাত্র হিসেবে তিনি ১৯৪০ সালের প্রথম মুসলমান ছাত্র সংগঠনে যোগদান করেন, যা ১৯৩৭ সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন নামে গঠিত হয় এবং ১৯৩৮ সালে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে সারা ভারতের মুসলমান ছাত্রদের এক মহাসম্মেলনে যার বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ নাম দেয়া হয়। প্রথম থেকেই ‘মুসলিম ছাত্রলীগ বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত ছিল এবং তারা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা দখল করার জন্যে পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতো।’
মূল দল মুসলিম লীগের দুই শিবিরে বিভক্তির বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে। এই বিভক্তির সমান্তরালে মুসলিম ছাত্রলীগও দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল, সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম সমর্থক প্রগতিপন্থী এবং আকরম খাঁ-নাজিমুদ্দিন সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীলপন্থী। তরুণ মুসলিম ছাত্র শেখ মুজিব কলকাতায় এসে প্রগতিপন্থী শিবিরেই যোগদান করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কলকাতার মুসলিম লীগ কেন্দ্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরো প্রগতিপন্থী শিবিরের যারা ছিলেন তারা হলেন বরিশালের আবদুর রহমান, খুলনার শেখ আবদুল আজিজ, রাজশাহীর আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, বগুড়ার বিএম ইলিয়াস, শাহ আবদুল বারি, রংপুরের আবুল হোসেন, দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, কলকাতার জহীরুদ্দিন এবং ইসলামিয়া কলেজের শাহাবুদ্দিন ও নূরুদ্দীন আহমেদ। অনুরূপ বিভক্তি ঢাকা কেন্দ্রেও ছিল। ঢাকা কেন্দ্রের প্রগতিপন্থী নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ছাত্রনেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক, কুমিল্লার খন্দকার মোশতাক আহমদ, অলি আহাদ, নোয়াখালীর নাজমুল করিম এবং মোহাম্মদ তোয়াহা, ঢাকার ইয়ার মোহাম্মদ, কাজী মোহাম্মদ বশীর, শামসুদ্দিন আহমদ, আলমাস আলী, আবদুল আউয়াল, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কমরুদ্দীন আহমদ।
১৯৪৭-উত্তরকালে ঢাকায় শেখ মুজিব এবং তার সহযাত্রী ছাত্রনেতারা বিদ্রোহী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের ‘বঙ্গ’-এর স্থানে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বসানো নাম নিয়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তান সরকার সমর্থিত, প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র নেতৃত্বাধীন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে’র বিপরীতে ১৯৪৮ সালেই ‘নিখিল’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, ‘ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশের এই কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতাদের—বিরোধী, ক্ষমতার বাইরের মুসলিম লীগ নেতাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাহসী করে তুলেছিলো। সত্যি কথা বলতে কি, ছাত্রলীগের এই বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ডই নবীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রথম বিরোধী দলীয় কর্মকাণ্ডেরও সূত্রপাত ঘটায়।’ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের দিকে। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের সাহসী ছাত্র শেখ মুজিব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী পথ, ইসলামিয়া কলেজের ছাত্ররাজনীতিক হিসেবে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে যে দ্রোহের পথ বেছে নিয়েছিলেন তা থেকে তিনি তার পরবর্তী সংগ্রামী জীবনে কখনো সরে দাঁড়াননি। তার পথপ্রদর্শক আবুল হাশিমের মত ও পথের পরিবর্তন হয়েছিল। ১৯৪৭-পরবর্তী দুই বছর ভারতে থাকাকালে তিনি আল্লামা আজাদ সোবহানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। তার মধ্য থেকে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব চলে গিয়ে, আজাদ সোবহানীর রব্বানীয় দর্শনের প্রভাব দৃঢ়মূল হয়। ঢাকায় এসে তিনি তমদ্দুন মজলিসের কর্মীদের নিয়ে ‘খেলাফতে রব্বানী পার্টি’ গঠন করেন।
