কাজী গোলাম মাহবুব

১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার গৌরনদী থানার কসবা গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।

১৯৪৭ সালে ১৪ জন ভাষাসংগ্রামী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘আমাদের দাবি’ সংবলিত ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়ন করেন। এই একুশ দফার দ্বিতীয় ও অন্যতম দফাটি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা সংক্রান্ত। এই ঐতিহাসিক ইশতেহারের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজী গোলাম মাহবুব ছিলেন এর অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে কাজী গোলাম মাহবুব একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সম্প্রসারিত ও দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সভায় উপস্থিত ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কাজী গোলাম মাহবুব অংশগ্রহণ করেন এবং বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে পুলিশি আক্রমণে আহত হন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্তির পর কাজী গোলাম মাহবুব তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতনতার পরিচয় দেন। সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত কর্মসূচিকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তিনি নানা কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে অলি আহাদ, আবদুল মতিন, শামসুল আলম (ফজলুল হক হলের ভিপি) ও গোলাম মাওলা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে কাজী গোলাম মাহবুব শামসুল হককে সঙ্গে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশস্থলে হাজির হন। সভায় সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কাজী গোলাম মাহবুব ও শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বক্তব্য রাখেন। এ সভায় গাজীউল হক সভাপতিত্ব করছিলেন। কাজী গোলাম মাহবুব কিংবা শামসুল হকের বক্তব্য ছাত্রদের পছন্দ হয়নি।

১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে উত্তাল জনতা সরকারকে কড়া জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ১০ জন করে ছাত্রনেতা বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার বরণ শুরু করেন। স্পষ্টত কাজী গোলাম মাহবুবসহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে থাকলেও যখন আমতলার ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ছাত্র-জনতার ওপর নেমে আসে পুলিশের অত্যাচার, তখন তিনি ও সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ নেতা বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নেন।

একুশের গুলিবর্ষণের পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদের করণীয় নির্ধারণের জন্য কাজী গোলাম মাহবুব ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একটি বৈঠক ডাকেন। আবুল হাশিম, আবদুল গফুর, কমরুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, কবির উদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লা কায়সার, কাজী মোস্তাফা, মাহবুব জামাল জাহেদী, ডা. গোলাম মাওলা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

২ মার্চ ১৯৫২ তারিখে কাজী গোলাম মাহবুবসহ ৯ জন ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে একটি গেজেট প্রকাশিত হয়। গেজেটে প্রকাশিত প্রথম নামটি ছিল কাজী গোলাম মাহবুবের। আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, যাদের ধরা যায়নি তাদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ইত্যাদি ব্যাপক দমননীতির মধ্যে কাজী গোলাম মাহবুবকে গোপন অবস্থানে থেকেও আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে কিছু তৎপরতা চালিয়ে যেতে দেখা যায়।

একই সঙ্গে কাজী গোলাম মাহবুব গোপনে গোপনে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালান। ৭ মার্চ শান্তিনগরে ডাক্তার আবদুল মোতালেবের বাসায় যেসব ভাষাসংগ্রামী গ্রেপ্তার হননি, তাদের একটি বৈঠক হয়। পুলিশ গোপন সংবাদটি জেনে যায় এবং বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সেখান থেকে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। (সূত্র দৈনিক আজাদ : ১০ মার্চ ১৯৫২)।

কাজী গোলাম মাহবুব বাঁশের খাঁচার ওপর এমনভাবে শুয়ে পড়েছিলেন যে, পুলিশ তাকে দেখতে পায়নি। রাত ৩টার সময় তিনি সে বাসা থেকে বের হয়ে ওয়ারীতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন। সেখান থেকে মোশাররফ হোসেনের সহায়তায় তাদের ফরিদপুর জেলার আমিরপুরের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর তিনি ঢাকা ফিরে এসে আতাউর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আইনের আশ্রয় নিয়ে কিছু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে পরামর্শ করেন।

আতাউর রহমান খান তাকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন। ২৯ মার্চ কাজী গোলাম মাহবুব ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেখান থেকে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কাজী গোলাম মাহবুব প্রায় এক বছর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকেন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।

SUMMARY

227-1.jpg