১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের এক সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনই ছিল অবিভক্ত বঙ্গের মুসলিম ছাত্রলীগের শেষ সম্মেলন। এ সম্মেলনে মুসলিম ছাত্রলীগের দুই শিবিরের মধ্যে বিরোধ বেশ প্রকট হয়েই দেখা দেয়। প্রগতিপন্থী শিবিরের অন্যতম নেতা হিসেবে শেখ মুজিব এ সম্মেলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিনের রাজনৈতিক, ইস্পাহানীর অর্থনৈতিক এবং আকরম খাঁর প্রচারের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের সামসুল হুদা চৌধুরী এবং শাহ আজিজুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এতৎসত্ত্বেও নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের প্রগতিশীল শিবির ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের সমান্তরালে ছাত্র কংগ্রেস এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মিলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।
১৯৪৭-পূর্বকালে তরুণ শেখ মুজিবকে আমরা দেখেছি মুসলিম লীগের পতাকাতলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন ব্যতিক্রমধর্মী কর্মী হিসেবে। সেদিন পাকিস্তান আন্দোলনকে তিনি তার চিন্তায়-চেতনায় কীভাবে নিয়েছিলেন, চল্লিশের লাহোর প্রস্তাবের তাত্পর্য তার কাছে কী ছিল। ১৯৪০ সাল থেকে বাংলার মুসলমান লাহোর প্রস্তাবকে গ্রহণ করেছিল তাদের চিন্তায়-চেতনায়। তারা নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাবে এ ধারণাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান আন্দোলনে। ১৯৪২ সালে তরুণ ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব কলকাতায় এসে যখন ছাত্ররাজনীতি এবং বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকায় নামেন তখন পাকিস্তান আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠেছে। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই তার কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবন গড়ে ওঠে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি, আবুল হাশিমের মতোই, ‘একজন মুসলমান ও বাঙালির স্বাধীনতা দেখেছিলেন লাহোর প্রস্তাবে’ এবং ‘...এর ভিত্তিতেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন, আন্দোলনে নেমেছিলেন।’
তিনিও মনে করতেন, ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক কিছু ছিল না।’
For the Suhrawardy-Haslum group, within the Bengal Muslim League, the so called Two Nations Theory was not an article of faith as an ideological basis of Nikhil Pakistan rather a strategic framework for the united struggle of the Indian Muslims against their common principal enemy.
শেখ মুজিবও জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে অখণ্ড পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে নয়, ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের একটি কৌশলগত কাঠামো বলেই মনে করতেন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বস্তুত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথাই বলা হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনকে ঘিরে শেখ মুজিব বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাই তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের পূর্বে আমরা যারা স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের স্বপ্ন ছিল আমরা স্বাধীন হব।’
আন্দোলন ও সাংগঠনিক দক্ষতা থাকার কারণে শেখ মুজিব ১৯৪২ সালে কলকাতায় আসার অল্পকালের মধ্যে ছাত্রকর্মী মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। বেকার হোস্টেলের যে ২৪ নম্বর কক্ষটিতে তিনি থাকতেন তা আন্দোলন বিষয়ক আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হলো। তখন বেকার হোস্টেলের ১৮ নম্বর রুমে থাকতেন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র মুহম্মদ মুজাফফর আলী, পরবর্তীকালে যিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইংরেজী ১৯৪৬ সাল। ভারতের শাসক ইংরেজের গোলামি থেকে ভারতকে মুক্ত করে সার্বভৌম স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে তুমুল আন্দোলন চলছিল। সারা ভারতের মুসলিম ছাত্রদের মধ্যেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উগ্র বাসনা জাগরিত হয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধু ও আমি তৎকালীন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে উক্ত কলেজের ছাত্রাবাস বেকার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে বসবাসরত ছিলাম।...পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে খুবই সাড়া জাগিয়েছিল।...তৎকালীন মুসলিম ছাত্ররা সকাল বেলায় “দৈনিক আজাদ” এবং “সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ” পত্রিকা দুটি খুব ভালোভাবে পড়তাম এবং আমাদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনের বিষয় আলোচনা করতাম। বেকার হোস্টেলে থাকাকালীন আমরা সবাই পত্রিকা দুটি পড়ার জন্য শেখ মুজিব অর্থাৎ মুজিব ভাইয়ের ২৪ নম্বর কামরায় ভিড় জমাতাম। ২৪ নম্বর কামরার বারান্দায়ও ভিড় জমতো। তখন পাকিস্তান আন্দোলনের বিষয় আলোচনা হতো।’...শেখ মুজিবের সেই ২৪ নম্বর কক্ষটি ছিল কলকাতার মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সব ছাত্রমিছিল এই বেকার হোস্টেল থেকেই শুরু হতো।...সে সময়ের কলেজের মুসলমান ছাত্রদের আচার-আচরণ থেকেও তৎকালীন মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃতি ও স্বরূপের আভাস মেলে। ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের এক সময়ের সহসভাপতি বিএম ইলিয়াসের সাক্ষাৎকারের বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘একটা কথা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ ভারতে আলাদাভাবে সচেতন মুসলমান ছাত্রদের রাজনৈতিক গতিধারায় সাম্প্রদায়িক চেতনা থাকলেও ধর্মান্ধতা ছিল না। আর এসব মুসলমান ছাত্রের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলা হয়েছে তা-ও সংকীর্ণ অর্থের সাম্প্রদায়িক চেতনা নয়। এ অনেকটা প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের তুলনায় স্ব-সম্প্রদায়ের বিকাশ কাম্যতা থেকে। প্রতিযোগিতায় মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ হিন্দু সম্প্রদায় থেকে নানা ক্ষেত্রে যেভাবে পিছিয়ে ছিল তা থেকে উত্তরণের সংঘবদ্ধতা এটি।’
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭-এর আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছর কালকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনাকাল বলে চিহ্নিত করা যায়। ‘আলাদাভাবে সচেতন মুসলমান ছাত্রদের রাজনৈতিক গতিধারার মধ্যে নিজেকে ধরে রেখেই শেখ মুজিব উপমহাদেশীয় আন্দোলন সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি যার ঢেউ এসে অবিভক্ত বঙ্গেও অনুরূপ আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।’ ‘বৃটিশবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুসলমান ছাত্রদের যা অবদান তার সিংহভাগটাই ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের অবদান। এ ক্ষেত্রে তারা ছিল খুবই সক্রিয়। সেই কলেজের একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিব যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি অগ্রণী ভূমিকাও পালন করেন। শেখ মুজিবের এই ভূমিকা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিল।’
শেখ মুজিব তখন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তিনি নির্বাচনের কাজে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেন। দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ, ১৯৪৬-এর নির্বাচনের তাত্পর্য ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা, এক কথায় সারা দেশে পাকিস্তান তথা মুসলিম লীগের পক্ষে বিপুল সমর্থন গড়ে তোলার ফলে ১৯৪৬-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার ১২১টি মুসলিম আসনের ১১৭টি পায় (শতকরা ৯৬.৬৯)। অন্যদিকে, সব প্রদেশ মিলিয়ে পায় ৪৮২টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪২৩টি (শতকরা ৪৭.৭৬)। ১৯৪৬-এর সাধারণ নির্বাচনে সাধারণ আসনগুলোতে কংগ্রেসের এবং মুসলিম আসনগুলোতে মুসলিম লীগের বিরাট জয়লাভ প্রমাণ করে যে এই উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমান জনগণ তাদের স্ব স্ব দাবিমতো স্বাধীনতা চায়।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইংরেজ সরকারের মনোভাবের বিরুদ্ধে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করেন। কেবিনেট মিশনের পরিকল্পনা কৌশলে দায় এড়ানোর এবং মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে পাকিস্তান অর্জনের পথে একটি পদক্ষেপ হিসেবেই তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ পালন কমসূচি গ্রহণ করেছিল। ১৯৪৬-এর ১ আগস্ট কলকাতার এক ছাত্র সমাবেশে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কোনো রাজনৈতিক দল কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়। ১৩ আগস্ট ১৯৪৬-এ তার দেয়া এক সংবাদ বিবৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি উল্লেখ করেছিলাম মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য এবং এ কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমাদের লক্ষ্যবস্তু কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।’ ১৯৪৬ সালে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে সফল করে তোলার জন্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইসলামিয়া কলেজ এবং বেকার হোস্টেলের যেসব ছাত্র কাজ করেছিলেন তাদের একজন ম. মুজাফফর আলী ২৮ ডিসেম্বর (১৯৯৭) তারিখে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, শেখ মুজিব কয়েকজন ছাত্রনেতা নিয়ে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রদের নিয়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস সম্পর্কে প্রচার জোরেশোরে চালাবার জন্য শেখ মুজিবকে নির্দেশ দেন।
ম. মুজাফফর আলী তার প্রবন্ধে আরো লেখেন, ‘১৫ আগস্ট বিকেল বেলা আমরা দেখতে পেলাম ২০টি ট্রাক কয়েকটি মাইকসহ বেকার হোস্টেলের গেটের সামনে হাজির। মুজিব ভাই আমাদের নির্দেশ দিলেন সন্ধ্যার সাথে সাথেই আমরা যেন হোস্টেলের ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে ট্রাক মিছিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি।...ছাত্রদের বেকার হোস্টেলের লনের ভেতর একত্রে জমা করে স্লোগান সম্পর্কে তিনি (শেখ মুজিব) নির্দেশ দিলেন। স্লোগানগুলি ছিল “নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর”, “অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, জিন্দাবাদ”, “গড়ের মাঠে মি. জিন্নাহর জনসভায় যোগ দিন”, “ডাউন ডাউন ব্রিটিশ ইম্পেরিয়ালিজম”, “আপ আপ লীগ ফ্ল্যাগ, লীগ ফ্ল্যাগ”। ট্রাক মিছিলের একেবারে সামনের ট্রাকে মুজিব ভাই-এর সঙ্গে অনেকের মধ্যে আমিও ছিলাম...বড়বাজার থানার...তৎকালীন মুসলমান ওসি জনাব মোকাদ্দাস হোসেন আমাদের সামনে এসে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যেন আমরা কংগ্রেস বা হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার স্লোগান না দেই। মোকাদ্দাস হোসেন...ঢাকার গ্রীন রোডে বাড়ি করে এখনও অবস্থান করছেন এবং মোটামুটি সুস্বাস্থ্য নিয়ে ৯৫ বছর বয়সে জীবিত আছেন। কলকাতার ছাত্র আন্দোলনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের কথা তিনি এখনও মনে রেখেছেন।’
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৫ আগস্ট রাতে ছাত্ররা যে মিছিল করেছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশবিরোধী। ১৯৪৬-এর ১৯ জুলাই বম্বেতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আগত মুসলিম লীগ নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত খেতাব বর্জনের পর বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনার প্রতি আমার ঐকান্তিক সমর্থন থাকবে যদি প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিচালিত হয় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এবং ভারতের কোন্দল বা জনগণের বিরুদ্ধে নয়।’ কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী এ প্রত্যক্ষ সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক এবং কংগ্রেসবিরোধী রূপ দিতে, এর অপব্যাখ্যা করতে একদিকে তত্পর ছিলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ হাই কমান্ড, অপরদিকে হিন্দু মহাসভা। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এবং ব্রিটিশ সরকারের একান্ত অনুগত খাজা নাজিমুদ্দিন তার মুরব্বিকে খুশি করার জন্য কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন যে, ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরেজের বিরুদ্ধে নয় হিন্দুদের বিরুদ্ধে।’ আবুল হাশিমও খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযোগ এনেছিলেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে আহুত জনসভায়, ‘খাজা নাজিমুদ্দিন তার বক্তৃতায় যখন বললেন, আমাদের সংগ্রাম কংগ্রেস এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে, তখন আমি তাকে মাইক্রোফোন থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে ইঙ্গিত করে দৃঢ়তার সাথে বললাম, আমাদের সংগ্রাম ভারতের কোনো জনসাধারণের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সংগ্রাম ফোর্ট উইলিয়ামের বিরুদ্ধে।’
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস কেন্দ্র করে ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট পর্যন্ত কলকাতায় যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলেছিল তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দায়ী করে তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বঙ্গীয় বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বিধানসভার ইউরোপিয়ান গ্রুপের নেতা গ্ল্যাডিংয়ের মতে, এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। আসলে এ দাঙ্গার জন্য হিন্দুরা মুসলমানদের এবং মুসলমানরা হিন্দুদের দোষ দিলেও এর মূলে ছিল এ দেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি’র পরিণতি। বঙ্গীয় বিধানসভায় আবুল হাশিম কংগ্রেসকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘বিগত পঞ্চাশ বছরে আপনাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে ভারতীয় মানচিত্রে লাল রং মুছে গেছে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয়দের রক্তে ভারতীয় মানচিত্রে গাঢ় লাল রং লেপন করবে।’
১৬ আগস্ট অক্টরলোনি মনুমেন্টের পাদদেশে মুসলিম লীগের জনসভার আগেই সকাল থেকে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে পারে কিংবা সকাল থেকেই দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে এ সম্পর্কে কোনো ধারণা মুসলিম লীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের জানা ছিল না। তার মতে, ‘মানুষ মিথ্যা বলতে পারে কিন্তু পরিস্থিতি কখনো মিথ্যা বলে না।’ লাহোর প্রস্তাবকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা দেখেননি। শেরেবাংলার লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দিল্লি প্রস্তাব অবশ্য দুই পাকিস্তানের বদলে এক পাকিস্তানের প্রস্তাব ছিল, সম্ভবত স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব তারই প্রায়শ্চিত্ত।
শুরুতে তারা অবশ্য অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এই ভেবে যে কলকাতাসহ শিল্পোন্নত ও খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে অখণ্ড বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে পুরোপুরিভাবে পাকিস্তান কাঠামোতে না থাকলেও অন্তত পাকিস্তান প্রভাব বলয়ে থাকবে, তার অনুষঙ্গী ও মিত্র হিসেবে। কিন্তু তারা দেখলেন যে অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গের আন্দোলনের নেতৃত্ব এবং তাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিকরা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ঊর্ধ্বে বাঙালি ও বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান এবং এ এম মালিক এক পক্ষে, শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায় ও মন্মথরঞ্জন বকসী অন্য পক্ষের মধ্যে যে সাময়িক চুক্তি হয় তাতে যুক্ত নির্বাচন এবং হিন্দু ও মুসলমানদের সামরিক এবং পুলিশসহ সব চাকরি ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলা হয়, তখন তারা মনে করলেন যে এতে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বই অস্বীকার করা হলো, যা পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি। আকরম খাঁ-নাজিমুদ্দিন-ইস্পাহানী গ্রুপ এ আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা শুরু করলেন, সঙ্গে থাকল শাহ আজিজুর রহমানের ছাত্র গ্রুপ। হিন্দু মহাসভা, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপের বিরোধিতা এবং তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটনের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার স্বপ্ন সার্থক হলো না। সর্বোপরি স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব একেবারে শেষ মুহূর্তে করা হয়েছিল।
তারপর থেকে উপমহাদেশের বিশেষ করে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতি দ্রুত ভারত এবং তৎসহ পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কমরুদ্দীন আহমদের দেয়া সে সময়ের ঘটনাবলির বিবরণ থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি তুলে ধরা দরকার। বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা ও সংবাদপত্র স্বাধীন বাংলার বিরোধিতা করতে আরম্ভ করে এবং আবুল হাশিমের মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার যে কোনো অধিকার নেই তাই সবাই বলতে আরম্ভ করলেন। হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেব যিনি হাশিম সাহেবের স্থলে সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা ডাকলেন ৩১ মে তারিখে (১৯৪৭)...। সে সভায় ‘স্বাধীন বাংলার’ অপমৃত্যু মুসলিম লীগ রচনা করল। ...জুন মাসের ২ তারিখে মাউন্টব্যাটন সব নেতার সঙ্গে আলোচনা করলেন। এঁরা ছিলেন ‘বিগ সেভেন’—নেহরু, প্যাটেল, কৃপালানি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে, জিন্নাহ, লিয়াকত, আবদুর রব নিশতার মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে এবং বলদেব সিং শিখদের পক্ষ থেকে। লক্ষণীয় যে জিন্নাহ বাংলা থেকে এই সম্মেলনে যোগদানের জন্য একজনকেও মনোনীত করেননি এবং ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা ভারত বিভাগ এবং পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুই ডমিনিয়ন গঠন পরিকল্পনা তাদের গ্রহণ করতে বললেন। নেহরু, জিন্নাহ ও বলদেব সিং মাউন্টব্যাটনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রেডিও থেকে বক্তৃতা করেন। স্থির হলো যে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হবে।...‘৫ জুন তারিখে মুসলিম লীগ কাউন্সিল মাউন্টব্যাটনের দান দুহাত পেতে গ্রহণ করলো।...জুন মাসের মুসলিম লীগ অধিবেশনে জিন্নাহর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আবুল হাশিম সাহেব ও হসরত মোহনী বক্তৃতা করতে চাইলে জিন্নাহ সাহেব তাঁদের বক্তৃতা করতে দিতে অস্বীকার করেন।’
মাউন্টব্যাটন পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গীয় বিধানসভার পশ্চিমবঙ্গীয় সদস্যদের অথবা পূর্ববঙ্গীয় সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বঙ্গ বিভক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গীয় সদস্যদের ৭৯ জনের ৫৪ জন সদস্যই ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বিভক্তির পক্ষে ভোট দেন। বঙ্গ বিভক্তি হয়ে গেল। ১৯০৫ সালে যাদের কাছে বঙ্গ বিভক্তি ছিল মহাপাপ, ১৯৪৭ তাদের উত্তরসূরিদের কাছে তা হয়ে দাঁড়াল মহাপুণ্য। এরপর শুরু হলো পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে পার্লামেন্টারি নেতা, তথা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন। এ নির্বাচনে প্রগতিশীল মুসলিম লীগ গ্রুপের শেখ মুজিব ও তার সমমনা কর্মীবৃন্দ চেয়েছিলেন, বঙ্গ বিভক্তি তো রোধ করা গেল না, পূর্ববঙ্গের শাসনক্ষমতায় যেন জিন্নাহর পছন্দ খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তার রাজনৈতিক সঙ্গীরা না বসতে পারে। কারণ তাতে পাকিস্তানের নামে পূর্ববঙ্গে পশ্চিমের উর্দুভাষীদের শাসন কায়েম হবে। পূর্ববঙ্গ সদস্যদের সভায় নেতৃত্বের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন এবং পরাজিত হলেন। খাজা নাজিমুদ্দিন পেলেন পঁচাত্তর ভোট, সোহরাওয়ার্দী পেলেন ঊনচল্লিশ ভোট। ১৩ আগস্ট পশ্চিম বাংলার দায়িত্ব বুঝে নিলেন প্রফল্ল ঘোষ, পূর্ব বাংলার দায়িত্ব খাজা নাজিমুদ্দিন। এ নির্বাচনে আবুল হাশিম সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন দেননি, নিরপেক্ষ ছিলেন। এ কারণে শেখ মুজিবসহ তার অনেক অনুসারীর মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় যা তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।
সেদিনের তরুণ ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিব, নূরুদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান, কমরুদ্দীন আহমদ প্রমুখের চিন্তার ও চেতনার গভীরে বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন রয়ে গিয়েছিল, যা মুছে যায়নি। তার প্রমাণ ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দানের কথা ঘোষণা করার পর পরই শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে ছাত্র ও যুব নেতাদের এক রুদ্ধদ্বার কক্ষ সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’